বেলারুশ নিয়ে তিনটি সরল প্রশ্ন

”সমৃদ্ধ হোক বেলারুশ!” দেশটির জাতীয় সঙ্গীতের একটি লাইন লেখা পোস্টার। মিনস্ক ২০১৭। ছবিটি তুলেছেন ম্যাক্সিম এডওয়ার্ড।

”বেলারুশানদের সম্পর্কে যাই বলুন না কেন, কোনোটাই সত্যি না।” এই প্রবাদটা আসলে আমার দেশের জন্য। আর যখন বিদেশিরা আমাদের নিয়ে কথা বলে, সেটা তো আরো মিথ্যে। কেননা, অনুমান ও কল্পনার মিশেলে আলোচনা তাদের। ইউরোপের দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি দেশ বেলারুশকে নিয়ে তারা সমালোচনা করে। এইসব শ্রুতি দূর করার উপায় হলো- প্রশ্ন করা। আবার যে প্রশ্নগুলো প্রায়ই আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, সেটাও বেলারুশ সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতার স্তরকে ফুটিয়ে তোলে।

আমার প্রচেষ্টা থাকবে শুধু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া না; অন্যরা কীভাবে আমাদের দেখে এবং আমরা কীভাবে আমাদের দেখি- সে সম্পর্কেও বলার চেষ্টা করব।

প্রশ্ন ১. তো, আপনারা কী রাশিয়ার অংশ?

বাগ নদীর পশ্চিম তীরে থাকা অনেক চেনাপরিচিতরা (আমরা বেলারুশানরা এভাবেই পশ্চিমাদের চিনি) আসলে জানেই না বেলারুশ বলে কোনো দেশ আছে। যদি তারা কিছু জানে, সেটাI বিন্দুমাত্র। আপনি যদি আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমাদের দেশের মানচিত্র ম্যাপে খুঁজে পান, তাহলে এই অংশটি না পড়লেও চলবে কিংবা আবার পড়ে আপনার বন্ধুদের জানাতে পারেন, যারা নিজেদের ইউরোপের ভূগোল জ্ঞান নিয়ে অতি উৎসাহী।

কেন অল্প সংখ্যক ব্যক্তিরা কেবল বেলারুশ সম্পর্কে জানে? এই প্রেক্ষিতে প্রথমেই বলা যেতে পারে, কোনো কিছু আগ্রহ নিয়ে জানার প্রতি মানুষের অলসতা আছে। এর সাথে আরো একটি ব্যাপার আছে, তা হলো- বিশাল একটা অঞ্চলের সার্বিক বাস্তবতা ও জটিলতা নির্দ্বিধায়”পোস্ট সোভিয়েতের অংশ” হিসেবে ইউরোপ ও ইউএস মনে করা। এই ধারণার প্রমাণ এই যে, সবাই ভাবে ইউরোপ ও চীনের মধ্যে যারই অবস্থান সেটা হবে “রাশিয়ানদের”। দ্বিতীয়ত, এই মারাত্মক ভুল ধারণার জন্য জন্ম নিয়েছে “বেলারুশিয়ান” শব্দটি। শব্দটি ইংরেজ ও রাশিয়ানদের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এই শব্দটি একেবারে সেকেলে আর বিদেশি ভাষাগুলোতে অর্থ দাঁড়া ”শ্বেত রাশিয়া”। কিন্তু আমরা শ্বেত রাশিয়ান না! আমরা বেলারুশিয়ান বা বেলারুশান। (লেখক ব্যবহার করেছেন বেলারুশান, যা আমেরিকান বেলারুশানরা এবং অ্যাক্টিভিস্টরা ব্যবহার করে থাকে — সম্পাদক )

প্রশ্ন ২. কিন্তু আমি যে ইন্টারনেটে গুগল ট্রান্সলেটে খুঁজলাম, সেখানে তো দেশটির নাম একেক রকম আসছে…

রাশিয়ান ভিত্তিক ইন্টারনেট সার্চে ”বেলোরাশিয়া” ও ”বেলারুশ” (রুশ ভাষায় Белоруссия এবং Беларусь) এই শব্দের পার্থক্যের ভেতরে আছে যুদ্ধবাজদের নিজেদের মধ্যকার আদর্শিক দ্বন্দ্ব। বিষয়টিকে অযথা অতিরঞ্জিত না করে – এর পেছনে রয়েছে লক্ষ লক্ষ যুক্তি ও আপত্তিকর সব ব্যাখা। সবশেষে আসলে বিষয়টিকে শুধু এই দুইটি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।

এর প্রথম জোরালো যুক্তি হলো- কয়েকটি রাশিয়ান অভিধানে ”বেলোরাশিয়া” শব্দটির ব্যবহার আছে। দ্বিতীয়ত, দেশটির প্রাচীন ভূখণ্ডের বেলারুশিয়ান ভাষায় আছে “বেলারুশ” শব্দটি। যারা ”বেলোরুশিয়ান” নিয়ে তর্ক করে তারা একে “আপেল না কমলা” বলে ঠিক করতে চান; তাদের বিষয়টা এমন যে রাশিয়ানরা নিজের ভূখণ্ডের ভাষায় বিষয়কে আমলে নিতে চান না (যেমন ফিনল্যান্ডকে বলে “Suomi (সুওমি)” বা জার্মানির নিজস্ব নাম “Deutschland (ডয়েশলান্ড”)।

বিষয়টা হলো, বেলারুশ একটি দ্বিভাষিক দেশ এবং সব বেলোরাশিয়ানরাও রাশিয়ান ভাষায় বলতে পারে। এছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে, “বেলারুশ প্রজাতন্ত্র” ও ”বেলারুশ” বলতে একই ভূখণ্ডকে বোঝায়; যদিও তারা রাশিয়ান ভাষায় লিখতে ও কথা বলতে পারে।

এই রকম একটা পরিস্থিতিতে সবাই একে অপরকেই উপহাস করে। এগুলোতে একগাদা কৌতুক, ব্যঙ্গ আর মাঝে মাঝে বিরোধটা কুৎসিত রূপ ধারণ করে। এইসব অরাজনীতি স্তূপের মতো বিষয়ে মানুষের আলোচনার কিছু থাকে না, তখন রাজনৈতিকভাবে কৃপা-তুষ্টভুক্ত ব্যক্তিরা “বেলোরাশিয়া” আর ”বেলারুশ” নিয়ে পড়ে থাকে কোনটা “আমরা” কোনটা “তারা” এই বিতর্কের জন্যে।

সমাজের বুদ্ধিজীবি ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা “বেলোরাশিয়া” শব্দটিকে শুধু ভুল হিসেবে অ্যাখা দেয়নি, এটাকে তারা সাম্রাজ্যবাদী ও রাশিয়া ঘেঁষা বলে মনে করে। বেলারুশের রাজধানী মিনস্কের কম বেশি সবাই মনে করে, রাশিয়ানরা তাদের নিয়ে একরকম ব্যাখা দাঁড় করিয়ে সেই পরীক্ষায় আবার ভালো ফল করেছে। রাশিয়ার একটি নিউজ পোর্টাল মেদুজার সম্পাদক গালিনা টিমচেনকো ২০১৪ সালে “বেলোরাশিয়া” শব্দটিকে সমর্থন করেন বলশয় নিউজ সাইট নামের একটি পত্রিকায়। শব্দটির উৎস হিসেবে তিনি কিছু ডিকশনারি ও রাশিয়ান ইন্সিটিটিউটের রেফারেন্স আনেন। আবার, রাশিয়ান রক ব্যান্ড ”টাইম মেশিন” এর গায়ক অ্যান্ড্রে মাকার্ভিচ ২০১৬ সালে মিনস্কের একটি কনসার্টে বলেছিলেন, তিনি বেলারুশানদের রাগাতে চান না এবং তিনি সোভিয়েত যুগের দেওয়া এই নামটা থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না!

এই দুই রাশিয়ানের মন্তব্যে আমরা হাততালি দিতে পারেনি।

প্রশ্ন ৩. রাশিয়ানদের আপনারা কিভাবে দেখেন, দখলদার না বন্ধু?

১৯১৯ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত বেলারুশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিলে। তখনকার মানুষের এখনো তীব্র আবেগ কাজ করে নিজ জন্মস্থানের প্রতি। রেফারেন্স হিসেবে বলা যায়, তারা লিথুয়ানিয়ার গ্র্যান্ড ডুচির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত (১৬ থেকে ১৮ শতাব্দী ধরে এটা বড় ভূখণ্ড ছিল, এর সাথে বেলারুশও আছে)। সোভিয়েত যুগে কথিত ছিলো পূর্ব স্লাভিকরা, মানে -বেলারুশান, রাশিয়ান ও ইউক্রেনিয়ানদের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তবে দিন দিন আমরা বেলারুশানরা বুঝতে পেরেছি, সোভিয়েতকে ঘিরে এই নস্টালজিয়া আমাদের ও প্রতিবেশি দেশগুলোর মধ্যে অন্য কোনো ব্যাপার আছে।

সংক্ষেপে, সোভিয়েত সময়ে তাদেরকে দখলদার বলবো কি বলবা না; এই বিষয়ে বেলারুশানদের মধ্যে অবশ্য কোনো ঐক্যমত নেই।

বেলারুশিয়ান ইতিহাসগ্রন্থে সোভিয়েত যুগকে সন্তোষজনক বলা হয়েছে। সেই সময় অর্থনৈতিক উন্নতিও হয়। তবে ১৯৩০-এর দিকে সোভিয়েতদের নৃশংস দমনপীড়ন সম্পর্কে কোনো গভীর অনুসন্ধান করা হয়নি। একে সময়ের সাথে সাথে উপেক্ষা করা হয়েছে।

১৯৩৭ সালে সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশ ফোর্স ফাঁসির কাজগুলো সাড়তো মিনস্ক শহরের একটু দূরে জঙ্গলের মতো এলাকায়; নাম ’তাকে কুরাপাতিতে’। সোভিয়েত শাসনের পতন ও বেলারুশ পুনরুদ্ধারের সময় এই কুরাপাতির ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য শুধু গণতন্ত্রপন্থীরাই এর পরের দশকগুলোকে দুঃখ নিয়ে স্মরণ করে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি ভিন্ন। এখন এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে ছাপানো সংবাদপত্রের প্রাক্তন প্রধান সম্পাদকরাও আগ্রহী

ছবি: সোভিয়েত সময়ের বেলারুশ আর এখনকার বেলারুশের মধ্যে আছে বিস্তর পার্থক্য। তখন একই সাথে চারটি ভাষা স্বীকৃতি পেয়েছিলো- বেলারুশান, রাশিয়ান, পোলিশ এবং য়িদিশ। ছবিটি ১৯২৬ সালে মিনস্ক রেলওয়ে স্টেশনে তোলা। উইকিমিডিয়া কমন্স।

অন্যভাবে বলা যায়, স্বাধীন ইতিহাসবিদরা এই সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি যে, সোভিয়েতদের পরিকল্পনা ছিলো বেলারুশানদের জাতীয় পরিচয় ধামাচাপা দেয়া। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ মন্তব্য করেছিলেন যে, বেলারুশানদের সবার আগে সাম্যবাদ গড়তে হবে। কারণ রাশিয়ানদের জন্য তারা তাদের মাতৃভাষাকে প্রায় ত্যাগই করতে বসেছে। ১৯৬০ সালের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের ছায়াতলে আমোদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে ক্ষত-বিক্ষত করেছিলো। ক্রুশ্চেভের বাণী এখনো আমাদের কানে বাজে। এর মধ্যে দিয়ে বেলারুশের সাথে সোভিয়েতের আচরণও ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের কাছ থেকে আরো ব্যাখ্যা দরকার আমাদের। সত্য তিক্ত হতে পারে, কিন্তু মারাত্মক নয়।

এখন অনেকের মধ্যে ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের সেই জোসেফ স্ট্যালিনের সময়ের সোভিয়েত-বেলারুশের সংস্কৃতি নিয়ে কৌতূহল, চিন্তা ও পুনরোদ্ধারের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এই আগ্রহের দরকার আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত-বেলারুশ আমলকে উত্তরাধিকার হিসেবে মনে করত অল্পদিনের বেলারুশ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক (বিএনআর)। বিএনআর ২৫ মার্চ ১৯১৮ সালে স্বাধীনতা ঘোষণার আগে সোভিয়েত নেতারা বেলারুশানদের আলাদা জাতি হিসেবে মেনে নিতে পারেনি।

সোভিয়েত-বেলারুশান আমলের ১৫ বছর মস্কো সরকার খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছিলো যে, তাদের রাজনৈতিক নকশাকারদের ভাষা আর আমাদের ভাষা একদম ভিন্ন। এরপর তারা বেলারুশান ভাষা প্রচার করতে শুরু করলো, জাতীয় পরিচয় নিয়ে সংবাদপত্রে গরম গরম খবর ছড়াতে থাকলো আর একটা না চারটা ভাষাকে স্বীকৃতি দিলো – বেলারুশান, য়িদিশ, পোলিশ ও রাশিয়ান। সহঅবস্থানে থাকার জন্য সামাজিকভাবে এই চেষ্টা শান্তিপূর্ণ ও ফলপ্রসূ ছিল বলা যায়।

কিছু দিক বিবেচনা করলে এই পরিস্থিতির মতো ছিলো জার্মানির ভাইমার রিপাবলিকের আমল। সেই সময় একটা প্রজন্মকে উৎসাহিত করেছিলো। এর মধ্যে ছিল তরুণ, সমাজতন্ত্রী, বেলারুশ বংশোদ্ভূত পোলিশ লেখক সার্গেজ পিয়াসেকি- যার পোল্যান্ড সীমান্তে কোকেন চোরাচালান নিয়ে মারাত্মক লেখা আছে। সোভিয়েত নকশাকাররা বেলারুশের মধ্যে থেকে একে বলতো ”লাল ডেনমার্ক”। এর কারণ হতে পারে, বেলারুশের মাটি ফসলের জন্য বেশ ভালো। আবার এর জন্যও হতে পারে যে বেলারুশানরা কখনোই তাদের জীবনযাপনের একবিন্দু পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারবে না কিছু সমাজতান্ত্রিক সম্মিলিত খামারগুলোর জন্য।

১৯৩৭ সালের মধ্যে সোভিয়েত তার নিজের গড়া গর্তেই পড়ে গেল। তাদের সমর্থন ধীরে ধীরে হ্রাস পেলো। আর স্ট্যালিনের শুদ্ধিকালে অনুগামীরা অদৃশ্য হয়ে যাবে, না পালিয়ে যাবে সেই বিষয়েও একটা ব্যাপার ছিলো। যেসব বুদ্ধিজীবিরা বেলারুশান ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করেছিলো, ‘রেড ডেনমার্ক’ করার পণ করেছিলো তাদের তো কবর যাওয়ার মতো অবস্থা । তবে শুধু একজন ব্যক্তির জন্য এই কঠোর অনুশাসন বাতিল হয়। এই নতুন নীতিতে ক্রুশ্চেভের উপহাস ছিলো বেলারুশান ভাষার প্রতি (তিনি আসলে স্ট্যালিনকে অনুসরণ করেছেন)। এরপর ১৯৮০ এর দশকের শেষে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের আগ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সাথে এর বিরোধী কণ্ঠস্বরসহ যা কিছু ছিল; নির্মূল করা হয়।

এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে গবেষক হান্না সিভিয়ারনিক আমার কাছে অভিযোগ করেন ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালের ‘ন্যাশনাল কমিউনিস্ট’-এর ওপর তার লেখা আর্টিকেল প্রকাশই করতে পারেননি। কারণ ওই সময়ের নায়করা সবদিক থেকেই অসুবিধায় ছিলো। রাষ্ট্রের প্রকাশনা সংস্থাগুলো তাদের অতিরিক্ত সমাজতন্ত্রী ভাবতো এবং স্বশাসিত প্রকাশনা সংস্থাগুলো মনে করতো তারা অতিরিক্ত ‘রেড’ (লাল)।

আজ এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর কয়েকজনই দিতে পারবে – যারা সোভিয়েত সরকারের অধীনে বেলারুশিয়ান জীবনকে মূল্যায়ন করতে প্রস্তুত; সেই সময়ের নির্যাতন সহ্য করে নিভৃতে থেকে প্রশংসার পাত্র যারা, তারাই পারবে। আর বাকীরা সাদাকে সাদা বলবে আর কালোকে কালো বলবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .