স্পারটাথ্লন, যেখানে মহৎ খেলোয়ারসুলভ মনোভাব বিনম্রভাবে বিরাজ করে

A sign near the Spartathlon venue. Photo by Sarah Murray on Flickr. CC BY-SA 2.0.

স্পারটাথ্লন অনুষ্ঠানের কাছাকাছি একটি নিশানা। ফ্লিকারে সারাহ্‌ মারে'র দেয়া ছবি। CC BY-SA 2.0.

২৫ এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর গ্রীসে স্পারটা‘র একটি ছোট শহরে ৩৩তম বার্ষিক স্পারটাথ্লন দৌড় অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেটি একটি অতি ম্যারাথন যেখানে দৌড়বিদরা এথেন্সের আক্রোপোলিস পাহাড় থেকে দৌড় শুরু করে করিন্থ, নেমিয়া, লিরকিয়া, পার্থেনিও পর্বত, নেসতানি এবং তেগিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি পথ ধরে অবশেষে স্পারটাতে লিয়নিডাস-এর মুর্তির সামনে এসে উপস্থিত হয়। এই অতি ম্যারাথনটি ম্যারাথন দৌড়ের প্রতিযোগিতার চেয়ে কম পরিচিত হলেও প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত শত দৌড়বিদ এতে অংশগ্রহণ ও প্রতিযোগিতা করার জন্য এসে জড়ো হন। এ'বছর মোট ৩৮৭ জন অংশগ্রহণকার দৌড়বিদের মধ্যে ১৭৪ জন শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছাতে পেরেছেন।

যে ইতিহাস এই দৌড়'এর অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে

৪০৯ খ্রীষ্টপূর্বে ম্যারাথনের যুদ্ধের সময় পার্শীদের সাথে একটি লড়াইয়ে সাহায্যের সন্ধানে ফেইডিপ্পিডিস নামের একজন এথেনীয় বার্তাবাহকে স্পারটাতে পাঠানো হয়।

শহরে অবস্থান করে সাধারণ জনতা সর্বপ্রথম স্পারটাতে পাঠায় রাজদূত ফেইডিপ্পিডিসকে, একজন এ্যাথেনীয় ও দূর-পাল্লার দৌড়বিদ যে এটিকে তার নিজের ভ্রমণ হিসেবে ধরে নিয়ে করেছে। […] এই ফেইডিপ্পিডিস এথেন্স শহর ছাড়ার পর দিনই স্পারটাতে গিয়ে পৌঁছায়, যে সময়ে সাধারণ জনতা তাকে পাঠিয়েছিল…

হিরোডোটাস। ইতিহাস। এ ডি গডলি অনূদিত। কেমব্রীজ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় মূদ্রণখানা। ১৯২০

CGgUivhW0AAtQkl

স্পারটাতে স্পারটাথ্লন বিজয়ীদের নামযুক্ত স্মৃতিসৌধ। উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া ছবি।

হিরোডোটাস-এর ইতিহাস -এ উল্লেখিত উপরের এই পঙতিটি প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসের ছাত্র, ও দূর-পাল্লার দৌঁড়বিদ একজন গ্রীকদরদী ব্রিটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার জন ফোডেনকে বিষ্ময়ে ভাবিয়ে তোলে যে আধুনিক কালের একজন মানুষ কি আসলেই এথেন্স থেকে যাত্রা করে মাত্র দুই দিনে ২৪৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্পারটায় পৌঁছাতে পারে।

হিরোডোটাস-এর ঐতিহাসিক বর্ণনা সাথে যতদূর সম্ভব মিল রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেইডিপ্পিলিস-এর ভ্রমণপথ পুনর্নির্মাণ করা ও সে পথে দৌড়ানোর জন্য ১৯৮২ সালে রাজকীয় বিমান বাহিনীর আরও চারজন সহকর্মীর একটি দল সাথে নিয়ে ফোডেন এথেন্সে আসেন। ১৯৮২ সালের অক্টোবরের ৯ তারিখে ৩৬ঘন্টা দৌড়ানোর পর জন ফোডেন ও তার আরও দুই সহকর্মী স্পারটাতে লিওনিডাস-এর মূর্তীর সমাপ্তী রেখার কাছে পৌঁছে প্রমান করেন যে একজন মানুষ বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে সত্যিই এই দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।

ফোডেন'এর এই সাফল্যর উপর ভিত্তি করেই ‘স্পারটাথ্লন’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যাকে ‘পৃথিবীর সবথেকে কষ্টসাধ্য দৌড়’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, যেমনটি ম্যারাথনের আনুষ্ঠানিক সাইটটি বর্ণনা করছে:

[It] runs over rough tracks and muddy paths (often it rains during the race), crosses vineyards and olive groves, climbs steep hillsides and, most challenging of all, takes the runners on the 1,200 meter ascent and descent of Mount Parthenio in the dead of night. This is the mountain, covered with rocks and bushes, on which it is said Pheidippides met the god Pan. In 2,500 years man has had no impact at all. There is still no pathway over the mountain that is swept by strong winds with temperatures as low as 4°C.

[এটি] রুক্ষ ও কর্দমাক্ত পথের উপর (দৌড় চলাকালীন সময়ে প্রায়শই বৃষ্টি হয়) দিয়ে যায়, আঙ্গুরবাগান ও জলপাই বাগানের মধ্যে দিয়ে যায়, খাড়া পাহাড়ের পার্শ্বদেশ উঠে যায়, এবং সবথেকে কষ্টোসাধ্য হলো এটি দৌড়বিদদেরকে মধ্যরাতে পার্থেনিও পর্বতের উপর ১,২০০ মিটার উপরে উঠিয়ে নামিয়ে নিয়ে আসে। পাথর ও ঝোপঝাড়-এ ভরা এটিই সেই পর্বত যেখানে ফেইডিপ্পিডিস দেবতা প্যান-এর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন বলে বলা হয়। ২,৫০০ বছরেরও মানুষের উপর কোন প্রভাব পড়েনি। পর্বতের উপর দিয়ে এখনো কোন পথ নেই যা ৪° সেলসিয়াস পর্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রাসহ তীব্র বাতাসে উড়িয়ে নেয়।

#গ্রীস – ফেইডিপ্পিডিস (ফিলিপ্পিডিস)-এর মূর্তি – ২৬-মাইল #ম্যারাথন এবং ১৫৩ মাইল #স্পারটাথ্লনের পিছনে অনুপ্রেরণা

অংশগ্রহণ করার ধারণা

এই দৌড়টি সেপ্টেম্বরের শেষ শুক্রবার ভোর ৭:০০টার সময় অনুষ্ঠিত হয়, কারণ হিরোডোটাস তার বর্ণনায় এই ঘটনাটিকে বছরের সেই সময়েই ঘটেছে বলে উল্লেখ করেছেন। লক্ষ্য হচ্ছে সর্বমোট ৭৫টি সময় নিয়ন্ত্রণ চৌকী কাটিয়ে ৩৬-ঘন্টা সময়ের মধ্যে পুরো পথটি অতিক্রম করা। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, এবং অষ্ট্রেলিয়া থেকে আসা দৌড়বিদরা এখানে অংশগ্রহণ করার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত হতে বছরের পর বছর ধরে অনুশীলন করেন, কিন্তু ম্যারাথনটি সবথেকে চৌকশ খেলোয়াড়েরও সহ্য সীমার উপর চাপ ফেলে।

চুড়ান্ত পর্যায়ের শেষ দিকে যখন তীব্র ক্লান্তি তাদের কৃতিত্বগুলোকে চেপে ধরে তখন প্রায়শই দৌড়বিদরা কল্পিত বস্তু দেখে ও সময় ও বাস্তবতার সকল জ্ঞান হারিয়ে ফেলে বলে জানা যায়। অনেকেই এটিকে ‘স্বয়ংক্রিয়-চালক দ্বারা দৌড়ানো’ মানে তাদের নিজেদের দেহের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকা হিসেবে বর্ণনা করে থাকে। গড়ে প্রতি ৩জনে ১জন বাস্তবিকভাবে এই দৌড় শেষ করে থাকে। নীচের এই ভিডিও প্রামান্যচিত্রটিতে স্পারটাথ্লন-এ দৌড়ানো খেলোয়াড়দের অবসাদ ও অঙ্গীকার কতখানি তা দেখা যাবে:

কিন্তু এই সমস্যাগুলো সত্বেও সারা পৃথিবী থেকে দূর-পাল্লার দৌড়বিদরা ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করার স্বপ্ন দেখে এবং এই দৌড়ের চাহিদাগুলো পূরণ করার জন্য কঠোর অনুশীলন করে।

এটি আমার স্বপ্ন! কিন্তু আমি জানি না আমি কখনো এই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারবো কিনা। এথেন্স–স্পারটা: ২৪৬ কিমি

#স্পারটাথ্লন-এ স্বপ্নের জায়গা নিশ্চিত করা হয়েছে। এখনো মেঘের রাজ্যে ভেসে আছি 🙂 সম্পূর্ণ মনোযোগ, সম্পূর্ণ অঙ্গীকার – অপেক্ষা করতে পারছি না!

এক দিন…শীঘ্রই, ইনশাল্লাহ

দেখুন! আজকে #স্পারটাথ্লন-এর প্রাক্কালে আমার শেষ উষ্ণ যোগব্যায়াম। আইসল্যান্ডে উত্তাপ ও আদ্রতার জন্য প্রশিক্ষণ নেওয়া খুবই চ্যালেঞ্জপূর্ণ!

এথেন্স-এ সূর্যাস্ত। আর এক ঘুম!

কিম্বদন্তীতে পরিণত হওয়া

১৯৮৩ সালের প্রথম স্পারটাথ্লন বিজেতা ইয়ানিস কুরোস যিনি সর্বমোট ৪বার অংশগ্রহণ করেছেন এবং প্রতিবারই বিজেতা হয়েছেন, তিনি আজকের দিন পর্যন্ত নুন্যতম সময়ে ম্যারাথন জয় করার কৃতিত্ব ধরে রেখেছেন (২০:২৫:০০, ২০ঘন্টা এবং ২৫ মিনিট) এবং তাকে ‘চিরন্তন দৌড়’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে চিত্রায়ন করা হয়েছে।

যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে তিনি কিভাবে এই অসম্ভবকে সম্ভব করলেন, তখন কুরোস উত্তর দিলেন:

When other people get tired, they stop. I DON'T. I take over my body with my mind. I tell it that it's not tired and it listens.

যখন অন্য ব্যক্তিরা ক্লান্ত হয়, তারা থেমে যায়। আমি থামি না। আমি আমার মন দ্বারা আমার দেহকে নিয়ন্ত্রণ করি। আমি এটিকে বলি যে এটি ক্লান্ত নয় এবং এটি সে কথা শোনে।

২০১৫ সালের স্পারটাথ্লন বিজেতা হলেন জার্মানী থেকে আগত ফ্লোরিয়ান রয়্‌স, গত বছর ও ২০১৩ সালের দ্বিতীয় স্থান অধিকারী।

দৌড়ের অগ্রগামী ফ্লোরিয়ান রয়্‌স – জার্মানী

চতুর্থ স্থানে শেষ করা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাটালিন ন্যাগি নারীদের একটি নতুন কৃতিত্ব গড়েছেন।

কী নৈপুন্য! ২৫.০৭.১৩ সময়ের মধ্যে সকলের মধ্যে ৪র্থ হয়ে ক্যাটালিন ন্যাগী নারীদের একটি নতুন কৃতিত্ব গড়েছেন।

২০১৫ স্পারটাথ্লনের সমাপ্তী রেখা পাড় হতে পেরেছেন ৩০জন গ্রীক খেলোয়াড়, যাদের মধ্যে নিকোলাউস পেট্রোপুলোস'ই সর্বপ্রথম লিওনিডাস-এর মূর্তিকে স্পর্শ করতে পেরেছেন।

আমাদের দৌড়ে ২ বারের বিজেতা নিকোস পেট্রোপইলোস ১ম গ্রীক হিসেবে এই মাত্র সকলের মধ্যে ১২তম হিসেবে #স্পারটাথ্লন শেষ করলেন

দিমিত্রিস কুটিওস ৩৪:৩০এ শেষ করে আমাদেরকে তার মানবিক দিকটি দেখাচ্ছেন। তিনি এখন একজন স্পারটাথ্লেট

সমাপ্তকারীদের মধ্যে জিয়ানিস দিমোপুলোস এবং ক্রিস্টোস মাসুরাস নামের দু'জন স্পারটীয় অংশগ্রহণকারী ছিলেন, যারা তাদের অর্জনের জন্য বিশেষভাবে তাদের আদি শহরকে গৌরাবান্বিত করেছেন।

12047139_10206058655723176_4575194037215800604_n

জিয়ানিস দিমোপুলোস তার ব্যক্তিগত বিজয়ের পথে আছে। তার ফেসবুকের পাতা থেকে নেয়া ছবি।

স্পারটীয় মাসুরাস এবং স্পিরোস পাপাস একত্রে ৩৫.১০ সময়ে

দূরপাল্লার দৌড়বিদ, তাদের আত্মীয় স্বজন, এবং বন্ধুবান্ধবরা তাদের আনন্দ ও অভিজ্ঞতার কথা টুইটারে বিনিময় করে এই নিগূঢ় বার্তা পাঠিয়েছেন যে এই দৌড় বন্ধুত্বের এবং সেই সাথে সাথে শান্তির, যেখানে ধর্মিয়, বর্ণবাদী বা অন্য যে কোন ধরনের বৈষম্যের কোন স্থান নেই:

সকাল ৫.১০ এবং আমরা এথেন্স-এ ফেরত আসা শুরু করলাম

দৌড়রত একজন মহাতারকা!

ব্রিটিশ দলটি #স্পারটাথ্লনের জন্য প্রস্তুত

#স্পারটাথ্লনে ৮ম স্থান অধিকারিনী ইয়ানে ক্লাসিলা একটি নতুন ফিনদেশীয় কৃতিত্ব অর্জন করে ২৬.২৩ ঘন্টায়

ড্যান এবং লসন পরিবারকে তাদের দৌড় এবং অধ্যাবসায়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ

গ্রীসের #স্পারটাথ্লনে হেনরিক ওয়েস্টারলিন চমৎকার দৌড়েছেন – ১৫৩ মাইলের জন্য ২৬.১৯ সময়ে ৬ষ্ঠ। এই দৌড় নরকের মতো কষ্টোসাধ্য।

সব থেকে ভালটিকে শেষের জন্য রাখা হয়েছে, সবথেকে সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর মূহুর্ত্যগুলোর অন্যতম:

বইয়ের জন্য প্রথম!!!! #স্পারটাথ্লন শেষ করার পরপরই তিনি বিবাহের প্রস্তাব দেন। এই বিবাহটি চিরকাল স্থায়ী হবে!

স্পারটাথ্লনের সময়ে প্রতিটি খেলোয়ার তার নিজের শক্তিসামর্থ্য ও সীমার মোকাবেলা করে, যা এমন একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যে এটি পুরণ হলেও সকল প্রকারের আবেগের মহত্বকে ভাষায় প্রকাশ করতে অপারগ হয়। এই দৌড়ে কোন আর্থিক পুরস্কার নেই। সকল দৌড়বিদরাই এই বিষয়ে অবগত আছেন, এবং তারপরও তারা গৌরবের চুড়ান্ত পুরস্কার এবং শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারার পরিতৃপ্তির জন্য দৌড়ান। তারা একটি সাধারণ জলপাইয়ের মুকুট, এবং সেই সাথে সাথে স্পারটীয়দের কাছ থেকে তারিফের হর্ষধ্বনি ও শ্রদ্ধা জয় করেন, কারণ তারা ফেইডিপ্পিডিস-এর উত্তরসূরী হয়েছে। স্পারটাথ্লন একটি চরম শারীরিক ও মানসিক লড়াই, নিখাদ মূল্যবোধের একটি লড়াই, যা এই মহান এই প্রতিযোগীতার প্রাচীন উদ্দীপনা দ্বারা এবং এর লক্ষ্যের প্রতি ও একজন সহখেলোয়াড়ের প্রতি সম্মান দেখানোর মাধ্যমে আরোপ ও অনুপ্রাণিত করা হয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .