“নারীরা আফগানিস্তানে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবেন”: সাক্ষাত্কারে নূরজাহান আকবর

নূরজাহান আকবরের বয়স মাত্র ২২ বছর। বাড়ি আফগানিস্তানে। নারী অধিকার কর্মী। একইসঙ্গে একজন ব্লগার। বর্তমানে পড়াশোনা করছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। অনলাইন ম্যাগাজিনে, ব্লগে আফগান নারীদের নানা ইস্যু নিয়ে লেখালিখি করেন তিনি। গ্লোবাল ভয়েসেস অনলাইন সম্প্রতি তার সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ করে।

গ্লোবাল ভয়েসেস: আপনার নিজের সম্পর্কে একটু কী বলবেন?

নূরজাহান আকবর: আমার জন্ম আফগানিস্তানের কাবুলে। বেড়ে ওঠাও সেখানে। তালিবানরা ক্ষমতায় এলে আমি পরিবারের সাথে পাকিস্তানে চলে যাই। এরপর আমি আমেরিকায় চলে আসি। সেখান থেকেই স্নাতক পাশ করি। এখন আমি ডিকিনসন কলেজে [কার্লিসল, পেনসিলভানিয়া] সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছি। স্নাতক করার পর আমি দেশে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করি- নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে প্রতি গ্রীষ্মেই আমি সেখানে যাই।

২০০৮ সাল থেকেই আমি নারীর ক্ষমতায়নে কাজে জড়িয়ে পড়ি। সেসময়ে আমি আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের নারীদের সঙ্গীত নিয়ে একটি গবেষণা করছিলাম। এই অভিজ্ঞতাই আমাকে নারীদের নিয়ে চিন্তাভাবনার একটি কাঠামো গড়ে দিয়েছে। এটা আমাকে নারীদের সাথে কথা বলতে, তাদের গান-গল্প শোনার সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড়াও আমি একদল তরুণদের সাথে কাজ করি, যারা সামাজিক সংস্কার কাজে জড়িত। বিভিন্ন ইস্যুতে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে আমি তাদেরকে সাহায্য করে থাকি। ২০১১ সালে আমি ইয়াং উইমেন ফর চেঞ্জ (ওয়াইডব্লিউসি) নামের একটি সংগঠনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হই। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের সাথে কাজ করি।

নূরজাহান আকবর। ছবি: অ্যালেক্স মতিউক। অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

গ্লোবাল ভয়েসেস: নারী অধিকার নিয়ে প্রচারণায় আগ্রহী হলেন কেন?

নূরজাহান আকবর: একজন নারী হিসেবে আমি প্রায়শ: অবিচার আর বৈষম্যের শিকার হয়েছি। নারীরা যে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক এটা আমি বহুভাবেই বুঝেছি। আমাদেরকে কখনোই মানুষ হিসেবে সম্মান দেয়া হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, নারী তার নিজস্ব শক্তিতেই আফগানিস্তানের চেহারার পরিবর্তন আনতে পারে। আফগানিস্তানকে পরিণত করতে পারে একটি আধুনিক, উন্নয়নশীল জাতিতে। নারীদের এই ক্ষমতা এটা বুঝতে পেরেই আমি নারীর ক্ষমতায়নে কাজ শুরু করি। আমি চাই এই শক্তিকে ব্যবহার করতে। আমি আশাবাদী, আমার এই প্রচেষ্টা নারী-পুরুষ সবাইকে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। নারীদেরকে আমরা মানুষ হিসেবেই সম্মান করবো। মানবাধিকার থাকবে তাদেরও কাছে।

গ্লোবাল ভয়েসেস: আফগানিস্তানে নারীদের জন্য প্রচারাভিযান বিপজ্জনক হতে পারে।

নূরজাহান আকবর: হ্যাঁ, হতে পারে। তবে আমি বিশ্বাস করি, এই ঝুঁকি নেয়ার একটা কারণ আছে। আমাদের একটাই মাত্র জীবন। তাই আমাদের উচিত এই জীবনটাকে এমন কোনো কাজে ব্যয় করা যা দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আনতে পারে। আমি জানি, হুমকিই এই গল্পের একমাত্র দিক নয়। অনেক মানুষ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি যারা এই মুহূর্তে সোচ্চারভাবে বলতে পারছেন না, তারাও আমাদের সমর্থন দিচ্ছেন।

গ্লোবাল ভয়েসেস: গত এক দশকে আফগানিস্তানে নারী অধিকার নিয়ে আপনার ধারণা কী? কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন কী এসেছে?

নূরজাহান আকবর: নিশ্চয়। অনেক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে নারীদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই পরিবর্তনের পিছনে মিডিয়ার বড়ো একটা ভূমিকা ছিল।

গ্লোবাল ভয়েসেস: আপনার মতে, আফগান নারীদের ভবিষ্যৎ কী?

নূরজাহান আকবর: আমার ধারণা, আফগান নারীদের অনেক বাঁধা ঠেলেই সামনে এগুতে হবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের অধিকারের কথা বলতে হবে। বিচার ব্যবস্থায় আমাদের প্রবেশাধিকার খুব সামান্য। ২০১০ সাল থেকে মিডিয়া এবং সরকারি অফিসে আমাদের উপস্থিতি কমে গেছে। আমাদের অনেকেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেনি। কম বয়সী বেশিরভাগ নারীকেই প্রায় জোর করে বিয়ে দেয়া হয়।

যদিও এর মাঝেও আশা রয়েছে। সারাদেশের নারীরা তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছেন, অধিকার আদায়ে রাস্তায় নামছেন, সেটা নিয়ে কথা বলছেন। নারীরা এখন চাকরি নিচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করছেন, ব্যবসায় উদ্যোগ নিচ্ছেন। এই নারীরাই ভবিষ্যতে দেশের নতুন একটা চেহরা দেবে। তারা আবার খাঁচায় বন্দি হবে না।

গ্লোবাল ভয়েসেস: আফগান মিডিয়ায় নারীরা কেমন ভূমিকা রাখছে?

নূরজাহান আকবর: আফগানিস্তানের মিডিয়াতে এখন অনেক নারীই কাজ করছেন। নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন অনেক সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন এবং ওয়েবসাইট রয়েছে। সম্প্রতি, রাসটান নামে একটি নারী বিষয়ক ম্যাগাজিন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যার কাজ হচ্ছে নারী অধিকার কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র তৈরী করা। যদিও গত দুই বছরে মিডিয়াতে নারী কর্মীর সংস্থা অনেক কমে গেছে। এর কারণ হলো, নিরাপত্তার অভাব। যে সময় নারীরা সাহস নিয়ে টিভিতে মুখ দেখান কিংবা রেডিওতে কথা বলেন, আফগানিস্তানে এমন সাংবাদিকদের নিরাপত্তা খুব কম। এজন্য আমাদের এমন কিছু বিষয়ে ফোকাস করা দরকার যা আমাদেরকে কথা বলার স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাবে। সরকার যাতে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য হয় সেজন্য আমাদের জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।

গ্লোবাল ভয়েসেস: আপনি নিজেও একজন ব্লগার। কোন ব্লগের জন্য লিখেন?

নূরজাহান আকবর: আমার নিজের একটা ব্লগ আছে। ফারসিতে। তবে আমি ইউএন ডিসপ্যাচ, সেইভ ওয়ার্ল্ড ফর উইমেন ইন্টারন্যাশনাল, নেগাহ-ই-জান (নারীর ভিশন, ফারসি), রাহে মাদানিয়াত, আফগানিস্তান এক্সপ্রেস এবং আফগানিস্তান আউটলুকেও লিখি।

গ্লোবাল ভয়েসেস: আফগানিস্তানের নারীদের দু:খ-দুর্দশা তুলে ধরতে ব্লগিং কীভাবে কার্যকর মাধ্যম হতে পারে, এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

নূরজাহান আকবর: খুব কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারে। যেসব নারীরা ব্লগিং করেন, তারা তাদের নিজেদের পরস্পরে পড়তে পারেন, সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করতে পারেন। এতে করে নারীদের লেখালিখির ক্ষমতা এবং এজেন্সি কেন্দ্রিক যে লেখালিখি তার মধ্যে সংলাপের দরজা খুলে যাবে। এ তালিকায় বড়ো উদাহরণ হলো আফগান উইমেনস রাইটিং প্রজেক্ট

গ্লোবাল ভয়েসেস: আফগানিস্তানের নারী-পুরুষের জন্য আপনার বার্তা কী?

নূরজাহান আকবর: আমাদের উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে, আমাদের সকলের অংশগ্রহণ ছাড়া আফগানিস্তান তার গন্তব্যে পৌঁছুতে পারবে না। একে আমাদের নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। দেশ আমাদের সবার এই উপলদ্ধিতে আমাদের পৌছাতে হবে। এবং এই লক্ষ্যে নেতৃত্ব দিয়ে আফগানিস্তানকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে। নারীরা এই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে নারীদের বঞ্চিত করলে তা মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে। এমনকি সেটা হবে জন্মভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .