স্পেনের যুদ্ধ সাংবাদিকতা গত ২৭ এপ্রিল তারিখে বুর্কিনা ফাসোতে যুদ্ধের সাংবাদিক ডেভিড বেরিয়েইন এবং রবার্তো ফ্রেইলকে হত্যা করায় শোক প্রকাশ করছে। সম্প্রতি তাদের বন্ধুরা এবং জাতীয় প্রেস ক্লাব দু'জনকে আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার জন্যে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা পুরষ্কার প্রদান করে তাদেরকে সম্মানিত করেছে।
বেরিয়েইন সুদান, আফগানিস্তান এবং ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ সশস্ত্র সংঘাতগুলি কাভার করতেন। এছাড়াও তিনি আর্জেন্টিনায় দুর্নীতি, মাদক পাচার এবং কলম্বিয়ার যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। সিরিয়ার আলেপ্পোতে ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজের জন্যে ফ্রেইলকে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন, যেখানে তিনি বিদ্রোহী সেনাদের রেকর্ড করতে গিয়ে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। ফ্রেইল লিবিয়া, ইরাক এবং কসোভোতেও বিভিন্ন সশস্ত্র সংঘাতকে কাভার করেন। নিহত হওয়ার সময় তারা বুর্কিনা ফাসোতে চোরা শিকার নিয়ে প্রতিবেদন করছিল।
প্রতিবেদকরা ২০১৫ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রোশ মার্ক ক্রিশ্চিয়ান কাবোরে ক্ষমতা দখলের পর থেকে জিহাদী গোষ্ঠীগুলির কারণে উত্তেজনা ও নিরাপত্তাহীনতা বৃদ্ধি পাওয়া দেশের পূর্বাঞ্চলে ধরা পড়েছিল। শুধু নাগরিক জনগণের বিরুদ্ধেই নয় সন্ত্রাসী দলগুলির মধ্যেও আক্রমণগুলি চলে। দলগুলির মধ্যে রয়েছে আল কায়েদা, ইসলাম ও মুসলমানদের সহায়তাকারী দল (জেএনআইএম), বৃহত্তর সাহারার ইসলামি রাষ্ট্র (আইএসজিএস) এবং আনসারুল ইসলাম।
এই সমস্যার সাথে যুক্ত হয়েছে জনগণের সাধারণ দারিদ্র্য যাদের ৮০%ই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং তারা প্রায়শই এই অপরাধী গোষ্ঠীগুলির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
সহিংসতার এই তরঙ্গটি আফ্রিকীয় দেশটির ভ্রমণ এবং সাংবাদিকতার কাজ করা স্বল্পসংখ্যক সাংবাদিকদের হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। একইভাবে, বুর্কিনা ফাসোর পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রতিবেদন করার সময় অনেকে আটক এবং মানহানির অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছে।
এই দুই স্পেনীয় সাংবাদিককে হত্যার জন্যে ইসলাম ও মুসলমানদের সহায়তাকারী (জেএনআইএম) গ্রুপ দায়ী বলে জানিয়েছেন স্পেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মার্গারিটা রোবলস। বেরিয়েইন ও ফ্রেইল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য, বন্যপ্রাণী বিষয়ক বেসরকারি সংস্থা চেঙ্গেটা এবং বুর্কিনা ফাসো্র সৈন্যদের তৈরি একটি যৌথ টহল দলের সঙ্গে ছিলেন। স্পেনীয় সংবাদপত্র এল পাইস (দেশ) এর তদন্ত অনুসারে, এই দলটি আল-কায়েদার একটি শিবিরের সামনে পড়ে গিয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়লে অনুপ্রবেশকারীদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
প্রথমে ফ্রেইলকে গুলি করা হলে বেরিয়েইন এবং আইরিশ বাস্তুবিদ ও চেঙ্গেটা বন্যজীবনের প্রতিষ্ঠাতা রোরি ইয়ং দুজনেই তাদের বন্ধুকে একা ফেলে যেতে চাননি। তদন্ত অনুসারে, বেরিয়াইনকে হয়তো আক্রমণ থেকে বাঁচানো সম্ভব হতো। কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত ফ্রেইলকে পরিত্যাগ করার ধারণাটি তিনি মেনে নিতে পারেন নি।
৩০ এপ্রিল, শুক্রবার, নিহত সাংবাদিকদের মরদেহ বুর্কিনা ফাসো থেকে একটি সামরিক বিমানে করে স্পেনের মাদ্রিদে পৌঁছায়।
গত এক দশকে আফ্রিকা মহাদেশে শতাধিক সাংবাদিক নিহত হওয়ার ফলে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল সাংবাদিকদের জন্যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সীমান্তবিহীন প্রতিবেদক উল্লেখ করেছে যে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হলেও সাংবাদিকতাকে অপরাধীকরণ করার ফলে সাংবাদিকদের সুরক্ষা বাড়ানো এখন একটি জরুরি কাজ।
রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারস (সীমান্তবিহীন প্রতিবেদক) এর তৈরি ২০২১ সালের বিশ্ব প্রেস স্বাধীনতা সূচক অনুসারে, আফ্রিকার দেশটিতে এবছর কেবল বেরিয়েইন ও ফ্রেইল নিহত হওয়ায় বুর্কিনা ফাসো ৩৭ তম অবস্থানে রয়েছে। বিপরীতে, সিরিয়ার মতো একটি রাষ্ট্র ১৭৩ তম, ফিলিস্তিন ১৩২ তম এবং লিবিয়া ১৬৫ তম অবস্থানে রয়েছে।
এবছর বিশ্বব্যাপী এগারো জন সাংবাদিক এবং চারজন সহযোগী নাগরিক নিহত হয়েছেন এবং আরো ৩২৪ জন সাংবাদিক, ১০২ জন নাগরিক সাংবাদিক এবং ১৩ জন সহযোগী কারাবন্দি হয়েছে।
ভয়, নির্যাতন, অপহরণ এবং মৃত্যু হলো এই পেশার কিছু কিছু পরিণতি –প্রতিবেদক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক হার্নান জিন তার ২০১৮ সালের প্রামাণ্য চিত্র “মরির পারা কনটার” (বলতে গিয়ে মৃত্যু)-এ যেমন বলেছেন। তার এই চলচ্ছিত্রে বেরিয়েইন এবং ফ্রেইল উভয়কেই দেখা গেছে। যুদ্ধের সাংবাদিক এবং ফটো সাংবাদিকরা এই পরিণতিগুলি বরণ করলেও তাদের উদ্দেশ্য থাকে সত্য প্রকাশ এবং বিশ্বকে পরিবর্তনের জন্যে লড়াই করা।
প্রামাণ্যচিত্রটিতে বেরিয়েইন তার বন্ধু ও পরিবার থেকে প্রাপ্ত ভালবাসার প্রশংসা করেছেন এবং “অবাধে” শব্দটি ব্যবহার করে এই পেশা অনুশীলনের সৌভাগ্যের উল্লেখ প্রতিবেদক যে তার সম্ভাব্য অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন তার ইঙ্গিত প্রদান করে।