নির্যাতনের শিকার হয়ে সৌদি থেকে দেশে ফিরছেন নারী শ্রমিকরা

সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকায় মানববন্ধন। ছবি তুলেছেন একরামুল হক। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

সাধ ছিল একটু ভালোভাবে বাঁচবেন। পরিবারের মানুষদেরও ভালো রাখবেন। সেই আশায় দালালদের টাকা দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন সৌদি আরবে। গৃহকর্মীর চাকরি নিয়ে। কিন্তু সেই স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ তো হয়েছেই, উল্টো জুটেছে যৌন হেনস্তা-সহ নানা ধরনের নির্যাতন। বাধ্য হয়ে তারা মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এ বছরে এখন পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন ৯০০ জন নারী শ্রমিক। আর গত চার বছরে দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকের সংখ্যা ৬ হাজারের উপরে।

শুধু যে শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাই নয়। নির্যাতেনের শিকার হয়ে গত নয় মাসে মধ্যপ্রাচ্যে মারা গেছেন ১১১ জন মারা গেছেন যার মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৩৬ জন।

গত কয়েক বছর সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীদের উপর নির্যাতনের বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে

সম্প্রতি এক ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে সৌদিতে এক বাংলাদেশী নারী শ্রমিক টয়লেটের ভেতরে লুকিয়ে তাকে রক্ষা করা ও দেশে ফেরানোর আকুল আবেদন জানিয়ে গেছেন।

২৫ বছর বয়সী সুমি আখতার ভিডিওতে জানিয়েছেন যে তাকে তার মালিকের লোক শারীরিক ও যৌন-হেনস্তা করেছে। এমনকি তার হাতে গরম তেলও ঢেলে দিয়েছে। তাকে ১৫ দিন বন্দী করে রাখা হয়েছিল এবং তাকে খেতেও দেয়া হয়েছে সামান্য।

দেশে ফিরে আরেকজন নারী কর্মী জানিয়েছেন, তিনি সেখানে কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন:

[…] যাওয়ার পর প্রথমে আমাকে এক মালিকের কাছে বিক্রি করা হয়৷ মালিকের অত্যাচারে ঐ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই৷ তখন আমারে ধরে একটা কোম্পানির মাধ্যমে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়৷ আমার মতো আরও কয়েকশ’ মেয়ে আছে সেখানে৷ তাদের দিয়ে জোর করে দেহব্যবসা করানো হয়৷ আমি একবার সুযোগ বুঝে আমার স্বামীকে ফোন করে সব বলি৷ তারপর আমাকে সৌদি আরবে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে উদ্ধার করা হয়৷

বাংলাদেশে অভিবাসন শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা হিসেবে পরিচিত ব্র্যাক। তারা সৌদি আরবে বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের নিয়ে একটি ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছে। সেখানে তারা কী ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন, সেটা উঠে এসেছে:

নির্যাতিতদের প্রতিকার পাবার একটিই উপায় থাকে সেটা হচ্ছে পুলিশে অভিযোগ জানানো যদিও ভাষার সমস্যা একটা বড় সমস্যা। সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন যে নির্যাতনের শিকার নারীরা এতোটাই ট্রমার মধ্যে থাকেন, যে তারা দ্রুত বাড়ি ফিরতে চান। কোনো ধরনের মামলা মোকদ্দমার মধ্যে যেতে চান না। এজন্য নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। তবে তারা এইসব ঘটনা সৌদি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন।

সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো, যেভাবে শুরু

স্বাধীনতার পর থেকে বিপুল সংখ্যক পুরুষ কর্মী ভাগ্যান্বেষণে সৌদি আরবে গিয়েছেন। তবে, নারী কর্মী যাওয়ার ইতিহাস বেশির দিনের নয়। বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে ২০১৫ সালে সৌদি আরব বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি করে। এরপরেই বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী যাওয়া শুরু করে। বর্তমানে সৌদি আরবে দুই লাখের বেশী বাংলাদেশি নারী কর্মী কর্মরত রয়েছেন।

সৌদি আরবে কর্মরত ৯০ লাখ বিদেশী শ্রমিকদের উপর শারীরিক নির্যাতনের বহু ঘটনা জনসমক্ষে এসেছে বিগত দশকে। এর আগে ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন থেকে নারী গৃহকর্মীরা সৌদি আরব যেতেন। ২০১৫ সালে শারীরিক নির্যাতনের কারণ দেখিয়ে ইন্দোনেশিয়া সৌদি আরবে নারী কর্মীদের পাঠানো বন্ধ করে। তারও আগে ফিলিপাইন্সশ্রীলঙ্কা একই কারণে সৌদিতে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। উল্লেখ্য, ২০০৮ সাল থেকে সৌদি শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য বন্ধ ছিল। ২০১৫ সালে সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে একজন নারী কর্মীর সাথে দু’জন পুরুষ কর্মী নেয়ার প্রস্তাব দেয়। তাই, সরকার সৌদি প্রস্তাবে রাজি হয়ে নারী কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। এমনকি সরকার মাসিক ৮০০ রিয়েল বেতনেও রাজি হয়ে যায় যা ফিলিপিনো বা শ্রীলঙ্কার গৃহকর্মীরা যা পেত তার থেকে অনেক কম।

সৌদি গ্যাজেটের এক রিপোর্ট অনুযায়ী সৌদিতে বাংলাদেশী নারী গৃহকর্মীদের বেশ চাহিদা রয়েছে কারণ তাদের পেছনে নিয়োগকর্তাদের কম টাকা খরচ করতে হয়।

নারী শ্রমিক যেতে বাঁধা দিবে না সরকার

নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ায় দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নামে নারীদের সৌদি আরবে পাঠানোর নিন্দা জানিয়েছেন সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

বিদেশে জনশক্তি রফতানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উপর বড় ভাবে নির্ভর করছে অর্থনীতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিদেশে জনশক্তি রফতানি আমাদের অর্থনীতিতে বড় আবদান রাখে বলেই কি আমরা আমাদের নারীদের এভাবে হায়েনার সামনে পাঠিয়ে চুপচাপ থাকব? জাতির কাছে প্রশ্ন – নির্যাতনের শিকার নারী শ্রমিকদের আইনগত অধিকার কী এবং কোন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে তারা নিজেকে সামাল দেবে, নিজের অধিকার রক্ষা করবে, ন্যায়বিচার পাবে?

মুনতাহা জাহান টুইট করেছেন:

সরকার কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা জানতে চেয়েছেন ডা. এম আর করিম রেজা:

প্রতিবাদ সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার সৌদি আরবে নারী শ্রমিক যেতে বাধা দিবে না। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি এমনটাই জানিয়েছেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও একই মত বলে জানতে পেরেছেন সাংবাদিক ইশরাত জাহান উর্মি। তিনি ফেইসবুকে লিখেছেন:

## [..] আজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, লাখ লাখ নারী যাচ্ছে তার মধ্যে কয়জন নির্যাতিত হচ্ছে যে বাজার বন্ধ করতে হবে? পার্সেন্টেজ কত?

## বেশিরভাগ মৃত নারীর ক্ষেত্রে বলা হয় স্ট্রোক বা আত্মহত্যা, এরপরে আর কোনও অনুসন্ধান হয় না। সৌদীরা সবরকম আইনের ঊর্ধ্বে।

## একজন নারী গৃহকর্মী নিতে সৌদীরা খরচ করে ১ লাখ ৭০,০০০ টাকা। এবং তারপর তারা মনেই করে টাকা দিয়ে দাসী কেনা হয়েছে যার সাথে যা খুশী তাই করা যায়।

## ফিরে আসার পর এইসব মেয়েদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আর গ্রহন করতে চায় না পরিবার। এ বছরই ব্র্যাক তাদের সেফ হোম এর মাধ্যমে ১৩০০র বেশি নারীকে সবরকম সহায়তা দিয়েছে।

## এ সবের বাইরে আছে আমাদের সুবিধাবাদী সমাজ। [..] এইসব ফইন্নিদের লোভ বেশি, তাদের এতো নাকেকান্না মানায় না-এইরকম ভাবা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম না।

এবং এই সবকিছুর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমরা চাইবো সৌদিতে আপাতত নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হোক। এই আওয়াজে কতটুকু কাজ হবে জানি না। কিন্তু আওয়াজ না তুলে আমরা আর কি করতে পারি?

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .