বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে মন্তব্যের জেরে বাউলশিল্পীকে গ্রেফতার করলো পুলিশ

বাউলশিল্পী শরিয়ত সরকারের মুক্তির দাবিতে ঢাকার শাহবাগে মানববন্ধন করছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ছবিটি উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’র ফেইসবুক পেইজ থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে জনপ্রিয় বাউলশিল্পী শরিয়ত সরকারকে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারা লংঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে এক গানের অনুষ্ঠানে একপর্যায়ে আলেমদের সমালোচনা করে বলেন, কুরআনে কোথাও গান-বাজনা নিষেধ করা হয় নি। এমন কি কেউ তা প্রমাণ করতে পারলে ৫০ লাখ টাকা দেয়ার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাউল শরিয়ত সরকারকে আটক করা হয়েছে।

সেইদিনের গানের অনুষ্ঠানের ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করা হলে, সেটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। এ নিয়ে হইচই শুরু হলে ভিডিওটি সরানো হয়। যদিও অন্যরা ভিডিওটি পুনরায় আপলোড করেছে।

ইসলাম, নবী এবং কুরআনা নিয়ে কটুক্তি করার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন আলেমরা। গত ৯ জানুয়ারি টাঙ্গাইল জেলার একজন মাওলানা ইসলাম নিয়ে “কুরুচিপূর্ণ” মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলা হওয়ার পর পুলিশ তাকে আটক করে।

শরিয়ত সরকারকে আটক করার পর পুলিশ রিমান্ডে চাইলে আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এই প্রতিবেদন লেখার সময়েও তার জামিন হয়নি।

ইসলামে কি গানবাজনা নিষিদ্ধ?

ইসলাম গানবাজনাকে অনুমোদন করে কীনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকভাবেই বিতর্ক চালু রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এর অনুশীলনও ভিন্ন ভিন্ন রকম দেখা যায়। বিখ্যাত মুসলিম মণীষী ইমাম আল গাজ্জালি ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে গানবাজনা অনুমোদিত বলে জানিয়েছিলেন। যদিও সালাফি এবং ওয়াহাবি গ্রুপে কিছু আলেমরা কুরআনের কিছু আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে গানবাজনা হারাম বলে উল্লেখ করেছেন।

বাউল কারা?

বাউল একটি বিশেষ লোকাচার ও ধর্মমত। গান নিয়ে যাদের রয়েছে বিশেষ ঐতিহ্য। তবে, তাদের মধ্যে রয়েছে বহু পথ, বহু মত। যদিও, বাউলদের বেশিরভাগই বৈষ্ণবধর্ম এবং সূফীবাদে বিশ্বাসী। বাউলরা যে গান করেন, তাকে বাউল গান বলে। এটি লোকসংগীতের অংশবিশেষ। বাউল গানে দর্শন, ভক্তিবাদ এবং স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার রূপ প্রকাশ পায়।

বাউল শরিয়ত সরকার যে গান করেন, তা সুফি ঘরানার অন্তভৃর্ক্ত। বাংলাদেশে সুফি ঘরানার ইতিহাস অনেক পুরোনো।

আটকের নিন্দা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাউল শিল্পীকে আটক করায় দেশটির প্রগতিশীল মানুষজন ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তার মুক্তির দাবিতে বিভিন্ন শিল্পী সংগঠনের পক্ষ থেকে মানব বন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। তাছাড়া মুক্তির দাবিতে শিল্পী-সাহিত্যিকদের কেউ কেউ স্বেচ্ছা কারাবরণের ঘোষণাও দিয়েছেন।

তরুণ লেখক স্বকৃত নোমান রক্ষণশীল মোল্লা-মৌলভীদের কথায় গ্রেফতার করা অন্যায় হয়েছে জানিয়ে ইসলাম ধর্মের আধ্যাত্মিক নিয়ে লিখেন:

শরিয়ত বয়াতির পুরো ভিডিও ক্লিপটি শুনেছি। তিনি কোথাও ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। তিনি কোথাও আপত্তিকর কিছু বলেননি। তিনি ধর্মের নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে বলেছেন, ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে বলেছেন। তার কথা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে ইসলামের অধ্যাত্মিক দিকটিকে। শাস্ত্রের পাশাপাশি ইসলামে অধ্যাত্মও স্বীকৃত। বুঝতে হবে বহুধা বিভক্ত ইসলামকে। শরিয়ত বয়াতিরা ইসলামের অধ্যাত্ম ধারার অনুসারী। তাকে শাস্ত্র দিয়ে বিচার করাটা মূর্খতা। রক্ষণশীল মোল্লা-মৌলবিদের কথায় তাকে গ্রেপ্তার করাটা অন্যায়।

গান-বাজনা হারাম হয়ে থাকলেও বাউল শিল্পীকে আটক করা ঠিক হয় নি এমনটাই মনে করেন সাংবাদিক কবির য়াহমদ:

কোন মানদণ্ডের ভিত্তি বয়াতির বক্তব্য আপত্তিকর তাই জানতে চেয়েছেন লেখক, সাংবাদিক রাজু আলাউদ্দিন:

শরিয়ত বয়াতির কথাটা কী কারণে আপত্তিকর , সেটা কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে আপত্তিকর বা কুরুচিপূর্ণ তার কোনোই ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, এখন হাজতে তিনি। হায়, অন্ধকারে নিমজ্জিত আমার স্বদেশ!

সাংবাদিক এবং উন্নয়নকর্মী শরিফুল হাসান দেশটির আলেম সম্প্রদায়কে মামলা করার পরিবর্তে বয়াতির চ্যালেঞ্জ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন:

শরিয়ত সরকারকে আটকরা করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দু’ভাগে বিভক্ত। অনেক নেটিজেনই গান-বাজনা হারামের রেফারেন্স হিসেবে সুরা লোকমানের কয়েকটি আয়াত এবং কয়েকটি হাদিসের কথা উল্লেখ করেছেন।

বাংলাদেশে চ্যালেঞ্জের মুখে সুফি ঘরানা

মূলত সুফিদের হাত ধরেই বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম এসেছে। সুফিবাদের উদার নীতিও এদেশের মিশ্র সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের মানুষের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ফলে এদেশের মানুষ আগে কখনো ধর্মের সাথে সংস্কৃতিকে মেলায়নি। যদিও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সুফিবাদ নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। রক্ষণশীল মুসলিমরা সুফিদের ‘মূল ধারার ইসলাম থেকে বিচ্যূত’, বলে মনে করেন। বাংলা একাডেমির লোকসংগীত বিষয়ক গবেষক সাইমন জাকারিয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন:

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী ব্যাপক ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে, আমাদের সাংস্কৃতিক মনস্তত্ব পরিবর্তিত হয়ে গেছে, আমাদের শিক্ষায় ও প্রশাসনে এসব বিষয় প্রাধান্য পাচ্ছে।

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

২০১৮ সালে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয়। এই আইনে অনলাইনে দেয়া বক্তব্য, মানহানিকর কথা থেকে শুরু করে ‘ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত” এমন বক্তব্যকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়েছে:

যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করিবার বা উস্কানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যাহা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর আঘাত করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ।

শুরু থেকেই এই আইনের নানা দিক ও এর অপব্যবহার নিয়ে সাংবাদিক এবং অ্যাক্টিভিস্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন। এই আইনের আওতায় ইতোমধ্যে লেখক, কবি এবং অ্যাক্টিভিস্টদের গ্রেফতার করা হয়েছে। শরিয়ত সরকারকেে আটকের ঘটনায় আবার অনেকেই এই বিতর্কিত আইনের বাতিল দাবি করছেন।

হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ নামের মানবাধিকার কর্মীদের নতুন সংগঠনটি শরিয়ত সরকারের আটকের নিন্দা এবং তার দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়েছে।

উল্লেখ্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে বাউল শরিয়ত সরকারের ৩-৭ বছরের জেল হতে পারে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .