খ্যাতিমান ভারতীয় বাংলা সাহিত্যিক, মানবাধিকারকর্মী মহাশ্বেতা দেবী গত ২৮শে জুলাই, বৃহস্পতিবার কলকাতায় মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান নাট্যকার ও সাহিত্যিক বিজন ভট্টাচার্যের স্ত্রী ছিলেন।
১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি ব্রিটিশ-শাসিত অবিভক্ত ভারতের ঢাকায় জন্ম হয় মহাশ্বেতা দেবীর। একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। বাবা মণীশ ঘটক ছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত সাহিত্য আন্দোলন ‘কল্লোল’-এর অন্যতম সাহিত্যিক।
পারিপার্শ্বিক সাহিত্য আবহ আর কমিউনিস্ট চিন্তাচেতনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে জীবন শুরু করেছিলেন সাংবাদিক হিসেবে। পরবর্তীতে আদিবাসী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন।
১৯৫৬ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘ঝাঁসির রানী’ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য কাজ করে বিখ্যাত হন।
The woman who walked with the broken and refused to sit with the ‘great'! Writer Mahasweta Devi passes away in Kolkata. What a life !!!!
— Mahesh Bhatt (@MaheshNBhatt) July 28, 2016
এই মহিলা অসহায় মানুষদের পাশে থেকেছেন। তথাকথিত বিখ্যাতদের পাশে বসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী কলকাতায় প্রয়াত হয়েছেন। কী অসাধারণ জীবন ছিল তার!
তিনি ট্রাইবাল রাইটস অ্যাকশন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। এই সংগঠন বাংলা, গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রজুড়ে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতো।
গণেশ এন দেবী ২০০৪ সালে ‘সেলিব্রেটিং উইমেন: এ সিম্পোজিয়াম অন উইমেন হু মেড অ্যা ডিফারেন্স’ নামের একটি সেমিনারে অংশ নেন। সেখানে তিনি মহাশ্বেতা দেবীর সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলেন:
I had by now observed that she spared no one, in particular snobs, ministers, insincere journalists and literary aspirants. […] She spoke of the civilizational graces of the adivasis, of how our society had mindlessly destroyed the culture of our great continent, and how the innocents had been brutalised. She described the context in which the infamous Criminal Tribes Act, 1871 was introduced, the process of denotification in 1952 and the plight of the nomadic communities in India ever since.
আমি দেখেছি যে তিনি কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না, বিশেষ করে নাক উচ্চ মহলের লোকজন, মন্ত্রী, অনৈতিক সংবাদকর্মী, কাউকে না। […] তিনি আদিবাসী সভ্যতার মাধুর্য নিয়ে কথা বলতেন। আমাদের সমাজ কীভাবে উপমহাদেশের মহান সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে, নিরীহ মানুষরা কীভাবে বর্বরতার শিকার হয়েছে সে সম্পর্কে বলতেন। ব্রিটিশ শাসকদের করা কুখ্যাত আদিবাসী আইন ১৮৭১, ১৯৫২ সালে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া, ভারতের বিভিন্ন যাযাবর ও সাপুড়ে সম্প্রদায়ের দুর্দশার কথা তিনি তুলে ধরেছেন।
দ্রৌপদী, একটি ছোটগল্প
দ্রৌপদী হলো মহাভারতের অন্যতম কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। দ্রৌপদীর স্বামী যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় দ্রৌপদীকে বাজি ধরে। তার আগে অবশ্য খেলায় বাজি ধরে সবকিছু হেরে ছিল। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি রেখে তাঁকেও হারায়।
বিজেতা পক্ষ সবার সামনে দ্রৌপদীকে টেনেহিঁড়চে বিবস্ত্র করে। এসময় কৃষ্ণ ধর্মরূপে অবতীর্ণ হয়ে অদৃশ্য থেকে বস্ত্ররূপে দ্রৌপদীকে আবৃত করতে লাগলেন। এর ফলে দ্রৌপদী সবার সামনে অপমানিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়।
Mahasweta Devi's Draupadi – still chillingly relevant, when you remember the adivasi women raped and killed by… https://t.co/P21v1uwLXL
— Kavita Krishnan (@kavita_krishnan) July 31, 2016
আপনি যখন আদিবাসী নারী ধর্ষণ ও হত্যার কথা মনে করবেন, তখন মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’ গল্প প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।
মহাশ্বেতা দেবী মহাভারতের দ্রৌপদীকে নতুন ভাবে রূপায়িত করেছেন তার গল্পে। সে হয়ে উঠেছে আদিবাসী নারী দোপদী মেঝেন।
তার গল্পে দেখা যায়, পুরুষরা গল্পের নায়িকাকে নগ্ন করতে সফল হয়েছে।
মহাশ্বেতা দেবী তার গল্পে শুধুমাত্র আদিবাসী নারীর দুর্দশাই তুলে ধরেননি; পাশাপাশি তিনি সমাজের জাতিভেদপ্রথা জাঁতাকলে নারীরা কীভাবে নিষ্পেষিত হয়, সারা দুনিয়া নারীকে গ্রহণ করে তার চিত্রও তুলে ধরেছেন।
দোপদিকে যখন উলঙ্গ করা হয়, তখনও সে শক্তিমত্তার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
Draupadi who tears up the rags they throw at her and flings them away, flaunting her nakedness in Senanayak’s face:
Draupadi comes closer. Stands with her hand on her hip, laughs and says, The object of your search, Dopdi Mejhen. You asked them to make me up, don’t you want to see how they made me?
দোপদি ন্যাকড়া দিয়ে তার চোখের পানি মোছে। তারপর ন্যাকড়া আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সোজা সেনানায়কের দিকে হেঁটে আসে। এরপর সেনানায়কের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু এ কি। দোপদি উলঙ্গ:
দোপদি আরো কাছে আসে। কোমরে হাত রেখে দাঁড়ায়, হাসে ও বলে, তুর সাঁধানের মানুষ, দোপ্দি মেঝেন। বানিয়ে আনতে বলেছিলি, তা কেমন বানিয়েছে দেখবি না?
গায়ত্রী স্পিভাক এই গল্পের ইংরেজি ভাষান্তর করেছেন। সেখানে দেখা যায়, দোপদি কাপড় পরতে অস্বীকার করছেন। সে বলে, “হেথা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরাতে দিব না। আর কি করবি?” এভাবেই সে সেনানায়ককে অপমান করে।
দুই দশকের বেশি বিস্তৃত মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যিক জীবন। এই সময়ের মধ্যে তিনি দেশের মানুষের জন্য অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রেখে গেছেন।
তার লেখালিখি আগামীদিনের ভারতীয় লেখকের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
প্রয়াত লেখকের জন্য সমবেদনা
তার মুত্যুতে সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন সংগঠনের পাশাপাশি কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা টুইটারে শোক প্রকাশ করেছেন।
“Draupadi”, “Hazaar churasir ma”–must read from the mighty #MahaswetaDevi . RIP https://t.co/tSmhObIzZd
— Sagarika Ghose (@sagarikaghose) July 28, 2016
মহাশ্বেতা দেবী’র ‘দোপদি’, ‘হাজার চুরাশির মা’ সবার জন্য অবশ্য পাঠ্য।
Withher passes an era of public intellectuals who stood for marginalised n oppressed n gave them a voice. A living legend RIP #MahaSwetaDevi
— Medha Patkar (@medhanarmada) July 28, 2016
তার সাথে সাথে একটি জন-বুদ্ধিজীবী যুগের অবসান হলো। তিনি শোষিত, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাদের হয়ে কথা বলেছিলেন। একজন জীবন্ত কিংবদন্তী চলে গেছেন।
Writers will come and writers will go but there will never be another Mahasweta Devi . Great writer, great activist , great human being .
— Javed Akhtar (@Javedakhtarjadu) July 28, 2016
লেখক আসবেন, চলে যাবেন। কিন্তু একজন মহাশ্বেতা দেবী আর কখনো আসবেন না। তিনি মহান লেখক, মানবদরদী, মহৎ প্রাণ মানুষ।
RIP Mahasweta Devi. A terrible loss for literature. A great writer and extraordinary activist; a woman with a warm, generous heart.
— Amitav Ghosh (@GhoshAmitav) July 28, 2016
বিদায় মহাশ্বেতা দেবী। সাহিত্যের জন্য অপুরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি মহান লেখক, অসীম সাহসী মানবাধিকারকর্মী; উষ্ণ, মহৎ হৃদয়ের নারী।