পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম, পিঠে ব্যাগ, আর চোখে মুখে আগুণ, গলায় তাঁদের স্লোগান। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের হাজারে হাজারে শিক্ষার্থী গত কয়েকদিন ধরে রাজপথ তাদের দখলে রেখেছে। আর তাতে অচল সারা শহর। গত ২৯ জুলাই রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের অদূরে বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া আক্তার মিম (১৭) ও আবদুল করিম (১৮) নিহত হয়। বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী আহত হয় এবং প্রতিবাদে তাদের সহপাঠীরা রাস্তায় নেমে আসে।
নিরাপদ সড়ক এবং তাঁদের সহপাঠীদের হত্যার বিচারের দাবিতে তারা ক্লাসরুম ফেলে রাস্তায় নেমেছিলেন। ক্রমশঃ অন্যান্য স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও সংহতি প্রকাশ প্রতিবাদে প্রতিদিনই রাস্তায় নামছেন। তারা চাইছেন এরকমভাবে যেন আর কারো মৃত্যু না হয় এবং সে লক্ষ্যে দুর্ঘটনা ঘটান চালকদের কঠিন শাস্তি এবং শুধুমাত্র লাইসেন্সধারীরাই যাতে গাড়ি চালায়। অভিভাবকরাও শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষেরাও দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
তাঁদের ক্ষোভের আরেকটি কারণ নৌমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নির্বাহী প্রেসিডেন্ট শাহজাহান খানের একটি উক্তি যা এই দুর্ঘটনাকে ছোট করার চেষ্টা করেছে বলে অনেকে মন্তব্য করেছেন। তিনি সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে আগেরদিন ভারতে ৩৩ জন্য বাস দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে – ছাত্রছাত্রীরা কেন সেটা নিয়ে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি?
এটা নিয়ে বহুল আলোচনা-সমালোচনা হবার পর তার পদত্যাগের দাবির মুখে তিনি তার বক্তব্যের জন্যে ক্ষমা চান কিন্তু বলেছেন তিনি পদত্যাগ করবেন না।
বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর যেখানে প্রায় দেড় কোটি লোক বাস করে এবং বিবিধ ট্রাফিক সমস্যায় জর্জরিত। ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট এর ২০১৬ সালের জরীপ অনুযায়ী ঢাকা ১৪০টি বাসযোগ্য শহরের মধ্যে ১৩৭ র্যাঙ্ক লাভ করেছে। গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ৭০০০ এর বেশি লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় বাংলাদেশে এবং ১৬০০০ এর বেশি মানুষ আহত হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার উপর গবেষণা করে তারা দেখেছেন, ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ চালকের বেপরোয়া মনোভাব আর ৫৩ শতাংশ কারণ অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো। আবার বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এনজিও হিসেবে পরিচিত ব্র্যাক-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ৫৯ শতাংশ চালক ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালান না৷ অধিকাংশ চালকের সড়ক নিরাপত্তা বাতি এবং সাইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা নেই৷
ঢাকা শহরে প্রায় দশ লাখ বিভিন্ন পরিমাণে নিবন্ধিত যানবাহন রয়েছে এবং ডেইলি স্টারের সাক্ষাৎকার অনুযায়ী এ শহরে পর্যাপ্ত পুলিশ নেই এই পরিমাণ যানবাহনকে সুশৃঙ্খল রাখার জন্যে। তারা কাজের ভাঁড়ে জর্জরিত, কম বেতন পান, ঘুষ খেতে বাধ্য হন, এবং বিপদের মুখে পরেন প্রতিনিয়ত। এছাড়াও অনেক জনপরিবহনের চালকেরই বৈধ লাইসেন্স নেই।
Hard facts in #Bangladesh- For driving over 3.5 million registered vehicles there are only 1.9 people with valid driving licenses. Many of the small public commutes (Lagoona, Tempos etc) are driven by underaged without licensed drivers prone to accidents https://t.co/bTeinc6V2Q pic.twitter.com/AAfBiHBtdT
— r҉e҉z҉w҉a҉n҉ (@rezwan) July 31, 2018
বাংলাদেশের কিছু কঠিন তথ্য – ৩৫ লাখ যানবাহন চালানোর জন্যে মাত্র ১৯ লাখ বৈধ লাইসেন্স আছে। অনেক ছোট গণপরিবহন (লেগুনা, টেম্পো) কমবয়সী ছেলেরা চালায় যারা প্রায়শই দুর্ঘটনায় পরে।
একটি সাম্প্রতিক জরীপে দেখা গেছে ঢাকার ৮৭% গণপরিবহন ট্রাফিক আইন মানে না। এবং এই ভিডিও অনুযায়ী তাঁদের সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণও হয়না।
ছাত্ররা যখন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে
পরিবর্তনের আশায় ছাত্ররা পুলিশের কাছ থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোলের দায়িত্বও নিয়েছে। তারা রাস্তার মোরে মোরে গাড়ি থামিয়ে লাইসেন্স চেক করছে এবং আইন ভঙ্গ করলে তাঁদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। এমনকি তারা মন্ত্রী বা পুলিশকেও ছাড়েনি নিয়ম ভঙ্গ করার জন্যে। ‘ফাস্টফুড জেনারেশন’ হিসেবে পরিচিত স্কুলের শিক্ষার্থীদের এহেন নিয়মানুবর্তিতা সবার প্রশংসাও কুড়িয়েছে।
তরুণ সাহিত্যিক স্বকৃত নোমান শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডকে অভাবনীয় উল্লেখ করে লিখেছেন:
এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। মনে হচ্ছে ফকনার, হুয়ান রুলফো কিংবা গার্সিয়া মার্কেজের গল্পের মঞ্চায়ন হচ্ছে বাংলাদশে। রং সাইড দিয়ে যাওয়ার সময় একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর গাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে বাচ্চারা। একজন মেয়রের গাড়ি আটকে দিয়েছে। মেয়র পুলিশকে ফোন দিচ্ছেন। পুলিশ বলছে, আমাদের কিচ্ছু করার নেই। কী অভাবনীয় ঘটনা! প্রতিটি গাড়ির কাগজপত্র চেক করছে বাচ্চারা। বাদ যাচ্ছে না পুলিশ-র্যাবের গাড়িও। অসীম ক্ষমতাধর পুলিশ-র্যাবে তাদের গাড়ির বৈধ কাগজপত্র দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। রাজধানীর যানবাহনগুলো কী সুন্দর লাইন ধরে চলছে।
ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের এই কদিনের কার্যক্রমে দেখেছে যে অনেক সরকারী গাড়িরই কোন কাগজপত্র রাখা হয়না, বা চালকের লাইসেন্স থাকেনা।
টুইটারে শাহিদা রিমি লিখেছেন:
Our girls ???they can do everything ???? she is just a school kid but perfectly she controlling traffic system ??? lots of love and dua baby ???you made your senior sis proud ???
#RoadSafety #নিরাপদসড়কচাই #Bangladesh#WeWantJustice pic.twitter.com/5fltuecVo7— NINI's ? Rimi? (@IamNinisRimi) August 1, 2018
আমাদের মেয়েরা, সবকিছুই পারে। তারা স্কুলের বাচ্চা। কিন্তু দেখিয়ে দিল কীভাবে ঠিকমতো ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে হয়।তোমার জন্য ভালোবাসা ও দুয়া রইলো। তোমার কাজে বড় আপু হিসেবে সত্যিই গর্ব করছি।
শাহরিয়ার ফাহিম লিখেছেন তারা সড়ক পরিষ্কারও করছে:
Just look at them
They were protesting
BUT? they cleared the road.. they managed the traffic better than anyone. #নিরাপদসড়কচাই #WeWantJustice #RoadSafety pic.twitter.com/vzo9QYjkoF— Shahriar Fahim (@Shahriarfahim69) August 2, 2018
দেখুন, তারা প্রতিবাদ করছে। তবে, তারা রাস্তাও পরিষ্কার করছে। তারা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অন্যদের চেয়ে ভালো জানে।
ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা কোথায়?
এইসব আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্যে অনেককেই উদ্বিগ্ন থাকতে দেখা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াঁ পুলিশকে বলেছেন ছাত্রদের উপর কোন বল প্রয়োগ না করতে।
যদিও পুলিশ শিক্ষার্থীদের অবস্থান ছত্রভঙ্গ করতে বেশ কয়েকটি স্পটে লাঠিচার্জ করেছে। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত বলে সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে।
Police are beating students black and blue at Mirpur, Dhaka.
Spread it people! That's the least we can do for them! #studentsdemandingjustice #StudentProtest #RoadSafety #Bangladesh pic.twitter.com/Sqz0TJMvXu
— Nayeema Mahfuja ?? (@NayeemaMahfuja) August 2, 2018
মিরপুরে পুলিশরা ছাত্রদের উপর চড়াও হয়েছে।
সবাইকে জানান! তাঁদের জন্যে হয়ত এতোটুকুই করতে পারব!
সবার জন্যে শিক্ষণীয় এবং আইনের পরিবর্তন দরকার
আলমগীর সামিরা স্কুলের বাচ্চাদের কাছ থেকে শেখার আহ্বান জানিয়ে টুইট করেছেন:
Dear politicians,and police learn something from theses childrens #shameonbangladeshpoliceandpoliticians #Bangladesh #RoadSafety #WeWantJustice #নিরাপদসড়কচাই @CNN @BBCBreaking pic.twitter.com/nKkip8UM29
— Samira Alamgir (@AlamgirSamira) August 2, 2018
প্রিয় রাজনীতিবিদ ও পুলিশ ভাই-বোনেরা, এই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আপনাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
সরকার সাবধানতার সাথে এই প্রতিবাদ কর্মসূচিগুলো প্রত্যক্ষ করছে। তাঁদের এই পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি নির্দেশ এসেছে অবৈধ চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্যে।
এইসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ দোষী চালকদের পর্যাপ্ত শাস্তি না হওয়া। বিদ্যমান আইনগুলি খুব পুরানো এবং আইনমাফিক গাড়ি না চালানোর কারণে কারো মৃত্যু হলে ঐ চালক অল্প ফাইন দিয়ে পার পেয়ে যায়। সরকারী কর্মকর্তা মাহবুব কবির মিলন ফেসবুকে বিদ্যমান আইন সম্পর্কে লিখেছেনঃ
Reckless or dangerous ড্রাইভিং এর শাস্তি ২য় বার করলে সর্বোচ্চ ৩ বছর জেল (বর্তমানে বিদ্যমান Motor Vehicle Ordinance, 1983 অনুযায়ী।
কিন্তু
Reckless or dangerous ড্রাইভিং এর কারণে কেউ মারা গেলে সর্বোচ্চ শাস্তি ৩ বছর জেল (THE PENAL CODE, 1860)।
তারমানে, খুন হচ্ছে ফাও। অর্থাৎ, মৃত্যুর জন্য অতিরিক্ত কোন শাস্তি নেই!!!
সড়ক দুর্ঘটনারোধে সরকার বিদ্যমান মোটরযান আইন সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও পরিবহন শ্রমিক-মালিকদের বাধার মুখে বার বার সেটা পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সরকার দ্রুত এই আইন পাস করার উদ্যোগ নিয়েছে।