গত এপ্রিলে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ৩০ বছর যাবত ক্ষমতায় থাকা ওমর আল-বশিরকে পদচ্যুত করার পর অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক কাউন্সিল (টিএমসি) কর্তৃক বেসামরিক প্রসাশনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে দাবি গনতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীরা জানিয়ে আসছিল, হোঁচট খেয়ে থমকে গিয়ে অবশেষে তা সম্পূর্ণ ভেস্তে যাওয়ার পথে।
৩রা জুন, সুদানের র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) বাহিনী রাজধানী খার্তুমে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর এক নৃশংস হামলা করে। আরএসএফ বাহিনী গঠিত হয়েছে কুখ্যাত “জানজাউইদ” বাহিনীর অভিজ্ঞ মিলিশিয়া সদস্যদের নিয়ে। ক্ষমতাচ্যুত ওমর আল বশিরের নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে পরিচালিত আধা সামরিক “জানজাউইদ” বাহিনী ২০০৪ সালে দারফুরে গণহত্যা চালিয়েছিল।
খার্তুমে সামরিক সদর দপ্তরের সামনে দু'দিনব্যাপী এই হামলায় ১১২ জন নিহত হয়েছে এবং ৭০০-র অধিক লোক আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১২ জন শিশুও আছে। ডাক্তাররা বলছে, হামলা চলাকালে ৭০ জনকে ধর্ষণ করা হয়েছে। একাধিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাতের আঁধারে ব্লু নাইল ব্রিজ থেকে লাশগুলোকে নীল নদে ফেলে দেয়া হয়। তবে কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার অভাবে মৃতের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২৬ বছরের মোহাম্মদ মাত্তার আন্দোলন চলাকালীন আরএসএফের গুলিতে নিহত বিক্ষোভকারীদের অন্যতম। তিনি লন্ডন থেকে প্রকৌশলী হিসেবে স্নাতক শেষে স্বদেশ খার্তুমে বেড়াতে এসেছিলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন রিপোর্ট অনুসারে, বিক্ষোভ চলাকালীন দুই নারীকে রক্ষার্থে এগিয়ে গেলে তাকে গুলি করা হয়।
শোক কাটিয়ে মাত্তারের বন্ধুরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রচারাভিযানের মাধ্যমে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, গনতন্ত্রকামীদের এই সংগ্রামে সংহতি প্রকাশ করে সকলে যেন তাদের প্রোফাইল পিকচারকে নীল রঙে ছেয়ে দেয়। তারা জানিয়েছে, মাত্তারের প্রিয় রঙ ছিল নীল আর মৃত্যুর দিনও নিজের প্রোফাইল ছবিতে তিনি এই রঙটিই রেখেছিলেন।
ইতোমধ্যে “নীল ঢেউ” সামাজিক মাধ্যমগুলোকে ভাসিয়ে দিয়েছে। নীল রঙ হয়ে উঠেছে অভ্যুত্থানে প্রাণ উৎসর্গকারীদের প্রতিক।
“মাত্তার সদয়, যত্নবান ছিল…একজন সাদা মনের মানুষ ছিল।” বিবিসির ভিডিওতে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারাভিযানে মাত্তার সম্পর্কে তার এক বন্ধুকে এমনটাই বলতে শোনা যায়।
মাত্তারের স্মরণে তার বন্ধুরা তাদের প্রোফাইল ছবি নীল করেছে আর গত ক'দিন যাবত হ্যাশট্যাগ ব্লু ফর সুদান (সুদানের জন্যে নীল) বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। ট্রেভর জ্যাকসন ও রিয়ানার মত তারকারাও এই হ্যাশট্যাগ প্রচারে সাহায্য করেছে।
বিশ্বব্যাপী #ব্লুফরসুদান
মাত্তার এবং গনতন্ত্রকামীদের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনার্থে হাজার হাজার লোক তাদের প্রোফাইল ছবি নীল করেছে।
Those who are taking part in spreading #BlueForSudan. The color blue came from a warm hearted, martyrs known as, Mohammed Hashim Mattar, my cousin who has passed away on the 3rd of June, as he was standing proud. Blue was his fav color, which now presents unity.??
Mattar’s Blue pic.twitter.com/MdZ7f2sLwS
— OmerYousiff (@OmerYousifff) June 12, 2019
যারা #ব্লুফরসুদান ছড়িয়ে দিতে অংশ নিচ্ছে… নীল রঙটি এসেছে শহীদ মোহাম্মদ হাশেম মাত্তারের কাছ থেকে, যিনি একজন সহৃদয় বাক্তি। তিনি, আমার চাচাতো ভাই, গত ৩ জুন মারা গিয়েছেন, গর্বের সাথে প্রতিবাদে সমুন্নত থেকে। নীল ছিল তার প্রিয় রঙ, যা এখন ঐক্যের প্রতিক।
Why #BlueForSudan? The movement was started by grieving friends of Mohamed Mattar, who had travelled from London to Khartoum, reportedly shot by military forces while protecting two women in the crackdown. Blue was his favourite colour.
(You should be paying attention to Sudan)
— aiza ?? (@curious_aiza) June 16, 2019
#ব্লুফরসুদান কেন? এই আন্দোলনের সূচনা মোহাম্মদ মাত্তারের শোকাহত বন্ধুদের দ্বারা, যে কিনা লন্ডন থেকে খার্তুমে ঘুরতে এসেছিল। জানা যায়, আন্দোলনে হামলা হলে দুই নারীকে রক্ষার সময় সামরিক বাহিনী তাকে গুলি করে। নীল ছিল তার প্রিয় রঙ।
(আপনাদের উচিত সুদানের প্রতি মনোযোগ দেয়া)
জাতিসংঘের যুববিষয়ক দূত টুইট করেছেন যেঃ
In solidarity with my sisters & brothers of #Sudan.
Accounting for more than 2/3 of the population, young ppl are Sudan’s biggest hope.
I join activists from all over the word to call for the end of violence & demand the protection of the rights of Sudanese youth! #BlueForSudan pic.twitter.com/9xSG6biSYN— UN Youth Envoy (@UNYouthEnvoy) June 16, 2019
আমার সুদানি বোন ও ভাইদের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি।
হিসাব বলছে, জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তরুণকে ঘিরেই সুদানের বৃহত্তর প্রত্যাশা।
অরাজকতার অবসান এবং সুদানি যুবকদের অধিকার সুরক্ষার দাবিতে বিশ্বের সকল সক্রিয়কর্মীর সাথে আমিও যুক্ত হলাম।
সুদানের সুদিন কামনা করে বব মার্লীর ফ্যান অ্যাকাউন্ট এক টুইট বার্তায় লিখেছেঃ
#BlueForSudan ?? “Until bigotry and prejudice and malicious and inhuman self-interest have been replaced by understanding and tolerance and good-will… the African continent will not know peace.”
– HIM Haile Selassie I addresses @UN, 1963.#Sudan#AfricaUnite#GetUpStandUp pic.twitter.com/QTkrqUzdVM
— Bob Marley (@bobmarley) June 15, 2019
যতদিন পর্যন্ত উপলব্ধি, সহিষ্ণুতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের দ্বারা ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার এবং বিদ্বেষ-পরায়ণ ও পাশবিক আচরণকে পরিবর্তন করা না হবে… আফ্রিকা মহাদেশ শান্তির দেখা পাবে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরকম প্রচারাভিযান সম্পর্কে এক টুইটার নেটিজেন লিখেছেঃ
Maybe#ব্লুফরসুদান won't save the world, but it will raise awareness about a terrible issue that would otherwise go unspoken and *hopefully* let the people of Sudan know they are not alone.
Be their voice when they don't have one. pic.twitter.com/hRBKworUpQ
— ?????? #BlueForSudan ?????? (@BalqisSidiqia) June 16, 2019
#ব্লুফরসুদান আন্দোলন হয়তো সমগ্র বিশ্বকে পরিত্রাণ দিবে না কিন্তু এমন একটি ভয়াবহ সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করবে, যা কিনা, অন্যথায়, অব্যক্ত থেকে যেতো এবং আশা করছি, সুদানের নাগরিকরা জানতে পারবে, তারা একা নয়।
যখন তাদের কেউ নেই, আপনিই তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠুন।
নেটি নাগরিকরা প্রোফাইল ছবির রঙ বদলানো এবং অধিকতর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য জোর প্রচারণা চালাচ্ছেঃ
#BlueForSudan
This time we must all act. There are so many ways to do something. Engage on social media, ask the official you know in your country what they are doing. Write to media folk. Whatever you do, don’t do nothing else you will one day ask yourself ‘what was I doing? 2/3 pic.twitter.com/YVVN6zplux— Lucy Quist (@LucyQuist) June 15, 2019
#ব্লুফরসুদান
এবার আমাদের সব কিছু করতে হবে। কিছু একটা করার অনেক উপায় আছে। সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় হোন। দেশে আপনার পরিচিত কর্মকর্তাদের জিজ্ঞেস করুন, তারা কি করছে। গণমাধ্যম কর্মীদের উদ্দেশ্যে লিখুন। আপনি যা পারেন – করেন, একেবারে কিছুই না করে বসে থাকবেন না। নাহয় একদিন নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করবেন, “আমি কি করেছিলাম?”
ইতোমধ্যে, মাত্তারের আদর্শ বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে তার পরিবার “মাত্তার ব্লু মুভমেন্ট” নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট তৈরি করেছেঃ
This page is created by the family and friends of Mohamed Hashim Mattar to keep the martyrs alive and honor their memory. This is only the beginning. This is the movement. #MattarBlue #BlueForSudan
— MattarBlueMovement (@MattarBlue) June 15, 2019
মোহাম্মদ হাশিম মাত্তারের পরিবার ও বন্ধুগণ কর্তৃক শহীদদের স্মরণীয় করে রাখতে এবং তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনার্থে এই পাতাটি তৈরি হয়েছে। মাত্র তো শুরু। এটাই আমাদের আন্দোলন।
আতংকের পর পুনরায় বিক্ষোভ
দা গার্ডিয়ানের সূত্রে জানা গিয়েছে, আরএসএফের আক্রমণের পরপরই কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছে এবং টিএমসি ভুল স্বীকার করে তদন্ত শুরু করেছেঃ
Sudan’s military rulers admitted that security forces had committed abuses during the attack on the camp. They appear to have been spontaneous as frustration grows after opposition leaders called off a general strike intended to force the generals to agree a transition to civilian rule.
সুদানের সামরিক শাসকরা স্বীকার করেছে যে, (প্রতিবাদকারীদের) ক্যাম্পে অভিযান চালানোর সময় নিরাপত্তা বাহিনী অবাঞ্ছিত কর্মকাণ্ড করেছে। বেসামরিক প্রসাশনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করার লক্ষ্যে বিরোধী দলীয় নেতারা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়ায়, মনে হচ্ছে সামরিক শাসকদের হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে টিএমসির পক্ষ থেকে পুনরায় সমন্বিত আলোচনার উদ্যোগ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিক্ষোভকারীরা বলছে, ৩ জুন নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে টিএমসি তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। তার পরিবর্তে বিক্ষোভকারীরা এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে একটি স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
পুরস্কার-প্রাপ্ত সুদানি চলচ্চিত্র নির্মাতা হাজজ কুকা (“বিটস অফ দা আন্তনভ” চলচ্চিত্র খ্যাত) অবস্থান বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন এবং তিনিও আহত হয়েছেন। স্থানীয় গণমাধ্যমের কাছে তিনি বলেন, “গণধর্ষণের অভিযোগগুলো সত্য এবং আমরা যা দেখেছি তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।”
তবে টিএমসি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চাচ্ছে, পাশাপাশি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে তিনশো কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে।
টানা বারো দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী সুদানিজ প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েশন (এসপিএ) এবং অন্যান্য বিক্ষোভকারী জোটের পক্ষে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদ চালিয়ে যাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে গত ১৪ জুন, শুক্রবার খুদে বার্তা এবং মুখে মুখে প্রচারণার মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে আন্দলনকারীরা খারতুম ও বন্দর নগরীতে বিক্ষোভ করে। এসময় তারা আবারো গুলি বর্ষণ ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের স্বীকার হয়।
আরও পড়ুনঃ নেটিজেন রিপোর্ট: গণতান্ত্রিক আন্দোলনরত সুদানের নাগরিকেরা সামরিক সহিংসতা এবং ইন্টারনেট বন্ধের শিকার।
এই বিক্ষোভের অন্যতম নেতৃস্থানীয় কণ্ঠস্বর এসপিএ-র সদস্যবৃন্দ, যারা কিনা আলোচনায় সামনের সারিতে ছিল, তাদের উদ্যমে আরেকটি হ্যাশট্যাগ #আমিসুদানেরআন্দোলন (সুদান বিপ্লবের পক্ষে আমিও আছি) ছড়িয়ে পরেছেঃ
#IAmTheSudanRevolution because my people cannot die in vain, cannot die in silence under an internet blackout. because peaceful protest was met with a massacre. because my people deserve dignity, deserve freedom, deserve for the world to know us and our fight
— Safia Elhillo (@mafiasafia) June 6, 2019
#IAmTheSudanRevolution (#আমিসুদানেরআন্দোলন) কারণ নিরর্থক আমার মানুষগুলো মরতে পারে না, ইন্টারনেট ব্লাকআউটের দরুণ নীরবে নিভৃতে তাদের মৃত্যু হতে পারে না। কারণ শান্তিপূর্ণ আন্দলনকারীরা হত্যাকাণ্ডের মুখোমুখি হয়েছে। কারণ আমার মানুষগুলোর শ্রদ্ধা প্রাপ্য, স্বাধীনতা প্রাপ্য, কারণ আমরা এবং আমাদের সংগ্রাম বিশ্বকে জানানোর উপযুক্ত।
বিবিসি-র আফ্রিকা অঞ্চলের সম্পাদক ফেরগাল কি'ন এক চাক্ষুষ সাক্ষীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যার বর্ণনানুসারে এই হত্যাকাণ্ডের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলঃ “মানসিকভাবে বিপর্যয় সৃষ্টির দ্বারা বিপ্লবটা ব্যর্থ করে দেয়া।”
আরএসএফের নির্যাতনে বিক্ষোভকারীদের উদ্দীপনায় ভাঁটা পরছে এবং মনোবল প্রায় হারিয়েই ফেলেছে – যার প্রভাব পরেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও। #ব্লুফরসুদান এর ব্যাপক প্রচারণা বিশেষত আন্দোলনকারীদের সাথে বিশ্বের বাকি অংশের সাথে সেতুবন্ধনে সামাজিক মাধ্যমগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
1 টি মন্তব্য
Informative Post.
প্রযুক্তি কথন