কেন বাংলাদেশের একজন দেয়ালচিত্র শিল্পী সুবোধ নামের কাউকে পালিয়ে যেতে বলছে

“সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই।”- সুবোধ সিরিজের একটি দেয়ালচিত্র। কে বা কারা আঁকছে, তা জানা যায়নি। হবেকি?'র ফেইসবুক পেইজ থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

কয়েক মাস আগের ঘটনা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ে হঠাৎ একটি গ্রাফিটি বা দেয়ালচিত্র সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দেয়ালচিত্রের বিষয়, খাঁচায় বন্দি সূর্য হাতে নিয়ে এক লোক পালিয়ে যাচ্ছে। তাতে লেখা, “সুবোধ, তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই।“

এরপরের কয়েক মাসে শহরের আরো অনেক এলাকার দেয়ালেও একই ধরনের দেয়ালচিত্র দেখা যেতে থাকে। আস্তে আস্তে সেগুলো দেয়াল থেকে মানুষের ফেইসবুকে শেয়ার হতে থাকে। যদিও কে বা কারা, কী উদ্দেশ্যে এই দেয়ালচিত্র করছেন, তা জানা যায়নি। তবে দেয়ালচিত্রের সাথে ‘হবেকি’ লেখা আছে। ধারনা করা হচ্ছে, হবেকি? নাম দিয়ে তারা দেয়ালচিত্রগুলো অঙ্কন করছে।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এই দেয়ালচিত্রের সৃষ্টিকর্তাকে অনেকে বাংলাদেশের ব্যাঙ্কসি বলে অভিহিত করেছেন। ব্যাঙ্কসি বিলেতের একজন নাম না জানা দেয়ালচিত্রকর যিনি তার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক বার্তাসহ চোখা দেয়ালচিত্রের জন্যে বিশ্বনন্দিত।

এই দেয়ালচিত্রগুলি আঁকতে স্টেন্সিল এবং স্প্রে পেইন্ট ব্যবহার করা হয়েছে যা ব্যাঙ্কসিও ব্যবহার করেন।

রুবায়েত মেহেদি অনিক ফেইসবুকে লিখেছেনঃ

“সুবোধ তুই পালিয়ে যা”
গ্রাফিটি গুলো কে বা কারা করেছেন, জানি না। হয়তো কখনোই জানবো না, জানা হবে না!
সারাজীবন Banksy'র গ্রাফিটি দেখে যে ছেলেটা ঘুম নষ্ট করেছে, তার কাছে সুবোধের আবেদন যে কোনখানে, বোঝানো যাবে না।
“সুবোধ” যার বা যাদের হাত ধরেই আসুক, ভালোবাসা রইলো <3

ব্যাঙ্কসি’র কাজে যেমন রাজনীতি, সমাজের নানা বিষয়কে খোঁচা মারার প্রবণতা দেখা যায়, সুবোধ সিরিজের দেয়ালচিত্রেও সেটা দেখা গেছে।

“সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না।” – সুবোধ সিরিজের দেয়ালচিত্র। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

সুবোধ কি অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশ?

এই নাম না জানা দেয়ালচিত্রশিল্পী সুবোধকে কেন পালিয়ে যেতে বলছেন? অনেকেই এর পিছনে দেশের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার কথা তুলেছেন। সাংবাদিক তুষার আবদুল্লাহ লিখেছেন:

সুবোধ কেন পালাবে? পালাতে চাইতেই পারে সে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ সে। তাতে রুজির জন্য পথে নামতে হয়। পথে নামামাত্র তাকে জিম্মি হয়ে পড়তে হয় পরিবহন শ্রমিক-চালক-মালিকের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে। যখন যেমন খুশি ভাড়া আদায়। ইচ্ছে করলে বাসে তুলবে, আবার গলা ধাক্কা দিয়ে নামিয়েও দেবে। প্রতিবাদ করলে ধর্মঘট। সুবোধ এই স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে বাঁচে কী করে? রোগ-বালাই নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হয়। সেখানে আবার চিকিৎসক-নার্স-ওয়ার্ড বয়ের দৌরাত্ম্য। সেই দৌরাত্ম্য সইবার পরেও যদি ঠিকঠাক চিকিৎসা মিলতো তাহলে মনকে বোঝানো যায়। সেখানে আবার ডাক্তারে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, রোগ নির্ণয়ের রকমারি পরীক্ষায় ভেজাল।[…]

“সুবোধ এখন জেলে! পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে।” – সুবোধ সিরিজের দেয়ালচিত্র। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

সুবোধ কি ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার?

কেউ কেউ আবার দেশের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের দিকেও ইঙ্গিত করেছেন। কারণ সুবোধ একটি গতানুগতিক হিন্দু নাম। পরিসংখ্যানে দেশে ১২% হিন্দু থাকলে এই সংখ্যা কমছে। আরিফুর সবুজ লিখেছেন:

সুবোধ, এটা ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ। এখানে ফতোয়া দিয়ে বিচার করেন শফি হুজুররা। ন্যায় বিচার, লেডি জাস্টিস এসবের এখানে কাজ কি?
তুই পালিয়ে যা সুবোধ, তাতেই মঙ্গল।

নাগরিক কবি শামসুর রাহমান বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ‘সুধাংশু যাবে না’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছেন। নির্যাতনের শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তখন দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। অনেকে ‘সুবোধ’-কে ‘সুধাংশু যাবে না’ থেকেই অনুপ্রাণিত বলে মনে করছেন।

পাগলামী করিসনে বন্ধু সুধাংশু
সময় যে পার হয়ে যাচ্ছে
এবার যে তোর পালানোর বেলা
জিদ করিসনে বন্ধু, এখনই তুই পালা। [..]
কোথায় সেই রামী, শেপু, কাকলী আরও সেই প্রিয় বন্ধুগুলা
ওরা যে সবাই পালিয়েছে, এবার তোর পালা।

“সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না। মানুষ ভালবাসতে ভুলে গেছে।” – সুবোধ সিরিজের দেয়ালচিত্র। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

কাজী রোকসানা রুমা সুবোধকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার ফেসবুক পোস্টে:

সুবোধ তুই পালিয়ে যা। এখন সময় পক্ষে না'। এই সুবোধই এখন বাংলাদেশের প্রতিনিধি। বেকারত্বের প্রতিনিধি, অর্ধেক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। শুভ বোধের প্রতিনিধি। মুসলিম ধর্ম ছাড়া অন্য যে কোন ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের প্রতিনিধি। বুকের মধ্যে জ্বলজ্বল করা সূর্যটাকে খাঁচায় পুড়ে যে শুধুই ছুটে বেড়ায়। দেখি আর দম বন্ধ করা কান্না আমাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়। শুধু মনে মনে বলি ‘ভাগ মিলখা ভাগ, সুবোধ পালিয়ে যা'। কিন্তু কোথায়??????????????

“হবে কি?” – সুবোধ সিরিজের গ্র্যাফিতি। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নগরজুড়ে দেয়াললিখন বা গ্র্যাফিটি এটিই প্রথম নয়। নব্বই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘কষ্টে আছি- আইজুদ্দিন’ দেয়াললিখন বেশ নজর কেড়েছিল।

1 টি মন্তব্য

  • সালাহউদ্দিন

    প্রায়ই ঢাকার দেয়ালচিত্রে দুটি চরণ চোখে পড়ে, ”সুবোধ, তুই পালিয়ে যা, সময় এখন তোর পক্ষে নয়।”

    সাম্প্রতিক সময়েও চরণ দুটি মনোযোগ কেড়েছে নানান লেখায়, অবয়বপত্রে, এমনকি অবয়বপত্রের বাইরেও। সঙ্গের ছবিটিও চোখ এড়ায়নি, যেখানে সুবোধ নামের ব্যক্তিটিকে দেখা যাচ্ছে একটি খাঁচাবন্দী সূর্য নিয়ে ত্বরিত গতিতে পলায়মান।

    আমি চরণ দুটি ও ছবিটি নিয়ে অনেক ভেবেছি। প্রথমেই মনে হয়েছে, ‘সুবোধ’ আসলে কোনো ব্যক্তি নয়, ‘সুবোধ’ শব্দটিকে সম্ভবত ‘সুস্থ, সুন্দর, সৎ বোধের’ প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এসব বোধের জন্য কি কোনো পূর্বনির্ধারিত নির্দিষ্ট কোনো সুসময় থাকে, যখন তারা পল্লবিত হয়ে ওঠে, শাখা মেলে, গতিময় হয়? তৃতীয়ত, অন্য সময়ে ওই সব বোধের কি অন্তর্হিত হবে? তাহলে ওই দুঃসময়েই কি ‘অসুস্থ, অসুন্দর আর অসৎ বোধদেরই’ জয়জয়কার হবে?

    চূড়ান্ত বিচারে আমার মনে হয়েছে, উপর্যুক্ত চরণ দুটি আসলে বিভ্রান্তিমূলক ও পলায়নমুখীও বটে। সুস্থ, সুন্দর, সৎ বোধের স্থিতি ও বিকাশ সব সময়ের জন্য, কারণ তারা সর্বজনীন। সন্দেহ নেই, কোনো কোনো সময় আসে বটে, যখন সম্পূর্ণ পরিবেশ, সব শক্তি ওই সব বোধের সপক্ষে যায়। মানবতার জন্য, সমাজের জন্য ও পৃথিবীর জন্য সে একটা সুসময়। কিন্তু সে প্রক্রিয়াটি ঘটে যায় ইতিহাসের ও বিবর্তনের স্বাভাবিক নিয়মেই। তার জন্য চেষ্টা করতে হয় না, সংগ্রাম করতে হয় না, প্রাণপাত করতে হয় না। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে পৃথিবীর ইতিহাসে, মানবসভ্যতার বিবর্তনে এ রকম সুসময় প্রায়ই আসে না। তারা আসে নানান ক্রান্তিলগ্নে যখন সবকিছুই একে অন্যের সঙ্গে মিলে যায়। সোনায় সোহাগা কি সব সময় ঘটে?

    সুতরাং প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে উপরোক্ত দুর্লভ ক্ষণগুলোর বাইরের সময়কে নিয়ে-যখন সময় সুস্থ, সুন্দর ও সৎ বোধের পক্ষে নয়? কি করণীয় তখন? পালিয়ে যাওয়া? যেমনটি ওই শেষ চরণে বলা হয়েছে।তারপর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করা সেই সুসময়ের, যখন সময় ওই সব বোধের সপক্ষে যায়? কিন্তু সে অপেক্ষা তো নিষ্ক্রিয় প্রতীক্ষা, সে প্রতীক্ষা তো একজীবনে শেষ না-ও হতে পারে এবং সে অপেক্ষা তো ‘গডোর প্রতীক্ষা’র মতো অনন্তকালের জন্য হতে পারে। এটা তো কাম্য হতে পারে না। এ কর্মটা করলে তো দুঃসময়ে অসুস্থ, অসুন্দর আর অসৎ বোধেরাই আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে যাবে।

    সে রকম শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে আমরা বাঁচব কী করে? পথ তো তাহলে একটাই। সে পথ প্রতিবাদের, সংগ্রামের আর রুখে দাঁড়ানোর। যখন সময় সুস্থ, সুন্দর আর সৎ বোধের পক্ষে নয়, তখনই একত্রিত হতে হবে, সংহত হতে হবে এবং পথে নামতে হবে। খুব সোজা বা সুখকর পথ নয়-কিন্তু একমাত্র পথ। মনে রাখা দরকার, দুঃসময়েই সুস্থ, সুন্দর ও সৎ বোধদের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি এবং পৃথিবী ও সভ্যতার ইতিহাসে সংগ্রাম ছাড়া তাদের প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। তাই সময় পক্ষে নেই বলে তো বসে থাকা যাবে না, পালিয়ে যাওয়া তো নয়ই। সুতরাং সুবোধকে কোন ভাবেই পালাতে দেয়া যাবে না। কারন সুবোধ পালিয়ে যাওয়া মানে সুস্থ, সুন্দর, সৎ বোধের অপমৃত্যু এবং ‘অসুস্থ, অসুন্দর আর অসৎ বোধদেরই’ জয়জয়কার।

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .