দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের বিরুদ্ধে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিজয়ের সম্মানে ১৯৫৪ সালে বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়াতে, সোভিয়েত আর্মি মনুমেন্ট নামক একটি স্মৃতিসৌধে কয়েকটি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছিল। আজ এই সব ভাস্কর্য বাম ও ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি একটি ডানপন্থী একটিভিস্ট গ্রুপ এই স্মৃতিসৌধটি ধ্বংস করা উচিত হবে কিনা, তা নিয়ে বুলগেরীয় সমাজে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে।
বুলগেরীয় ব্লগ ডিকমিউনাইজেশন লিখেছে:
[…] আমরা কে? আমরা কোথা থেকে এসেছি? আমরা কোথায় যেতে চাই? আমরা সেখানে কি ভাবে যাব?? এগুলো আসলে একটিই প্রশ্ন: আমরা কি চাই? […]
[…] সবকিছুই শুরু হয়েছে সেই দেশের সামরিক বাহিনীকে নিয়ে, যার আর অস্তিত্ব নেই। সেই দেশটি আজ আর নেই। অথবা সেই দেশটি আছে, হয়ত সেই দেশটি নতুন একটা নামে আত্মপ্রকাশ করেছে, মুখোশের আড়ালে এবং লুক্কায়িত। তা না হলে এর এত ব্যাখ্যা দাতা, কেন? কি ভাবে? অস্তিত্বহীন একটা কিছুর জন্য যত বার আমরা জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে যাই, ততবারই তা বিশাল পরিমাণ মানবিক শক্তির সমাবেশ ঘটাতে পারে? না, আমরা পেছন ফিরে না তাকালে আমরা সামনে এগুতে পারব না। […]
ডিকমিউনাইজেশন থেকে আরো কিছু লেখা:
[…] আমি কেন দখলদার সোভিয়েত ইউনিয়নকে স্মরণ করে নির্মিত ভাস্কর্য সমূহকে একটা সম্পূর্ণ শিল্প সংগ্রহশালায় স্থানাস্তর করতে চাই:
যাদের লালদের প্রতি (কমিউনিজম-এর প্রতি)আবেগ এবং সহানুভূতি আছে, আমি তাদের কাছে আরেকবার আবেদন করতে চাই। ভার্ণা নামক শহরে মৃত সোভিয়েত সেনাদের সম্মানে ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে, যারা বুলগেরিয়ার স্বাধীনতার জন্যে জীবন দিয়েছিল। সেখানে মৃত সৈনিকদের ডজন ডজন নাম আর উপাধি লেখা আছে। একজন কিশোর হিসেবে আমি ভেবে অবাক হই, এই সৈনিকেরা কিভাবে, কোথায় এসে মৃত্যুবরণ করেছে, যখন আমাদের এখানে বা দেশে কোন যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল না। বয়স্কদের অনেকে বলতো “রেড আর্মি” নামে পরিচিত সোভিয়েত আর্মির অনেক সদস্যকে চুরি, খুন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষনের অভিযোগে জীবন দিতে হয়েছে। সে সময় তরুণ ও অনভিজ্ঞদের অনেকেই কমিউনিস্ট প্রচারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। এক সময় এমনটা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু আজ আরো জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভের পর, আমি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারি, রেড আর্মিদের জন্য তৈরি করা ভাস্কর্যগুলো খুনী, ডাকাত, অগ্নিসংযোগকারী, ধর্ষক এবং অন্যান্য অপরাধীদের প্রশংসা করছে মাত্র। তারা “বুলগেরিয়ার স্বাধীনতার জন্য“ প্রাণ দেয়নি, বরং কোন দেয়াল বা রাস্তার পাশে তাদেরই সেনাদের হাতে বিনা বিচারে খুন হয়েছে, যারা ভুলক্রমে শিক্ষিত অমার্জিত অসভ্যের দ্বারা এ ধরনের কিছু কিছু বর্বর বাড়বাড়ি রকমের কাজের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিল মাত্র।[…]
