কোভিড-১৯ যুদ্ধের সময় তিউনিশিয়ায় বাক স্বাধীনতার যতো বাধা-বিপত্তি

২২ মার্চ থেকে সারা দেশ কোয়ারেন্টাইনে থাকায় কবুতরগুলি রাজধানী তিউনিসের সাধারণভাবে জনাকীর্ণ বাব ভর চত্বরটি দখল করে রেখেছে। ছবির কৃতজ্ঞতা: তিউনিসে হারিয়ে যাওয়া ব্লগ [অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত]।

কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তিউনিশিয়ায় সরকারের মহামারী মোকাবেলা নিয়ে সমালোচনাকারীদের চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এই মাসের শুরুর দিকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সহায়তা বিতরণে দুর্নীতির অভিযোগ করায় দুজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সমালোচনা করায় এক সাংবাদিককে অনলাইনে অপমান করা হয়েছে।

রাজধানী তিউনিস থেকে ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে তেবুর্বা শহরের মেয়রের বন্ধ অফিসের বাইরে সরকার প্রতিশ্রুত আর্থিক সহায়তার দাবিতে জড়ো হওয়া নাগরিকদের ভিড় ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করার একদিন পরেই ১৪ এপ্রিল, ২০২০ তারিখে ব্লগার ও স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী আনিস মাব্রুকিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

“সাহায্য নির্দিষ্ট কিছু লোকের মধ্যে এবং প্রশ্নবিদ্ধ উপায়ে বিতরণ করা হয়েছে”, ভিডিওটির সরাসরি সম্প্রচারের সময় মাব্রোকি মন্তব্য করেছিলেন

১৫ এপ্রিল তারিখে তিনি আদালতে হাজির হলে মেয়র দণ্ডবিধির যথাক্রমে ৩১৬ এবং ১২৮ ধারা অনুসারে তার বিরুদ্ধে “প্রকাশ্যে শোরগোল ও অশান্তি সৃষ্টি” এবং “দোষ প্রমাণের দলিলাদি ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তাদের চাকরি সংক্রান্ত অপরাধে অভিযুক্ত” করার অভিযোগ দায়ের করেন বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে জানিয়েছেন তার আইনজীবী। তাকে ৩০ এপ্রিল তারিখে নির্ধারিত পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে।

১২ এপ্রিল তারিখে এল-কেফ প্রদেশের (তিউনিসের ১৭৫ কিলোমিটার পশ্চিমে) শহরতলী তাজরুইনে ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেমাই বিতরণে দুর্নীতির অভিযোগ করায় এক নারী রাজনৈতিক কর্মী হাজের আউয়াদিকে কারাবন্দী করা হয়েছে। ভিডিওটিতে তিনি আরো বলেছেন যে তিনি তার মামার সাথে পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেলে তাদের উপর হামলা করা এবং গ্রেপ্তারের হুমকি দেওয়া হয়। স্থানীয় পুলিশ সেদিনই তাদের দুজনকে গ্রেপ্তার করে। পরদিন তারা আদালতে হাজির হলে দন্ডবিধির ১২৫ ধারায় “একজন সরকারি কর্মচারীকে অপমান” এবং ৩১৬ ধারায় “জনসমক্ষে শোরগোল ও ঝামেলা সৃষ্টি” করার অভিযোগ আনা হয়। তাদের প্রত্যেককে এক বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা করা হয়েছে।

“তিউনিশীয় কর্তৃপক্ষ অনলাইনের ভাষ্যকে শাস্তি প্রদান ও বিচারের জন্যে দীর্ঘকাল ধরে অস্পষ্ট একটি ফৌজদারি আইনের আশ্রয় নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর সময়েও সেটা অব্যাহত রাখা দুঃখজনক,” মানবাধিকার পর্যবেক্ষকের তিউনিস অফিসের গবেষণা দলের সদস্য নিসাফ স্লামা গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন, “জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলিতে শান্তিপূর্ণ মন্তব্য করার কারণে কর্মকর্তাদের ব্লগার ও নাগরিকদের গ্রেপ্তার করা এবং তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা থেকে বিরত থাকা উচিৎ।“

স্লামা তিউনিশিয়ার আইন প্রণেতাদেরকে “শান্তিপূর্ণ বক্তব্যকে অপরাধমূলক করে তোলার আইনগুলি সংশোধন করার” আহ্বান জানিয়েছেন।

২০১১ সাল থেকে মানবাধিকারে ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করা তিউনিশিয়ার তালিকায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধতা করার মতো আন্তর্জাতিক মান লঙ্ঘনকারী বেশ কয়েকটি আইন রয়েছে।

টেলিযোগাযোগ বিধির ৮৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে কেউ “জনযোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অন্যের ক্ষতি বা তাদের জীবন বিঘ্নিত করার” জন্যে দোষী সাব্যস্ত হলে তার দুই বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। দণ্ডবিধিটির মধ্যে মানহানি এবং “জনশৃঙ্খলা বা ভাল নৈতিকতার ক্ষতি সাধনের জন্যে দায়ী” বিষয়বস্তু ছড়িয়ে দেওয়াকে অপরাধমূলক করে তোলার সুযোগ রয়েছে।

সাংবাদিককে লক্ষ্য করে অনলাইন প্রচারণা

স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল্লাতিফ মেক্কির সমালোচনা করার পরে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভাষ্যকার খলিফা চৌচেনেকে সম্প্রতি একটি অনলাইন হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।

