কথিত আছে যে শক্তিশালী রাক্ষস মহিষাসুর একবার ইশ্বরদের সন্তুষ্ট করেছিলেন কঠোর প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে। সন্তুষ্ট ইশ্বরেরা যখন তাকে বর দিতে চাইলেন তখন তিনি অমরত্ব চাইলেন। তাকে তা দেয়া না হলে তিনি চালাকি করে বর চাইলেন যে কেবলমাত্র একজন নারী যুদ্ধে তাকে হত্যা করলে তার মৃত্যু হবে। তিনি মনে করেছিলেন যে একজন নারী তার শারীরিক শক্তির সাথে কখনো মোকাবিলা করতে পারবে না, আর তাই তিনি আসলে অমর হয়ে রইবেন। এইভাবে বরে শক্তিশালী হয়ে মহিষাসুর পৃথিবী আর স্বর্গে অরাজকতা কায়েম করলেন।
তার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে, ইশ্বরেরা তাদের সম্মিলিত বল দিয়ে শক্তিকে তৈরি করেন (আদিম, মহা জাগতিক, নারী শক্তি) যিনি একজন দেবী এবং তার বিভিন্ন রূপ। তারই একটি রূপ দুর্গা। ইশ্বরদের দেয়া অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে, দুর্গা যুদ্ধে গেলেন সিংহে চড়ে। তখন এক দীর্ঘ আর ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় যার শেষে মহিষাসুর মারা যায়। দেবী দুর্গাকে তাই ‘মহিষাসুর মর্দিনী’ (মহিশাশুরকে যে বধ করেছেন) বলা হয়। তিনি মা দেবী, সর্ব শক্তিমান যিনি সকল অশুভকে ধ্বংস করেন।
প্রাথমিকভাবে হিন্দুদের এই উৎসব বসন্তে পালিত হত। তবে এখন হেমন্তের উৎসব দেবীর মূল পূজার জাকজমককে ছাড়িয়ে যায়। হেমন্তের এই উৎসব মহাকাব্য রামায়ন অনুসারে শুরু হয়েছে সেই সময় থেকে যখন রাম তাঁর স্ত্রী সিতাকে অপহরণকারী রাবণের কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধে যাওয়ার আগে অভিবাদন জানান দুর্গা দেবীকে। যেহেতু সময়ের বাইরে দেবীর পুজা করা হয়েছিল, রামের করা দুর্গা পুজাকে ‘অকালবোধন’ বলা হয় (সময়ের আগে প্রার্থনা)।
রামের উদাহরণ অনুসারে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে দুর্গা পূজা এখন উদযাপিত হয় ৫ দিন (দুর্গা পূজা)- ১০ দিন ধরে (নবরাত্রি- যেখানে ৯ শক্তির পূজা হয়) ।
দুর্গা পূজার পেছনের মূল গল্প একই থাকলেও, দুর্গা পূজাতে (বা পূজো যেমন বাংলায় বলা হয়) বাঙ্গালীদের একটু স্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিগত ছোঁয়া আছে । বিশ্বাস করা হয় যে দূর্গা বাংলার মেয়ে আর উৎসবের এই ৫ দিনে সে তার বাপের বাড়িতে ৪ সন্তান (গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কার্তিক) আর কাছের দুই জন বন্ধু সহ বেড়াতে আসেন। তার স্বামী শিব সাধারণত: এমন সময়ে তাঁর সাথে আসেন না। তিনি স্বর্গে থেকে যান, আর তার স্ত্রী ও সন্তানদের পৃথিবীতে এসে বাঙ্গালী আত্মীয়দের কাছ থেকে সব আদর গ্রহণ করতে দেন।
কলকাতা মিউজিং বলেছেন কেন তিনি মনে করেন যে এই শহরের দুর্গা পূজাকে অন্যতম বলার যোগ্যতা আছে।
কলকাতার দুর্গা পূজায় যা আলাদা তা হল এর সৃষ্টিশীলতা, নতুন কিছু তৈরির তাগিদ। আর এই কারনে আমার মনে হবে যে কলকাতার দুর্গা পূজার হয়তো কোন তুলনা নেই।
বছরের পর বছর পূজার অলংকরণে- প্যান্ডেলের ডিজাইনে যে নকশা দেখা যায় আর প্রতিমার অলঙ্করণে (দুর্গা প্রতিমা) সবকিছুতেই সৃষ্টিশীলতা বেশ প্রকট। প্রতি বছর অনেক পুরস্কার দেয়া হয় নতুন, সৃষ্টিশীল, পরিবেশ –বান্ধব (মূল্যায়নে পারতপক্ষে নতুন মাত্রা) পূজার যা জনগণের নিরাপত্তার কথাও চিন্তা করে।
সৌরভ ধানুকা তার ব্লগে লিখেছেন:
বাঙ্গালীদের সকল আবেগের সমষ্টি দুর্গা পূজা। তার সংস্কৃতি, ভালোবাসা, একত্র থাকার যে উষ্ণতা, উৎসবের যে আনন্দ সবই আছে এতে। প্যান্ডেল তৈরীতে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে তারা অনেক আনন্দ পান।
এই বছরের পূজার বেশ কয়েকটা থিম দেখা গেছে।
নেপাল থিম: নেপাল পর্যটন বোর্ড আর নেপালের কন্সুলেট জেনারেল এর প্রশংসা করেছেন, দক্ষিণ কলকাতার এই পূজা নেপালী চিত্রকর্ম আর স্থাপত্যকে সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে, প্যান্ডেল থেকে ভক্তপুরে ইয়াকশেওয়ার মহাদেব মন্দির, আর দুর্গা মূর্তি ও চার মাথার নেপালী দেবী তালেজু ভবানি দ্বারা অনুপ্রাণিত।

নেপালী দেবী তালেজু ভবানীর দ্বারা অনুপ্রাণিত প্রতিমা। ছবি ফ্লিকার ব্যবহারকারী অনিল এম এর সৌজন্য এবং ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স এর আওতায় ব্যবহৃত।
মিশরের থিম: মিশরীয় হাইরোগ্রাফিক, প্রতিকৃতি, মূর্তি, চিত্রকর্ম আর স্থাপত্য এবারে কলকাতায় এসেছিল যা নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে:
পরিবেশ/ জলবায়ু পরিবর্তন পুজা থিম হিসাবে: এই বারে অনেকে তাদের পূজা থিমে পরিবেশ আর জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় গুলি তুলে ধরেছেন দেখে ভালো লাগল। নতুন আর সৃজনশীল শিল্পকর্ম এইসব বিষয় তুলে ধরেছে, যা আগতদের পরিবেশ সম্পর্কে আরো সচেতন করতে চেয়েছে। একটি উদাহরণ:

একটি পূজা প্যান্ডেলের বাইরে একটি বোর্ড ব্যাখ্যা করছে বিশ্ব উষ্ণায়নের মত বিষয় এবং তা ভোগ্যপণ্য পুনর্ব্যবহারে উৎসাহিত করছে
আর তাদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য ভেতরে সনাতনী সাজানোর সরঞ্জামের বদলে ব্যবহৃত হয়েছে হাতে আঁকা কাগজের মোড়ক।
এরকম আরো অনেক ছিল শহরের রাস্তা আর পুরো রাজ্যব্যাপী।
প্যান্ডেল আর প্রতিমা ছাড়াও সাজানো বাতি ছিল যা শহরকে রাতের সৌন্দর্য দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ বেরিয়ে এসেছে দিনে আর রাতে এইসব দিন উদযাপন করতে খাদ্য, পানীয় আর ‘প্যান্ডেল থেকে প্যান্ডেল’ এ ঘুরতে।
আর অবশ্য বেশ কিছু বাতিতে বার্তা জ্বলজ্বল করছিল, তা সামাজিক বা পরিবেশ সম্পর্কিত হোক।
৫ দিনের উৎসব দশমিতে শেষ হয়েছে, মুর্তি বিসর্জনের দিন। এই দিনে দেবী তার শ্বশুরবাড়ী হিমালয়ে ফিরে যান। কিন্তু তার আগে বিবাহিত নারীরা তাঁকে আর তাঁর পরিবারকে উপহার, মিষ্টি আর অনেক সিঁদুর দিয়ে বিদায় জানান দীর্ঘ আর সুখী বিবাহিত জীবনের জন্য।
এর পরে হয় সিঁদুর খেলা, বিবাহিত নারীদের একটা অনুষ্ঠান যেখানে তারা সিঁদুর (ঐতিহ্যগতভাবে সিঁদুর হিন্দু বিবাহিত নারীরা তাদের সিঁথিতে পরেন) একে অপরের কপালে দেন আর মিষ্টি, আনন্দ আর হাসি ভাগ করে নেন।
পরিশেষে সকল প্রতিমাকে নদীতে বিসর্জনের জন্য নেয়া হয়। প্যান্ডেল খুলে ফেলা হয় আর জীবন আগের মতই চলে, আর বাঙ্গালীরা সামনের বছরের অপেক্ষায় থাকেন। বিসর্জনের পরে আবার সময় আসে বন্ধু, পরিবার, প্রতিবেশীদের সাথে একত্র হওয়ার যেহেতু এটা বিজয়া দশমী, যে উৎসব দশেরার সাথে মিলে যায় যা রাবণের বিরুদ্ধে রামের বিজয়ের উৎসব।
কেবলমাত্র যে দেশব্যাপী এটা উদযাপিত হয় তাই না, দুর্গা পূজা বিশ্বব্যাপী বাঙ্গালীরা পালন করেন। এখানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে দুর্গা পূজা উদযাপনের কিছু ছবি দিয়েছেন আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার সম্পাদক, রেজওয়ান। দিথি জেনেভাতে দুর্গা পূজার কিছু ছবি পোস্ট করেছেন। জুরিখে দুর্গা পূজার উৎসব বিভিন্ন বাঙ্গালী গোত্রকে একত্র করেছে যা বিগত ছয় বছর ধরে হচ্ছে। আমি নিশ্চিত আমাদের পাঠকেরা তাদের আশেপাশে অনুষ্ঠিত দুর্গা পুজা সম্পর্কে জানবেন। কারণ যেখানে বাঙ্গালী, দুর্গা পূজা বেশী দূরে থাকতে পারে না।
এখানে আপনারা ২০০৯ এর দুর্গা পূজার আরও কিছু ছবি উপভোগ করতে পারেন। যেসব পাঠক দুর্গা পূজা সম্পর্কে আরো জানতে চান, এই সাইট মজার পাঠ হতে পারে।