নেপালের হাতিওয়ালা

Image by ICIMOD via Nepali Times. Used with permission.

নেপালি টাইমসের মাধ্যমে আইসিআইএমওডি’র ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

আইসিআইএমওডি’র বাস্তুতন্ত্র পরিষেবার গবেষণা সহযোগী বিরাজ অধিকারীর এই নিবন্ধটি নেপালি টাইমসে প্রথমবার প্রকাশিত হয়। একটি বিষয়বস্তু ভাগাভাগি চুক্তির অংশ হিসেবে এর একটি সংক্ষিপ্ত ও সম্পাদিত সংস্করণ গ্লোবাল ভয়েসেসে পুনঃপ্রকাশিত হলো।

ফেব্রুয়ারিতে আমি নেপালের ঝাপা জেলার বাহুনডাঙ্গিকে পৌঁছালে এটিকে একটি ঘুমন্ত ছোট্ট শহরের মতো মনে হলেও এর নিস্তব্ধতা প্রায়ই বিঘ্নিত হচ্ছিল যানবাহন বা কোলাহলপূর্ণ নির্মাণের জন্যে নয় বরং বন্য হাতিদের কারণে। গ্রামটি কয়েক শতাব্দী ধরে উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্য আসাম থেকে, ভুটানের নিম্নভূমি এবং পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্য দিয়ে খাদ্য ও জলের সন্ধানে নেপাল পর্যন্ত প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলাচলকারী বন্য হাতিদের অভিবাসন পথের ওপর পড়েছে।

Shankar Chettri Luitel. Image by ICIMOD via Nepali Times. Used with permission.

শঙ্কর ছেত্রি লুইটেল। নেপালি টাইমসের মাধ্যমে আইসিআইএমওডি’র ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

তবে সাম্প্রতিক জনবসতি সম্প্রসারণ এবং বনকে কৃষি জমি ও চা বাগানে রূপান্তরিত করার ফলে এই পথগুলিকে খণ্ডিত হয়ে যাওয়ার ফলে হাতি এবং মানুষের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়েছে। প্রতি বছর এসব সংঘাতে ফসল ও বাসস্থান ধ্বংস, মানুষের আঘাতপ্রাপ্তি ও মৃত্যুর ফলে হাতিদের প্রতিশোধমূলকভাবে হত্যা করা হয়। এই সংঘাতে বাহুনডাঙ্গি বিশেষভাবে আক্রান্ত হলেও কয়েক বছর ধরে এসবের পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে শঙ্কর ছেত্রি লুইটেলসহ মুষ্টিমেয় কিছু সংরক্ষণবাদীর জন্যে।

তিনি পঞ্চাশোর্ধ, হালকা-পাতলা, গুরু-গম্ভীর কিন্তু সহায়ক স্বভাবের একজন মানুষ। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে মানুষ-হাতি সংঘর্ষের গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছেন। লুইটেলের কাছে এই অঞ্চল এবং মানব-বন্যপ্রাণীর যোগাযোগের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য-ভাণ্ডার থাকলেও কেন তিনি হাতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এতো উৎসাহী সে বিষয়ে আমি কোন ঠাহর পর্যন্ত করতে পারিনি।

“২০০১ সালে আমার খামারে একটি হাতি প্রসব করার সময় আমি প্রথমবার হাতির সাথে আবেগগতভাবে জড়িত হই। এভাবেই আমার সংরক্ষণের যাত্রা শুরু হয়,” লুইটেল ব্যাখ্যা করেন।

Image via Nepali Times. Used with permission.

নেপালি টাইমসের মাধ্যমে আইসিআইএমওডি’র ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

মানুষের কল্যাণ জীববৈচিত্র্যের উপর নির্ভর করলেও আমাদের জীবনকে আরো উন্নত করার উদ্দেশ্যে ক্রিয়াকলাপগুলি প্রকৃতি এবং বাস্তুতন্ত্রকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে, জীববৈচিত্র্যের ভবিষ্যৎ এবং আমাদের অস্তিত্বকে হুমকি দিচ্ছে। এই কারণে আমাদের মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সহাবস্থানের উপায় খুঁজে বের করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

Image via Nepali Times. Used with permission.

নেপালি টাইমসের মাধ্যমে আইসিআইএমওডি’র ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

এই বছরের আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস (২০ মে) এর প্রতিপাদ্যটি হলো “সকল জীবের জন্যে ভাগভাগি করা ভবিষ্যৎ।” এটিকে কাল্পনিক এবং দূরবর্তী মনে হলেও আমি বুঝতে পেরেছি এই অপ্রশংসিত নায়ক: শঙ্কর ছেত্রি লুইটেলের কারণে এটি সম্ভব।

আমার মানুষ-বন্যপ্রাণীর মিথস্ক্রিয়া নিয়ে পিএইচডি গবেষণাই আমাকে ভারতের সীমান্তবর্তী নেপালের সবচেয়ে পূর্ব দিকের সমভূমি ভুটান, ভারত এবং নেপালের কিছু অংশ বিস্তৃত আন্তঃসীমান্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্যপটের একাংশের একটি ছোট শহর বাহুনডাঙ্গিতে নিয়ে যায়।

বন্যপ্রাণী বিষয়ে সামান্য বা কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকলেও লুইটেল স্বেচ্ছায় জীববৈচিত্র্য ও সংরক্ষণ সম্পর্কে অনেক কিছু শেখা এলাকাটির সংঘাত ব্যবস্থাপনার বহু সমীক্ষা, কর্মকাণ্ড এবং পরিকল্পনায় জড়িত হন। সময়ের সাথে সাথে তিনি পরিযায়ী হাতি, তাদের বাসস্থান, আচরণ এবং মানব-বন্য হাতির যোগাযোগের আর্থ-সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে জানার আশায় গবেষকদের কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠেন। তিনি পরিকল্পনা এবং পরিচালনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করেন এবং এই সম্পৃক্ততা তাকে পরিযায়ী ধরন নিরীক্ষণের জন্যে জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের ব্যবহার করার মতো বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি শিখতে সাহায্য করে। তিনি হয়ে উঠেন একজন সত্যিকারের নাগরিক বিজ্ঞানী।

এখন লুইটেল সম্প্রদায়কে বন্য হাতিদের অবস্থান এবং গতিবিধি সম্পর্কে সচেতন করার মতো একজন হাতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন। আমার ধারণার বিপরীতভাবে এখানকার জনগণ বন্য হাতির প্রতি সহনশীল ধরনেরই মনে হয়েছে।

“এরকমটা সবসময় ছিল না,” লুইটেল স্মৃতিচারণ করেন। “লোকেরা হাতিদের ঘৃণা এবং হাতিদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করার জন্যে আমাদেরকেও ঘৃণা করতো।”

Image via Nepali Times. Used with permission.

নেপালি টাইমসের মাধ্যমে আইসিআইএমওডি’র ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

তার বন্য হাতিদের শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা প্রচারণার প্রতি প্রচণ্ড প্রতিরোধ, এমনকি শারীরিক হুমকি ছিল। ফসল ও জীবিকা ধ্বংস, এমনকি মানুষকে আহত ও হত্যা করার কারণে হাতি ছিল বাহুনডাঙ্গির স্থানীয়দের চিরশত্রু।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে লুইটেলের নিরলস প্রচেষ্টায় মানুষের ধারণা পরিবর্তন হতে শুরু করে। তিনি তাদের গতিবিধি ট্র্যাক করেন, টহল সংগঠিত করেন এবং গ্রামে সম্পত্তির ক্ষতি নথিবদ্ধ করেন। আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে লুইটেল তাদের পক্ষে আবেদনপত্র লেখা থেকে শুরু করে প্রামাণিক সাক্ষ্য সংগ্রহ করা এবং দাবিগুলি নথিভুক্ত করার জন্যে পৌরসভা অফিসে যাওয়া পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলিকে ক্ষতিপূরণ দাবি করার জটিল প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করতে সাহায্য করেন।

এখানে শঙ্কর চেত্রী লুইটেলের একটি ইউটিউব ভিডিও রয়েছে:

তিনি এবং তার কয়েকজন সহকর্মীর কারণে গ্রামটি সরকার, রাজনীতিবিদ এবং গবেষকদের রাডারে ধরা পড়ে। “বাহুনডাঙ্গিতে অনেক পিএইচডি হচ্ছে,” ঝুঁকি কমানো এবং হাতিরা আক্রমণ না করা তেজপাতা ও চায়ের মতো অর্থকরী ফসল রোপণের মাধ্যমে কৃষকদের আয় বৈচিত্র্যময় করার কৌশল তৈরি করতে গবেষকদের সাহায্যকারী লুইটেল বলেছেন। “আজকাল স্থানীয়রা হাতি এবং আমাদের প্রতি আর শত্রুভাবাপন্ন নেই।”

ভারতের যে বনভূমি থেকে হাতি আসে এবং বাহুনডাঙ্গি্র ফসলের ক্ষেতের মধ্যবর্তী মেছি নদীর তীর বরাবর একটি ১৮-কিমি দীর্ঘ বৈদ্যুতিক বেষ্টনী রয়েছে। হাতিদের দূরে রাখার জন্যে নকশা করা এই বেড়া তৈরির সাথে লুইটেল জড়িত ছিলেন।

তবে তিনি স্বীকার করেন এটি একটি সাময়িক সমাধান মাত্র। অবশেষে তিনি বলেন একমাত্র উপায় হলো সহাবস্থান। তিনি মনে করেন এজন্যে সরকারকে বাহুনডাঙ্গির মানুষের সংগ্রামকে স্বীকৃতি, ভর্তুকিযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা দিতে এবং তাদের জন্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

Image via Nepali Times. Used with permission.

নেপালি টাইমসের মাধ্যমে আইসিআইএমওডি’র ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

এভাবেই স্থানীয়রা বন্য হাতিগুলিকে তাদের জীবিকার জন্যে হুমকি হিসেবে না দেখে বরং সরকার প্রদত্ত পরিষেবাগুলিকে সুরক্ষা সুবিধা হিসেবে দেখবে। এটি মাঝে মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করলেও তাদের বন্য হাতিদের ক্ষমা করা সহজ করে তুলবে। তাছাড়া হাতিগুলি এই এলাকার বাস্তুতান্ত্রিক পর্যটন বা ইকোট্যুরিজমের অংশ হতে পারে, যা বাস্তবে হাতিদের উপস্থিতি এবং চলাচলকে  তাদের আয়ের সুযোগে রূপান্তরিত করবে।

বর্তমানে মেছি পৌরসভায় একমাত্র লুইটেলই নেপাল সীমান্তের কাছে বসবাসকারী ১২টি হাতিকে শনাক্ত করতে পারেন৷ তিনি এই জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে স্থানীয়দের কাছে বিতরণের জন্যে প্রতিটি হাতির শারীরিক বৈশিষ্ট্য, অভ্যাস এবং আকারের বিশদ বিবরণসহ সচিত্র তথ্য শীট তৈরি করছেন।

Image via Nepali Times. Used with permission.

নেপালি টাইমসের মাধ্যমে আইসিআইএমওডি’র ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

এই প্রচারপত্রগুলি গ্রামবাসীদেরকে কিছু আক্রমনাত্মক হাতি এড়িয়ে যেতে এবং এদের ব্যাপারে সময়মতো অন্যদের সতর্ক করতে সনাক্ত করতে সাহায্য করে। তথ্যগুলি ভবিষ্যতের গবেষক এবং ছাত্রদের হাতি সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে। লুইটেলের ছেলে বনবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রির জন্যে পড়াশোনা করছেন। তিনি আশা করেন যে তার শিক্ষা মানুষ-হাতি সহাবস্থানে সাহায্য করবে।

বন্য হাতির সাথে বাঁচতে শেখার জন্যে শঙ্কর ছেত্রি লুইটেলের আবেগ বোঝাটা সহজ — তিনি বিশ্বাস করেন যে পৃথিবীতে সমস্ত জীবনের মূল্য সমান। তিনি এই বছরের জন্যে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্যটি তুলে ধরেছেন এবং একজন ব্যক্তি কীভাবে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে, তিনি তার প্রমাণ।

এখানে আমাদের সবার জন্যে একটি শিক্ষা রয়েছে যে কীভাবে আমাদের প্রত্যেকে জীববৈচিত্র্য ও আবাসস্থলের ক্ষতির বিশাল (!) সংকট সমাধানে সহায়তা করতে পারে। আমরা সহাবস্থান করতে পারি,এবং আমাদের অবশ্যই সেটা করতে হবে।

1 টি মন্তব্য

  • প্রসিত

    জীববৈচিত্র সংরক্ষণ অত্যন্ত দরকারি, আমাদের নিজেদের ভালোর জন্যই সমস্ত বন্যপ্রাণীদের সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .