সামাজিক গণমাধ্যম শাসনের নতুন বিধি প্রয়োগের বিষয়টি পাকিস্তানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। নতুন আইন অনুসারে, পাকিস্তান টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষের (পিটিএ) অনলাইনে বিষয়বস্তু অপসারণের দাবির সাথে সঙ্গতি বিধান না করা সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলি নিষেধাজ্ঞা ও জরিমানার মুখোমুখি হবে।
২০২০ সালের ২০ অক্টোবর তারিখে সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়ার পরে বেআইনী অনলাইন বিষয়বস্তু অপসারণ ও অবরোধ করার আইনটি কার্যকর হয়েছে। নভেম্বরে তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় (এমআইআইটিটি) তাদের ওয়েবসাইটে গেজেটটি আপলোড করার ফলে আইনগুলি চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়।
বিভিন্ন ডিজিটাল অধিকার কর্মী, প্রযুক্তি দৈত্য এবং ইন্টারনেট পরিষেবা সরবরাহকারীরা (আইএসপি) তাদের বিভিন্ন সুপারিশ ও শিল্পের সেরা অনুশীলনগুলির সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে নতুন আইনটিকে নিবর্তনমূলক এবং পাকিস্তানের সাইবার অপরাধ আইনের লঙ্ঘন হিসাবে নিন্দা করেছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিচ্ছিন্ন এবং সমাজের তথাকথিত নৈতিক ও ধর্মীয় নীতিবিরোধী যেকোন বিনোদন নিষিদ্ধ করা ছাড়াও সমালোচনামূলক কণ্ঠ রোধের জন্যে এক সেট বিধিবিধান আরোপের চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরে, পাকিস্তানে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে চাইলে টিকটক, পাবজি, ডেট করার অ্যাপ এবং ইউটিউব এর মতো মঞ্চগুলি পিটিএর পক্ষ থেকে বিষয়বস্তু নিষিদ্ধ করার অভিযোগ পেয়েছিল।
নতুন আইন অবৈধ অনলাইন বিষয়বস্তু সরিয়ে ফেলা ও প্রতিরোধ, ২০২০ (আরবিইউসিসি), ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের অনলাইনে ব্যক্তিগত ক্ষতি আইনটিকে প্রতিস্থাপন করেছে এবং এটা ইলেকট্রনিক অপরাধ প্রতিরোধ আইন ২০১৬ (পিইসিএ) এর ৩৭ ধারা বাস্তবায়ন নির্দেশ করার জন্যে প্রণীত হয়েছে।
আরবিইউসিসি ২০২০ অনুসারে, লোকেরা ততক্ষণ তাদের বাক স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করতে বা ডিজিটাল জগতে তথ্য ভাগাভাগি করতে পারবে যতক্ষণ না এটি “কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক সরকার বা সরকারি দপ্তরে কর্মরত ব্যক্তির সুনামের প্রতি হুমকি, ক্ষতি বা অসন্তুষ্টি” সৃষ্টি না করে। আর যদি তা করে তাহলে এটাকে ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা, সুরক্ষা এবং প্রতিরক্ষা'র জন্যে হুমকি হিসাবে বিবেচনা করে সরানো অথবা অবরুদ্ধ করা হবে। এই আইনগুলি টেলিযোগাযোগ শিল্পের নিয়ন্ত্রক পিটিএ-কে ক্ষমতা দেয় পাকিস্তান দণ্ডবিধিতে বর্ণিত শালীনতা এবং নৈতিকতার বিরুদ্ধে বিবেচিত পুরো অনলাইন ব্যবস্থাসহ যেকোন কিছু অপসারণ ও অবরুদ্ধ করার। সামাজিক গণমাধ্যম সংস্থাগুলি পিটিএ-কে একটি অসংকেতায়িত, পাঠযোগ্য এবং বোধগম্য ফর্ম্যাটে কোন তথ্য বা ডেটা সরবরাহ করতে বাধ্য থাকবে। এতে গ্রাহক তথ্য, ট্র্যাফিক, বিষয়বস্তু এবং অন্য যেকোন তথ্য বা ডেটা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
আইনগুলি পিটিএ-এর ক্ষমতাকে ইলেকট্রনিক অপরাধ দমন আইন (পিইসিএ) এর ৩৭ ধারার মূল সীমানার বাইরে আরও বেশি সম্প্রসারিত করে পিটিএকে মূল আইনে না দেওয়া এবং মূলত প্রণীত ক্ষমতার বাইরে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি সংস্থাগুলিকে নিবন্ধিত করার অধিকার দেয়। এছাড়াও ৯ ধারায় সামাজিক গণমাধ্যম সংস্থাগুলির জন্যে নতুন বাধ্যবাধকতা এবং দায়বদ্ধতা যুক্ত হয়েছে, যা পিইসিএ-তে থাকা প্রযুক্তি সংস্থাগুলির অন্তর্বর্তী দায়বদ্ধতা ব্যবস্থার পরিসীমার পরিপন্থী। আর পরিষেবা সরবরাহকারী বা সামাজিক গণমাধ্যম সংস্থাগুলি সঙ্গতি বিধান করে ২৪ ঘণ্টার অথবা জরুরী অবস্থায় ৬ ঘণ্টার মধ্যে বিষয়বস্তু সরিয়ে নিতে না পারলে তারা ৫০ কোটি রুপি (২৬ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা) পর্যন্ত জরিমানার এবং নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে পারে।
অংশীজনদের প্রতিক্রিয়া
বেসরকারি খাতের অংশীজনরা এর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একাধিক বিবৃতি ও চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে নতুন বিধি সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ নিবন্ধন করেছেন। অ্যামাজন, ফেসবুক এবং গুগলের মতো বড় প্রযুক্তি সংস্থাগুলি অন্তর্ভুক্ত একটি শিল্প সংস্থা এশিয়া ইন্টারনেট জোট (এআইসি) তার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে যে এই আইন অনুসারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংস্থাগুলির পক্ষে পাকিস্তানে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া অসুবিধাজনক হতে পারে:
কঠোর ডেটা স্থানীয়করণের প্রয়োজনীয়তা ইন্টারনেটে জনগণের বাধাহীন ও উন্মুক্ত প্রবেশাধিকারের ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং পাকিস্তানের ডিজিটাল অর্থনীতিকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সংস্থাগুলিকে গোপনীয়তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকারের নিয়মনীতি লঙ্ঘন করতে বাধ্য করার অনুমোদনের জন্যে পিটিএর ক্ষমতার সম্প্রসারণ দেখাটা ভীতিকর।
পাকিস্তানের ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানকারীদের সমিতি (ইস্পাক) তাদের কৌশলটি তৈরি হওয়ার পরে সাম্প্রতিক আইনগুলির বিরুদ্ধে আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার এবং আদালতেও এই আইনগুলিকে মোকাবেলা করার কথা বিবেচনা করছে।
ডিজিটাল অধিকার কর্মীরাও এই আইনগুলির নিন্দা করেছে এবং তারা বিশ্বাস করে যে আইনগুলি অনলাইন জগতে নাগরিকদের বাকস্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করার পাশাপাশি তাদের একটি ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে। গণতন্ত্রের জন্যে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ এই আইনটি সম্পর্কে আলোচনার একটি বিস্তারিত থ্রেড টুইট করেছে:
Here is a short analysis of some of the key concerns with specific sections of the Removal and Blocking of Online Content Rules 2020. #SocialMediaRules#PECA pic.twitter.com/rH6ggxpIzY
— Media Matters for Democracy (@mmfd_Pak) November 19, 2020
বেআইনী অনলাইন বিষয়বস্তু অপসারণ ও অবরোধ আইন ২০২০ এর নির্দিষ্ট বিভাগগুলির বিষয়ে কয়েকটি মূল উদ্বেগের একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ এখানে দেওয়া হল।
তারা সরকারকে “অবিলম্বে এই আইনগুলির বাস্তবায়ন স্থগিত করে পূর্ববর্তী পরামর্শমূলক প্রক্রিয়া সম্পর্কে উত্থাপিত উদ্বেগগুলির প্রতি বিশ্বাসযোগ্য, স্বচ্ছ, প্রতিনিধিত্বমূলক এবং প্রতিক্রিয়াশীল একটি অর্থবহ পরামর্শমূলক প্রক্রিয়া চালু করা”র আহ্বান জানিয়ে একটি বিবৃতিও জারি করেছে।
ডিজিটাল অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা মঞ্চ বোলো ভির ফারিহা আজিজ বলেছেন যে নাগরিকদের নিজেদের নিজেরাই সেন্সর করতে হবে অথবা এই আইনগুলি না মেনে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চে সম্পূর্ণরূপে প্রবেশাধিকার হারাতে হবে। অন্যদিকে, একটি বিবৃতি জারি করে ডিজিটাল অধিকার ফাউন্ডেশন জানিয়েছে যে তারা “অর্থবহ পরামর্শ ও স্বচ্ছতা ছাড়াই যে পদ্ধতি অনুসরণ করে আইনটি প্রণীত হয়েছে এবং দেশের সংবিধানিক স্বাধীনতার উপর আইনটির প্রভাব – উভয় বিষয়েই অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।” পাকিস্তানের স্বাধীন অনলাইন সাংবাদিকতার মঞ্চগুলির সমিতিও নতুন আইনটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
ই-গভর্নেন্স সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন বিশেষ সহকারী এবং ডিজিটাল পাকিস্তান ভিশন উদ্যোগের বর্তমান প্রধান তানিয়া এইড্রাস টুইট করেছেন:
Threats can never lead to sustainable outcomes. Big tech needs to invest time & resources in understanding local sensitivities & the Govt needs to be pragmatic about its demands.
We MUST get this right, else our citizens get left behind. https://t.co/5MHKXDQKPG
— Tania Aidrus (@taidrus) November 20, 2020
হুমকি কখনোই টেকসই ফলাফল বয়ে আনতে পারে না। স্থানীয় সংবেদনশীলতা বোঝার জন্য বড় বড় প্রযুক্তিকে আরো সময় ও সম্পদ বিনিয়োগ করতে হবে এবং সরকারকেও তাদের দাবির বিষয়ে বাস্তববাদী হতে হবে।
আমাদের অবশ্যই এই অধিকারটি পেতে হবে, নইলে আমাদের নাগরিকরা পিছিয়ে পড়বে।
নতুন আইনগুলি কেবল পাকিস্তানের মানবাধিকার পরিস্থিতি আরো খারাপই করবে। ফ্রিডম হাউজের ২১০টি দেশ ও অঞ্চলের রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতায় মানুষের প্রবেশাধিকারের মূল্যায়ন করা বার্ষিক বিশ্বের স্বাধীনতা প্রতিবেদন ২০২০-এ পাকিস্তান সর্বোচ্চ ১০০ নম্বরের মধ্যে ৩৮ (আংশিক মুক্ত) নম্বর পেয়েছে। ২০ অক্টোবর পালিত আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট দিবসে পাকিস্তানের ডিজিটাল অধিকার পরিস্থিতির উপর “সেন্সরশিপ বৃদ্ধি, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, ডিজিটাল নজরদারি এবং গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং অনলাইনে মিথ্যা ও ভুল তথ্য” উল্লেখ করে স্বাধীনতা নেটওয়ার্ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।