ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা ১৯৪৭ সালে ভারত ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে সৌন্দর্যমণ্ডিত বৃহত্তর কাশ্মীর অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে ভারত, পাকিস্তান আর চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই রয়েছে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধের মাধ্যমে এই দেশগুলো কাশ্মীরের বিভিন্ন অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবী করে রেখেছে এবং তারা তাদের পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছে কাশ্মীরি জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনাকে উল্লেখ করে।
জম্মু আর কাশ্মীর অঞ্চল ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কিন্তু ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারার বলে এই অঞ্চল বিশেষ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। এটি ভারতের একমাত্র প্রদেশ যাদের নিজস্ব পতাকা রয়েছে। ১৯৮০ সালের শেষের দিক থেকে পাকিস্তানের মদদে একটি সহিংস বিপ্লব শুরু হলে এই অঞ্চলে ভারতীয় সেনা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চলতে থাকে। জম্মু আর কাশ্মীর অঞ্চলের ভারতীয় সেনাদের আর্মড ফোর্সেস অ্যাক্টের মাধ্যমে বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যার সমালোচনা অনেকেই করেছে।
কাশ্মীরে এখন উত্তেজনা টগবগ করে ফুটছে কারণ জুন মাসের প্রথম দিকে জানা যায় যে ভারতীয় সেনারা তিনজন নির্দোষ তরুণকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে মেরে ফেলে। এরপর সহিংসতা ছড়িয়ে পরে যা এই অঞ্চলের অনেক অংশকে স্থবির করে দেয়। ফলে শত শত কাশ্মীরি তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্লোবাল পোস্টে জেসন ওবারডর্ফ জম্মু আর কাশ্মীরের সাম্প্রতিক নাজুক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন:
গত মঙ্গলবার (জুলাই ৬, ২০১০) রাতে, নয়া দিল্লি কাশ্মীরের বিক্ষোভকে দমন করতে ১৯৯০ সালের পর প্রথমবারের মত সেনা মোতায়েন করে। এর আগে পুলিশের গুলি আরও তিনজন কাশ্মীরি জনতার প্রাণ কেড়ে নেয় এবং এ নিয়ে এই মাসে মোট মৃত্যুর পরিমাণ দাঁড়াল ১৫ [..]।
ফেসবুক আর অন্যান্য সামাজিক নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইটে কাশ্মীরি তরুণরা ক্ষোভে ফেটে পরছে বিশেষ করে ভারতীয় সেনাদের প্রতি।
কাশ্মীর নিয়ে যে কোন সংবাদ পড়া খুবই বিভ্রান্তিকর হতে পারে। পাকিস্তানি কোন পত্রিকার রিপোর্টে হয়ত ইট পাটকেল ছোঁড়া প্রতিবাদকে এমন শিরোনাম সহ পরিবেশন করা হবে: “কাশ্মীর স্থবির হয়ে গেছে ভারতের দখলদারিত্বের প্রতিবাদে: তারা স্বাধীনতা চায়, চায় পাকিস্তান“। অন্যদিকে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে ইট পাটকেল ছোঁড়া কে ব্যাখ্যা করা হবে শুধুমাত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কানি। এ রকমও প্রতিবেদন হয়েছে যে ভারতীয় প্রচার মাধ্যম দোষ না থাকলেও বানাচ্ছে।
এইসব ইট পাটকেল ছোঁড়া প্রতিবাদকারীদের মোকাবেলা করা ছাড়াও ভারতীয় সেনারা এখন নতুন এক ধরণের বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়েছে। প্রতিবাদকারীরা বেশি করে সামাজিক মিডিয়া টুল যেমন ফেসবুক, টুইটার, মাইস্পেস, হাইফাইভ, অর্কুট এবং কাশ্মীরের মানুষের জন্যে বিশেষ নেটওয়ার্ক কাশ্মীর ফ্রেন্ড ব্যবহার করছে। লাইভ মিন্ট এর সিমান্তিক দোবেরাহ জানিয়েছেন যে “কাশ্মীরে ইট পাটকেল ছোঁড়া তরুণরা ফেসবুকে নিবন্ধন করেছে এবং তাদের এ নিয়ে ফেসবুক গ্রুপ আছে।” দি কাশ্মীর ব্লগ স্ক্রিনশট পোস্ট করে জানাচ্ছে যে ফেসবুকে তরুণদের উস্কে দেয়ার জন্যে জিহাদি ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে।
সহিংসতা ছড়িয়ে যাবার ফলে জম্মু ও কাশ্মীরের সরকার উপত্যকা জুড়ে এসএমএস সেবা বন্ধ করে দেয় যাতে তথ্য ও গুজব না ছড়াতে পারে। কিন্তু কাশ্মীরিরা কিছুটা স্বাধীনতা পেয়েছে – তারা ফেসবুকের মাধ্যমে নিজেদের সাথে যোগাযোগ রেখেছে এবং বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান করতে পেরেছে, যেমনটি হিন্দুস্তান টাইমস রিপোর্ট করছে। অনেক সংবাদ ওয়েবসাইট যেমন কাশ্মীর ডিসপ্যাচ এবং কাশ্মীর ফেসবুক ব্যবহার করছে নেট নাগরিকদের কাছে সংবাদ পৌঁছাতে।
এইসব খবরের মধ্যে আরও শোনা যাচ্ছে যে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের পুলিশ পর্যবেক্ষণে রেখেছে। দ্যা ডেইলি রাইজিং কাশ্মীর রিপোর্ট করছে যে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ দক্ষিণ কাশ্মীরের অনন্তনাগে (পূর্বেকার ইসলামাবাদ) ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে বিশেষ করে তাদেরকে খোঁজার জন্যে যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লোকজনকে উস্কে দিচ্ছে।
এর প্রতিবাদে শ্রীনগর থেকে সাগর তার ব্লগে লিখছে “আমার কাশ্মীর: ভুলের বিয়োগাত্মক ঘটনা” এই শিরোনামে, যা কাশ্মীরিদের বেদনাকে তুলে ধরছে:
আমি প্রতিবাদ করছি সেইসব লোকের অযোগ্যতার, যারা আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলছে, আমি প্রতিবাদ করছি আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর মানবতার অভাবের জন্যে, আমি প্রতিবাদ করছি বারবার অপমানের জন্যে, আমি প্রতিবাদ করছি প্রচার মাধ্যমগুলো আমার বেদনাকে তাদের দর্শক বাড়াতে ব্যবহার করছে, আমি আমার সকল নেতাদের দূরদর্শিতার অভাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি, আমি প্রতিবাদ করছি যে কেউ এসে বিনয়ের সাথে কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চাচ্ছে না, আমি প্রতিবাদ করছি আমার কোন অপরাধ না থাকলেও আমাকে কেন বাড়ীতে বসে থাকার আদেশ দেয়া হচ্ছে, আমি সবার জন্যে প্রতিবাদ করি কিন্তু সেই কাশ্মীরির জন্যে নয়, যে টিভিতে ৫ মিনিটের জন্যে শুধু সুযোগ পায়, আমি প্রতিবাদ করি আমার বাসস্থানের বিরুদ্ধে অনুভুতি শুন্য কোন বেদরকারী মন্তব্যের বিরুদ্ধে, আমি প্রতিবাদ করছি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে শুধু একপেশে খবর ছাপানোর জন্যে…
দেশি ক্রিটিক্সে বিইং সিনিকাল এই ধর্মঘটের জন্যে রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের দায়ী করছে:
ঐতিহ্যগতভাবেই কাশ্মীরিরা নিজেদের ভারতের অন্যান্য এলাকার বাসীদের কাছ থেকে দুর মনে করে – বিশেষ করে আমাদের নীতির জন্যে এবং আমাদের রাজনীতিবিদদের কাশ্মির ইস্যুকে নিজেদের সুবিধার জন্যে জিইয়ে রাখার মনোভাবের জন্যে। আপনি যদি এই ভিডিও ফুটেজটি দেখেন তাহলে বুঝবেন যে বিশ বছরের কোঠায় তরুণদের সেনাদের প্রতি ইট পাটকেল ছোঁড়ার ব্যাপারটি দেখতেই কেমন অস্বস্তি লাগে। এ নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারবেন যে এরাই হচ্ছে সেইসব শিশু যারা কাশ্মীর যখন সহিংসতার আগুনে পুরছিল তখন জন্মগ্রহণ করেছিল। তাদের জীবন পার হয়েছে সহিংসতার মধ্য দিয়ে, বিভিন্ন নিপীড়ন, উপেক্ষা, সরকারের কার্যকারিতার অভাব এবং অবশ্যই সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম তারা দেখেছে …[..]
আমি নিশ্চিত যে সহিংস প্রতিবাদে অংশ নেয়া এইসব যুবারা হয়ত জানেও না তারা কিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে অথবা তারা ঠিক কাদেরকে ইট পাটকেল ছুঁড়ছে।
কিছু বিশ্লেষক এইসব প্রতিবাদকে ‘নতুন ইন্তিফাদা’ নামে অভিহিত করছে। ডেটলাইন শ্রীনগর ব্লগের আরজিমান্দ হুসাইন তালিব কাশ্মীরি তরুণদের এই প্রতিবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছে:
তাদের আন্দোলন স্তিমিত হবে না কারণ এই প্রজন্ম খুব গতিশীল – সারা বিশ্বজুড়ে এরা ছড়িয়ে আছে। এদের হাতে আছে প্রযুক্তি – ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ডিজিটাল ক্যামেরা, ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদি। তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে কাশ্মীরের বর্তমান ঘটনাবলি লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছে। এবং তারা এই সব ঘটনা প্রকাশ করে যাচ্ছে তাদের বলয়ের বাইরে সারা বিশ্বকে জানানোর জন্যে।
বেশ কিছু রিপোর্টে জানা যাচ্ছে যে স্থানীয় সরকার তথ্য প্রবাহকে থামাতে চাইছে (সংবাদ) প্রকাশনাকে বন্ধ করে এবং বিতরণের পূর্বেই সংবাদপত্র বাজেয়াপ্ত করে। সাংবাদিকদের প্রতিবাদ কর্মসূচী নিয়ে লিখতে দেয়া হচ্ছে না। সারা বিশ্ব এই সব ফেসবুক আর টুইটার ব্যবহারকারীদের দিকে তাকিয়ে থাকবে এই অঞ্চল থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর খবরের জন্যে। কিন্তু এসএমএস নিষিদ্ধ হবার পর জম্মু ও কাশ্মীর সরকার কি সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোকেও নিষিদ্ধ করবে – এই প্রশ্ন থেকে যায়।