৯ এপ্রিল জাতীয় রেডিওতে “আলবিলাদ আলিয়ম (আজকের দেশ)” শিরোনামের একটি রেডিও প্রচারণায় চৌচেনি সরকারি সদস্যদের হাসপাতাল ও কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রগুলি পরিদর্শনের সময় মুখোশ পরা এবং এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখার মতো কোভিড-১৯ স্বাস্থ্য ও সুরক্ষাবিধির প্রতি সম্মানের অভাবের সমালোচনা করেছিলেন। “তাদের কম কান্নাকাটি করা উচিৎ কারণ, করোনা ভাইরাস মন্ত্রীর অশ্রু কিংবা মানবিক অনুভূতি কোন কিছুকেই চেনে না, এটি কেবল সরেজমিন বাস্তব ও ব্যবহারিক পদক্ষেপগুলিকেই চেনে,” তিনি বলেছিলেন। ৭ এপ্রিল তারিখে ২২ মার্চ থেকে দেশে বিরাজমান সাধারণ স্বাস্থ্য পদক্ষেপ কোয়ারেন্টাইনের প্রতি সম্মান জানানোর আহ্বান জানিয়ে জনগণের উদ্দেশে বক্তৃতা দেওয়ার সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মক্কি কান্নাকাটি করেছিলেন

চৌচেনে তার ভাষ্য শেষ করার পরে  অন্য সাংবাদিক আয়োজিত একই প্রচারণায় মেক্কি প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকারের জন্যে অনুরোধ করেছিলেন। তিনি চৌচেনকে তার প্রতি ”কটূক্তি” করা এবং “তিনি যেসব বিষয় মূল্যায়ন করার যোগ্য নন সেসব বিষয় মূল্যায়ন করতে যাওয়ার জন্যে” সমালোচনা করেছিলেন।“ “আপনি আমাদের সমালোচনা করার মতো দক্ষ নন,” মন্তব্যকারীকে উল্লেখ করে মেক্কি বলেছিলেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্ত্রীর কিছু কিছু সমর্থক ফেসবুকে সাংবাদিক এবং সাধারণভাবে গণযোগাযোগ মাধ্যম খাতকে আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে। একজন লিখেছেন যে “লজ্জার এই গণযোগাযোগ মাধ্যমটিকে শুধু ধ্বংস করে দেওয়াই উচিৎ।” অন্য একজন লিখেছেন  যে তিনি “ভয় বা কলহের ছড়ানো, এমনকি স্বাস্থ্য পেশাজীবিদের প্রচেষ্টা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করা [গণযোগাযোগ মাধ্যম] সদর দপ্তর জ্বালিয়ে দেওয়া এবং গণযোগাযোগ মাধ্যম সংস্থাগুলিতে কর্মরত সবার ফাঁসি দেওয়া” সমর্থন করেন।

১০ এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত একটি বিবৃতিতে তিউনিশীয় সাংবাদিকদের জাতীয় সিন্ডিকেট (এসএনজেটি) মন্ত্রীর “দেশ করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে বলে গণযোগাযোগ মাধ্যমের সমালোচনা প্রত্যাখ্যানের” প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে অনলাইন প্রচারটিটির নিন্দা জানিয়েছে।

وتذكر النقابة الوزير بالدور الأساسي الذي يعلبه الصحفيون في مسار التوعية وإصلاح الخطة الوطنية لمكافحة فيروس عبر نقد النقائص التي تخللت بعض الإجراءات التي تم اتخاذها

এই সিন্ডিকেট সচেতনতা বাড়ানো এবং ঘাটতিগুলির সমালোচনা করে ভাইরাসটি প্রতিরোধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে জাতীয় পরিকল্পনা সংস্কারে সাংবাদিকদের নেওয়া ভূমিকা সম্পর্কে মন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

‘সমালোচনা থেকে রেহাই নেই’

২৪ এপ্রিল তারিখে গ্লোবাল ভয়েসেসে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিউনিশিয়ার প্রদায়ক সৌসেন বেন শিখ লিখেছেন যে কোভিড-১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার রাজনীতিবিদ এবং কিছু গণমাধ্যমের নিযুক্ত যুদ্ধংদেহী বাগাড়ম্বর নাগরিকদের মধ্যে আবেগের আতিশয্য, ভয় এবং মেরুকরণ ছড়িয়ে দিয়েছে।”

তিনি আরো বলেছেন:

যুদ্ধের এই বিবরণটি শক্তিশালী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নেতাদের পেছনে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার মতো  ‘পতাকার চারপাশে সমাবেশে’র একটি আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে।

এই পরিবেশে দেশটি কথিত “যুদ্ধে” রয়েছে বলে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা সহ্য করা হয় না। ফলে নোভেল করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া এবং পদক্ষেপগুলি নিয়ে প্রশ্ন তোলা সাংবাদিক এবং ব্লগারদেরকে তাদের ”দেশপ্রেম” বা ”দক্ষতা”র অভাব থাকার অজুহাতে অথবা মাব্রুক ও আউয়াদির ক্ষেত্রে ” জনগণের মধ্যে শোরগোল ও ঝামেলা “সৃষ্টির অভিযোগ আনার মতো করে নীরব করার চেষ্টা করা হতে পারে।

“কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমালোচনা থেকে মুক্ত নয় এবং বিশেষত কোন সংকটের সময় তো নয়ই,’’ মানবাধিকার পর্যবেক্ষকের স্লামা বলেছেন।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .