সম্প্রতি মানবাধিকারকমী ইরন চানু শর্মিলা একটি বিতর্কিত স্বৈরাচারী আইনের প্রতিবাদে ১৬ বছর ধরে চালানো অনশন ভঙ্গ করে ভারতের দক্ষিণ-পূর্ব রাজ্য মনিপুরের রাজনীতিতে যোগদান করার এবং তাঁর পুরুষবন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবন গুছিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অনেকেই এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও (বলা হয়ে থাকে, তাঁর এই অনশন-ই পৃথিবীর দীর্ঘতম), তাঁর সমর্থক ও সহকর্মীদের অধিকাংশ-ই ঠিক খুশি হতে পারেননি।
আত্মহত্যা প্রতিহতকরণ আইনের অধীনে মনিপুরের একটি হাসপাতালে তাকে জোরপূর্বক নাকে নলের সাহায্যে তরল খাবার সরবরাহের মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিলো। সে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর, ৪৪ বছর বয়স্ক শর্মিলা মনিপুরের স্থানীয় একটি কলোনিতে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই কলোনির অধিবাসীরা, এমনকি সেখানকার ইসকন মন্দিরও তাকে রাখতে চায়নি। অবশেষে পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে ফিরিয়ে আনে।
শর্মিলা কানবা লুপ (শর্মিলা বাঁচাও গোষ্ঠী) এর কর্মীদের অভিযোগ; অনশন ধর্মঘট বন্ধ করার পূর্বে শর্মিলা তাদের সঙ্গে কোন পরামর্শ করেন নি, যা তাদের হতাশ এবং ব্যথিত করেছে। ওদিকে, মনিপুরী বিচ্ছিন্নতাবাদী সামাজিক ঐক্যজোট ‘কাঙ্গলেইপাক’, সনির্বন্ধ অনুরোধ জানায় তাঁর পুরুষবন্ধুকে (ইংরেজ বংশদ্ভুত জনৈক ভারতীয়) বিয়ে না করার জন্য। ভারতে তার কার্যকলাপকে সন্দেহজনক অ্যাখা দিয়ে কিছু সমর্থকের মতে, এই সম্পর্ক-ই শর্মিলাকে বিপথগামী সিদ্ধান্তটি নিতে প্ররোচিত করেছে।
The cruelty shown to Irom Sharmila is staggering. Like she cant own her own life or choices. Very Opposite of human rights she fought for
— barkha dutt (@BDUTT) August 11, 2016
ইরম শর্মিলার বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শিত হয়েছে তা বিস্ময়কর। যেন তার নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার নেই। এটা যেসব মানবাধিকার রক্ষার জন্যে তিনি লড়ে যাচ্ছেন তার বিপরীত। – বরখা দত্ত।
মণিপুরের লৌহকন্যা হিসেবে পরিচিত শর্মিলা ২০০০ সালের নভেম্বরে তাঁর এই অহিংস প্রতিবাদ শুরু করেন। তাঁর মূল দাবি ছিলো সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন (এএফএসপিএ) রহিতকরণ, যা কার্যত জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের ক্ষেত্রে যথেচ্ছাচার নীতি ব্যবহারে সরকার পক্ষকে দায়মুক্তির সুবিধা দেয়।
শর্মিলাকে ‘মনিপুরি প্রতিমূর্তি’ মনে করতেন এরকম অনেকেরই মতে অনশন ভঙ্গ এবং রাজনীতিতে প্রবেশ তাঁর সেই ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তাঁর অনশনভঙ্গের ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া হিসেবে শর্মিলা কানবা লুপ (শর্মিলা বাঁচাও আন্দোলন) সংগঠনটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়, যদিও সেটি নাকি শর্মিলার আর্শীবাদধন্য হয়েই বন্ধ হয়েছে।
Those who saying that #IromSharmila should have continued her fast are always welcome to take over from her. Any takers?
— Vikram Chandra (@vikramchandra) August 9, 2016
যারা বলছে যে ইরম শর্মিলার অনশন চালিয়ে যাওয়া উচিৎ, তারা নিজেরাই অনশন শুরু করতে পারে। কেউ কি রাজি? – বিক্রম চন্দ্র
নানা সমালোচনা এবং স্থানীয় গোষ্ঠীর উপেক্ষায় ব্যথিত শর্মিলা সংবাদমাধ্যমকে জানান:
ঐ মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিলো তাদের জন্য হয়তো সবচেয়ে ভাল হবে আমাকে পিটিয়ে মরে ফেলা। আঘাতে আঘাতে মরা আর না খেয়ে মরার মধ্যে তফাৎটা কী? খুব বেশি নয়। তারা চায় আমি আজীবন শহীদ হয়ে বেঁচে থাকি। কিন্তু আমি তো আজন্ম শহীদ হয়ে থাকতে পারি না।
নৈতিক দেউলিয়াত্বের পরাকাষ্ঠাঃ
পুরো পরিস্থিতির সারমর্ম হিসেবে হিন্দুস্তান টাইমসে মানু জোসেফ লিখেছেন:
তারা বলছে তিনি তাদের দাবির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। একসময় তারা তাঁকে মহিমান্বিত করেছে লৌহমানবী হিসেবে, কিন্তু এখন আর তিনি তা নন তাদের কাছে। সুসময়ের বন্ধুরা এবং পরিবার তাঁকে ছেড়ে গেছে। যারা তাঁকে একদা করে তুলেছিলো পুজোর সামগ্রী, তারাই এখন করছে তার তিরষ্কার। এমনকি অন্তত একটি গোষ্ঠির কাছ থেকে তিনি হুমকি পর্যন্ত পেয়েছেন।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ইরশাদ আহমেদ লেখেনঃ
ভারত মনুষ্যত্ব হারাতে বসেছে। দক্ষিণ-পূর্ব ভারত এবং কাশ্মিরের লোকেরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছে তাদের হৃদয়। সমৃদ্ধ ভারতের জন্য ব্যক্তিগত এবং সামষ্টিক অধিকার নিয়ে আমাদের অবশ্যই সচকিত হয়ে উঠতে হবে, জনমধ্যে আরো বিভক্তি তৈরীর সুযোগ আমরা রাজনীতিবিদের দিতে পারি না।
শর্মিলাকে কষ্টদানকারীদের বিরুদ্ধাচরণ করে শশীকুমার বিলাথ ফেসবুকে বলেন :
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল মানবাধিকার সংস্থা এজন্য দায়ী, যারা কোন নির্দিষ্ট সমাপ্তির লক্ষ্য ছাড়াই এরকম একটি মানবপ্রতীক তৈরি করেছে। একজন রক্তমাংসের মানুষের জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলো ভুলে গিয়ে নিজেদের প্রচারণা আন্দোলনের সুবিধার্থে এরা প্রত্যেকে ব্যবহার করেছে শর্মিলার সংগ্রামকে। সমাজের কাছে তাদের দাঁড় করানো পরিস্থিতির চিত্র ছিলো এমন যেন শর্মিলার এ অনশন অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে। যখন আমলাতান্ত্রিকতা জাতীয় এবং আইনের মানবাধিকার মান যাচাই ছাড়াই সবকিছু ঠিক করতে শুরু করে, এটাই ঘটে তখন।
ভারতীয় অভিনেতা রেনুকা শাহানে শর্মিলার প্রচেষ্টার প্রশংসা করে তাকে স্বগৃহে আমন্ত্রন জানিয়ে বলেন:
ইরম শর্মিলা, যদি আপনার কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা না থাকে, মুম্বাইতে আমার বাড়িতে চলে আসুন দয়া করে। আমি সম্মানিত বোধ করবো। ঐ সব মানবাধিকারবাদী ও এএফএসপিএ বিরোধী কর্মীরা খুশি ছিল, আমরা সমর্থনকারী ছিল ততক্ষণ-ই, যতক্ষণ আপনি শুধুমাত্র নাকে একটা নল দিয়ে সংযুক্ত তরলের ওপর ভর করে বেঁচে ছিলেন কিংবা সাহসের সঙ্গে একা রাজ্যসরকারের ক্রোধের মোকাবেলা করছিলেন। এদের নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তার কিছু নেই। আপনি এখনও সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন (এএফএসপিএ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন, আপনি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তিকে, যাকে আপনি ভালোবেসে নিজে মনোনীত করেছেন। আপনি ভিন্নমতেই অভ্যস্ত। দুঃখজনক হলো এখানে ভিন্নমতপোষণকারীরা আপনারই স্বজন ও সুহৃদ।
সেটাই আসলে কঠিন এবং বেদনাদায়ক।
বিনোদনমূলক ওয়েবসাইট অ্যারেতে, সবদিক থেকে শর্মিলা যেসব অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছেন তার বিশদ বর্ণনা দিয়ে সোমা চৌধুরী জানান:
শর্মিলার প্রতিবাদ হয়ে ওঠা উচিত ভারতের জনজীবনে একটি জ্বলজ্বলে আলোকশিখার মতো। সংবাদমাধ্যমের উচিত এই জীবনকে নিঃশ্বাস নিতে দেওয়া। রাষ্ট্রের উচিত এই প্রতিবাদের নৈতিক শক্তিকে স্বীকৃত দিয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করা। কিন্তু তার পরিবর্তে সংবাদমাধ্যমগুলো তাঁকে ক্লান্ত করে তুলছে, যার ফলে শর্মিলার প্রতিবাদ মূল মাহাত্ম্য হারিয়ে জীর্ণ হয়ে পড়ছে।
যদিও শর্মিলার সাবেক সমর্থকরা মূল দাবি সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের ব্যাপারে তাঁর আন্তরিকতায় বিশ্বাস ধরে রাখতে পারতো, তাহলে পরিস্থিতি হয়তো ভিন্ন হতো।
কেউ আমাকে বলেনি ২০০০ সালের নভেম্বরে এ অনশন শুরু করতে।
আমিও প্রতিবাদে যোগ দিতে অন্যদের বিরত করেছি, কারণ আমি জানতাম একজন মহিলার পক্ষে একটি দ্বন্দ্বমুখর রাজ্যে দেশে একাধিক দায়িত্ব সামলানোটা কতো কঠিন! তারা কেন বুঝতে পারছে না এএফএসপিএ আইন রহিতকরণের লক্ষ্য থেকে আমি মোটেই বিচ্যুত হইনি?
এবং সর্বোপরি, শর্মিলা ব্যক্তিগত জীবনে কী করবেন সেটা তাঁর একান্তই সিদ্ধান্ত।