বুলগেরীয় ইতিহাসবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক আন্তনি তোদোরভ তার ব্লগে লিখেছেন:
[…] এই বিতর্কটি আসলে নতুন কিছু নয়। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকবার এই ভাস্কর্যটি গুঁড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালের পর থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা সরকারগুলো এ ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থেকেছে। অবশ্য রাশিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা এ রকম কর্মকাণ্ডকে তাদের প্রতি আঘাত হিসেবে গণ্য করবে।
উভয় পক্ষের কাছে শক্ত যুক্তি আছে। যার ফলে, ঘটনা যাই হোক না কেন, প্রশ্নটি যেমন রাজনৈতিক, এর সমাধানও রাজনৈতিক। এর মানে হল, সহজেই কোন এক পক্ষে অবস্থান নেয়াই যথেষ্ট নয় (আমরা ধরে নিতে পারি উভয় পক্ষেরই কাছে যুক্তি আছে)। এটা এই অর্থে একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যে, আমরা আমাদের গোটা সমাজের জন্য যে সকল বিষয়কে বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ বলে বিবেচনা করি, প্রমাণ করতে হবে যে, তার মধ্যে এ সমস্যাটির সমাধান সবার আগে দরকার। […]
[…] তাহলে বুলগেরিয়ার কি হবে? আসল প্রশ্নটি হল, নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অর্জিত বিজয়কে আমরা সম্মান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কি না? এর উত্তর খুব সহজ নয় এবং এটা মূলত: সভ্যতার মধ্যে থেকে যাবার মত এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।[…]
জোহানেসবার্গে বসবাসকারী বুলগেরীয় নাগরিক নিকোলে সিসেভ, রাজধানী সোফিয়ায় নির্মিত সোভিয়েত আর্মি মনুমেন্টের উপর তার ব্লগ ট্রুডেন-এ মন্তব্য করেছেন:
[…] বুলগেরীয় নাগরিকরা সবসময়ই তাদের ভবিষ্যৎকে ‘বাহবা’ আর অতীতকে দেয় ‘দুয়ো'। বিষয়গুলো অনেকটাই আমাদের সবচেয়ে সাম্প্রতিক ও “সবচেয়ে গণতান্ত্রিক“ ইতিহাসের মত। আমাদের বিগত বছরগুলো যথেষ্টই দুয়োধ্বনি পেয়েছে … ওইসব নির্দিষ্ট ৪৫টি বছরের মত অতটা বেশী নয়। এই ৪৫ বছরে আমরা তাদের মিত্র ছিলাম, যারা বুলগেরিয়াকে তুর্কী আর ইউরোপীয় শাসন থেকে মুক্ত করেছিল, যারা এই দেশটিকে মুক্ত করেছিল ফ্যাসিবাদী একনায়কের হাত থেকে। প্রথমটি অর্জনের জন্যে কৃতজ্ঞ বুলগেরীয় নাগরিকরা তাদের সম্মানে এই সব স্মৃতিসৌধ বানিয়েছিল।
দ্বিতীয় কাজটিও একই ভাবে সম্মানিত হয়েছিল । আজকে আপাতদৃষ্টে হয়ত মনে হচ্ছে, এই দুই কোটি রুশ নাগরিকের জীবন দানের জন্য সোফিয়াতে, এমনকি বুলগেরিয়াতে কোন স্মৃতিসৌধের দরকার নেই। […] কেন? কারণ, আমরা এখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছি। আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যারা জীবন দিয়েছে তারা ছিল কমিউনিস্ট। […]
সোভিয়েত বিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত, প্রখ্যাত সাংবাদিক আইভো ইন্দজেভ তার নিজস্ব ব্লগে লিখেছেন:
[…] আমাদের মধ্যে যারা দ্বিধান্বিত তাদের প্রতি আমি শেষ বারের মত বলতে চাই, এই ভাস্কর্যগুলো কিসের প্রতিনিধিত্ব করে। এটা বুলগেরিয়ার ওপর রুশ সাম্রাজ্যবাদের প্রভূত্ব প্রদর্শন করে! এটা কমিউনিজমের স্মৃতিসৌধ নয়, বামপন্থী আদর্শের তো নয়ই। এটা সোভিয়েত ইউনিয়নেরও স্মৃতিসৌধ নয়, যদিও এটা সোভিয়েত আর্মির নাম ধারণ করে আছে। যদি এটা সোভিয়েত ইউনিয়নের স্মৃতিসৌধ হতো, তবে একে গুঁড়িয়ে দেয়ার ধারণাটি “সমভাবে“ প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়নটির সকল প্রাক্তন প্রজাতন্ত্রগুলোকে রাগান্বিত করে তুলত। আপনি কি মনে করেন ভাস্কর্যগুলোকে রেখে দেয়ার জন্যে এস্তোনিয়া বুলগেরিয়াকে চিঠি দিচ্ছে? এই বিষয়টিকে একটি কৌতুক মনে হতে পারে (যদিও রাশিয়ার পক্ষ থেকে কোন চিঠি মোটেই কোন কৌতুকের বিষয় নয়)।[…]
বুলগেরীয় আরেক ব্লগার পাভেল ইয়ানচেভ লিখেছেন:
[…] সোভিয়েত আর্মি মনুমেন্ট নামক ভাস্কর্যের স্থাপনাটি কোন রোমান এমফিথিয়েটার বা ২০-এর দশকের কোন ধনী ব্যবসায়ীর বাড়ি নয়। এটা তৈরী হয়েছিল (এবং এর নকশা প্রণয়ন করেছিল উন্নতমানের স্থপতিরা) অস্তিত্বহীন সুখ ও আনন্দের ধারণা এবং নির্ভেজাল কমিউনিস্ট প্রচারণার মাধ্যমে স্থানীয় শাসন ও এর আদর্শকে স্থায়িত্ব দেয়ার জন্যে। তারপরও মনুমেন্টটি ধ্বংস করার আগে আমরা ১৯৯৮ সালে গিওর্গি দিমিত্রভের সমাধি সম্পর্কিত ঘটনাটি স্মরণ করতে পারি। আমরা এমন একটি স্থাপনা সরিয়েছিলাম, যা এক ক্ষমতা পরায়ণ শাসনের প্রতিনিধিত্ব করা ছাড়া কোন কাজে আসত না । কিন্তু আমরা চিন্তা করিনি, এর পরিবর্তে আমরা সেখানে কি রাখবো। স্থাপনাটি তৈরী করার চেয়ে তা ভাঙ্গতে বেশী সময় লেগেছিল। এটাকে ভাঙ্গার সিদ্ধান্তটিও নেওয়া হয়েছিল একই ধরনের ক্ষমতা প্রদর্শন থেকে। এর জন্য কাউকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, এমনকি ওই শহরের নাগরিকদেরও না । […]
জনপ্রিয় ব্লগার মুইও, বুলগেরিয়ার সোভিয়েত ইতিহাস সম্পর্কে তার মতামত আমাদের জানিয়েছেন:
[…] হুম… আসুন, আমরা সবাই বুলগেরিয়ান রেনেসাঁর সময় স্থাপিত সমস্ত স্থাপনাসমূহ ভেঙ্গে ফেলি, কারণ ওগুলো তুর্কী প্রভুত্বের স্মৃতিসৌধ! আসুন আমরা সবাই আমাদের দেশের সমস্ত অতীত স্মৃতি ও প্রতীক মুছে ফেলি, কারণ ওগুলোর সবটাই সুখস্মৃতি নয়।
চলুন আমরা প্রশ্ন করি: কাকে আমরা কোনটা ভাল আর কোনটা নয়, আর কোনটা এবার ভেঙ্গে ফেলতে হবে। সোভিয়েত আর্মি মনুমেন্ট , না কেন্দ্রীয় হাম্মামখানা, সেটা ঠিক করার কঠিন কাজটি কাকে দেব?
যারা বিশ্বাস করে সোভিয়েত আর্মির স্মৃতিতে স্থাপিত মনুমেন্ট আজকের সোফিয়ার কেন্দ্রস্থলে অপবিত্র করছে, তারা (এবং/অথবা সার্বিকভাবে বুলগেরিয়ার জনগণ) সবাই চলুন নতুন একটি ফলক স্থাপন করি, যাতে উজ্জ্বল-আলোকিত আর বড় বড় অক্ষরে বর্ণিত হবে এই সব স্মৃতিসৌধ তৈরীর পেছনের কাহিনীর সাথে সাথে, এতে এর প্রতীকগুলো দৃশ্যমান । আসুন স্মৃতিসৌধের চারপাশে একটি যাদুঘর স্থাপন করি, যা শুধু আমাদের ইতিহাসের জন্যেই গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং আগে দেখেনি এমন অনেকের জন্যে এটি আগ্রহের বিষয়ও হবে; আমি শুধু বিদেশীদের কথা নয়, আমাদের প্রজন্মের পাশাপাশি, পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের কথাও বলছি। […]