বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো মায়ের বুকের দুধ সংরক্ষণের জন্য হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের (মায়ের বুকের দুধের আঁধার) স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঢাকার মাতুয়াইলের শিশু এবং মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট নামের একটি হাসপাতাল এই উদ্যোগ নিয়েছে।
যেসব বাচ্চার মা মারা যায়, যেসব বাচ্চার দত্তক নেয়া হয়, বা যারা গুরুতর অসুস্থ তাদের বুকের দুধের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করেই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই মিল্ক ব্যাংকে যারা দুধ দান করবেন তাড়া কোন অর্থ পাবেন না, এবং যেসব বাচ্চাদের দুধ প্রয়োজন হবে তাড়া বিনামূল্যেই পাবে।
তবে এই মিল্ক ব্যাংকটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন কিছু ধর্মীয় সংগঠন এবং ধার্মিক ব্যাক্তির বিরোধীতায় পিছিয়ে গেছে।
নবজাতকের জন্য বুকের দুধ কেন গুরুত্বপূর্ণ
একজন নবজাতকের জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। বাস্তবতা হ'ল কিছু শিশু তাদের মায়ের দুধ পান করতে পারে না। বুকের দুধ খাওয়ানো যায় না বলেই কেবল অনেক শিশু মারা যায়। বেঁচে থাকলেও সারাজীবনের জন্য অপুষ্টিতে ভোগে, কেউ কেউ প্রতিবন্ধী হিসেবে বেড়ে ওঠে।
অনেক শিশু মায়ের দুধ ব্যতীত পর্যাপ্ত পরিমাণে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে না। কিছু নবজাতক, যারা গরুর দুধ বা ফরমুলা মিল্ক হজম করতে তাদের জন্যে এই মিল্ক ব্যাংক অতি প্রয়োজনীয় মায়ের দুধ পেতে সহায়তা করবে।
ডিসেম্বরের ১ তারিখে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করার কথা থাকলেও কিছু ধর্মীয় সংস্থা এবং ব্যক্তিরা এ উদ্যোগকে ইসলামবিরোধী বলে বিবেচনা করে তাদের আপত্তি জানানোর পরে তা স্থগিত করা হয়েছিল।
তাহলে কেন এর বিরোধীতা?
তাফসির পরিষদ নামে একটি ধর্মীয় সংগঠনের দাবি হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের মাধ্যমে বহু অজানা দুধ ভাই-বোন হবে যাদের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক হবে হারাম।
ইসলামে শিশুকে অন্য মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই বরং বলা হয়েছে ২ বছর পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়াতে। সমস্যা হলো, ইসলামে দুধ মা সম্পর্কটা অনেকটা রক্ত সম্পর্কের মতোই। দুধ মা এবং সেই মায়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন হারাম। মায়ের বুকের দুধ সংরক্ষণের মিল্ক ব্যাংক হলে, কোন নবজাতক কোন মায়ের দুধ খেলো, সেটা হিসাব রাখা মুশকিল বলে অনেকেই মনে করছেন। এজন্য তারা এই উদ্যোগের বিরোধীতা করছেন।
ইসলামের বিধিবিধান থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সাইফুল আলম টুইট করে মিল্ক ব্যাংক উদ্যোগ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন :
✒ রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে যেসব স্বজনেরা (বিয়ের জন্য) হারাম তদ্রুপ দুধপাণের সম্পর্কের ভিত্তিতে তারা হারাম #বুখারী ও #মুসলীম।
✒ তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ (বিয়ের জন্য) তোমাদের দুধমাতা ও দুধবোন – সূরা : নিসা -২৩|
অবিলম্বে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বন্ধের আহ্বান জানাই ? pic.twitter.com/3gZUSfFyNi— syful alam001? (@DrSyful) December 23, 2019
মামুনুর রশীদও হারামের ঝুঁকি না নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন:
যাদের মাঝে বিবাহ হারাম তাদের মাঝে অন্যতম দুধ ভাই বোন। আর মিল্ক ব্যাংক থেকে দুধ পান করা হলে আপনি জানবেন না যার সাথে বিবাহ হচ্ছে সেও একই মায়ের দুধ পান করেছেন কিনা। হারামের ঝুকি থেকেই যায়, আর হারামের ঝুকি থাকলে সেইদিকে না যাওয়াই উত্তম
— Mamunur Rashid (@SMM_Rashid) December 25, 2019
দেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতোমধ্যে হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বন্ধ করার জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইনী নোটিশ পাঠিয়েছেন, অন্য মায়ের সন্তানকে দুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত ও ধর্মীয় জটিলতার কথা উল্লেখ করেছেন।
এদিকে দুধ ভাই বোনের মধ্যে বিয়ে হওয়ার আশংকা থাকবে না বলে জানিয়েছেন হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. মজিবুর রহমান। বুকের দুধ দাতা-গ্রহণকারী নাম-পরিচয় সংরক্ষণ করে রাখা হবে জানিয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন:
প্রত্যেকের জন্য আলাদা ডাটা, আলাদা আইডি কার্ড রাখা হবে। যিনি দান করবেন এবং যিনি গ্রহণ করবেন, তাদের দুজনের কাছেই পরিচয়পত্র থাকবে। এখানে প্রত্যেক মায়ের দুধ আলাদা কৌটায় রাখা হবে, যেসব শিশুকে আরেক মায়ের দুধ খাওয়ানো হবে, তাদের দুই পক্ষকেই আইডি কার্ড দেওয়া হবে। রেফারেন্স নম্বর-রেজিস্ট্রেশন নম্বর, খাতা ও ভলিউম, এন্ট্রি পৃষ্ঠার নম্বর, সবই তাদের দেওয়া হবে।
হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক সব সাধারণ শিশুর জন্য উন্মুক্ত নয়। যেসব শিশুর জীবন ঝুঁকিপূর্ণ, তাদের জীবন বাঁচানোর জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বিবাহের মতো সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি কোনো প্রভাব ফেলবে না।
ইসলাম ধর্মে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর দিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া যথাযথ ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করা হবে বলে এর উদ্যোক্তারা নিশ্চিত করেছেন।
সংকটে বুকের দুধ পাওয়া দুষ্কর
বাংলাদেশে মাতৃহীন নবজাতকদের জীবন বাঁচানোর জন্য বুকের দুধ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। আবার গোঁড়া মানসিকতার জন্যে অনেকে অন্যের সন্তানদের বুকের দুধ দিতে চান না। তুলি সংগীতা নিজের ছোটবেলায় এমন একটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তার পাশের বাসার আন্টি সময়ের আগেই যমজ শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন। সে সময়ে মায়ের বুকের দুধও তৈরি হয়নি এবং দুধ না পেয়ে একটি বাচ্চা মারা যায়। প্রয়োজন হয়েছিল অন্য মায়েদের সহায়তার। সেই ঘটনার উল্লেখ করে তুলি সংগীতা লিখেছেন:
আমার মা পুরো হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে অন্য মায়েদের সহায়তা চেয়ে বেরিয়েছেন, যদি একটুখানি মায়ের দুধ পান ছোট্ট বাচ্চাটার জন্য। কেউই খুব একটা রাজী ছিলেন না অন্যদের সন্তানকে একটুখানি বুকের দুধ দিতে!!
অবশেষে দুজন মাকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো যারা এক কোলে নিজের সন্তান আর আরেক কোলে ওই আন্টির সন্তানকে মাতৃস্নেহের ভাগ দিতে রাজী হয়েছিলেন। সারাজীবন এই দুজনের জন্য মনে মনে আনত শ্রদ্ধা পুষে এসেছি।
শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ অনেক ভালো করছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের নবজাতকের মৃত্যুর হার অনেক বেশি। প্রতি বছর জন্মের পর ৬২ হাজার নবজাতক মারা যায়। এসব শিশুর মৃত্যু হয় জীবনের প্রথম মাসে এবং অর্ধেকই মারা যায় পৃথিবীতে আসার দিনই। অপরিণত অবস্থায় জন্ম, সংক্রমণ এবং শ্বাসকষ্টের মতো ডেলিভারিকেন্দ্রিক জটিলতার কারণে নবজাতকদের মৃত্যু হয়ে থাকে। তাছাড়া সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে প্রতিবছর ৫ হাজার ২০০ জন নারীর মৃত্যু হয়।
তবে, শিশুর জন্মের একঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো গেলে এই মৃত্যু অনেকটা কমানো সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ।
শিশু এবং মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট এর এই হিউম্যান মিল্ক ব্যাংকর দুধ আপাতত সমস্ত নবজাতকের জন্য পাওয়া যাবে না – যেসব শিশু গুরুতর ভাবে অসুস্থ এবং মায়ের দুধ না পেলে মারা যাবে কেবল তাদের জন্যই।
ইংরেজি দৈনিক দ্যা সানে এক উপসম্পাদকীয়তে জয়নব তাবাসসুম বানু সোনালী আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যেসব মায়েরা পূর্ণকালীন চাকরি করার সময় তাদের বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য অসুবিধায় পরছেন এমন মায়েদের সহায়তা করার জন্যও অনুরূপ দুধ ব্যাংক স্থাপন করা হবে ভবিষ্যতে।
ইরান, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশ হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক বা অনুরূপ সাপোর্ট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেছে। সেসব দেশ কীভাবে এইসব উদ্যোগগুলো পরিচালনা করছে – যা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও গ্রহণযোগ্য, সেগুলো দেখার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে যা বাংলাদেশে গ্রহণ করা যেতে পারে।