কোভিড-১৯ এর বৈশ্বিক প্রভাব সম্পর্কে গ্লোবাল ভয়েসেসের বিশেষ কভারেজটি দেখুন।
বর্তমান সময়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিপদটি বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রাথমিক উদ্বেগ হবার কথা ছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে সরকার এবং দেশের রাজনীতিবিদদের সমালোচনা তাদের জন্য দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে গ্রেফতার হয়েছেন চারজন এবং আরও সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে তারা তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট ও কার্টুনের মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা এবং করোনাভাইরাস ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য আর গুজব ছড়িয়েছেন।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি, সমন্বয়হীনতা ও স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে। ১১ই মে পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৫,৬৯১ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন ২৩৯ জন মানুষ।
যে চারজন গ্রেফতার হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, লেখক মুশতাক আহমেদ, রাজনৈতিক কর্মী দিদারুল ভুইয়ান এবং ব্যবসায়ী মিনহাজ মান্নান। তাদেরকে বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর আওতায় গ্রেফতার করা হয়েছে।
জামিনের আবেদন নাকচ করে আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে গত ৬ই মে, ২০২০ এবং দিদারুল ভুইয়ান ও মিনহাজ মান্নানকে গত ৭ই মে, ২০২০ জেলে পাঠান হয়।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে যে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের মধ্যে রয়েছে “জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং করোনভাইরাস মহামারীর সঙ্ক্রান্ত বিষয়ে জাতীয় ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ এবং নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার জন্য জেনে শুনে গুজব প্রচার করা।”
আদনান আকিব টুইট করেছেন:
Would it be wrong if someone says that the authorities in #Bangladesh, equipped with Digital Security Act, launched a crackdown on those critical to the government?
Eleven people were charged with "spreading rumors and carrying out anti-government activities" yesterday!
— Adnan Akib (@iamadnanakib) May 7, 2020
কেউ যদি বলে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে হাতিয়ার করে সরকারের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করছে, সেটা কি ভুল হবে? গুজব এবং সরকার বিরোধী কার্যক্রম চালানোর অভিযোগে গতকাল ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
উল্লেখ্য, একই মামলায় উপরের চারজনের পাশাপাশি প্রবাসী সাংবাদিক, ব্যবসায়ী এবং একটি ফেইসবুক পেইজের অ্যাডমিনসহ সাত ব্যাক্তির বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগে আনা হয়েছে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস বিস্তার শুরুর পর থেকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের মত মহামারীর সময়ে এইসব গ্রেপ্তার এবং হয়রানি দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দেয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “এমন মহামারীর সময়ে শুধুমাত্র নিরাপত্তার অভাব বোধ করা ও স্বৈরাচারী সরকাররাই এভাবে কার্টুনিস্ট, সাংবাদিক এবং নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করতে পারে।”
সমালোচনার প্রতি ‘সহিষ্ণুতার অভাব’
সরকার শুরু থেকেই বলে আসছিল, করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় তাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। কিন্তু চিকিৎসকদের পিপিইর স্বল্পতা, এন-৯৫ মাস্ক কেলেংকারি ইত্যাদি ঘটনা সরকারের অব্যবস্থানার চিত্র সামনে নিয়ে আসে। তাছাড়া লকডাউনের পরিবর্তে সাধারণ ছুটির ঘোষণা জনমনে ভিন্ন বার্তা দেয়। আবার সংক্রমণ উর্ধ্বমুখী থাকা অবস্থাতেই গার্মেন্টস, কলকারখানা, রেস্টুরেন্ট, মার্কেট খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যা নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। অনেকের ধারণা, সরকারের অব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা বন্ধ করতে ও মানুষের মনে ভয়ের উদ্বেগ তৈরি করতে মামলা দায়ের করা হচ্ছে।
বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপিকা কাবেরি গায়েন বলেছেনঃ
এটা কখন হয়? সহিষ্ণুতার এমন অভাব হয়েছে যে তারা (সরকার) সমালোচনা নিতে পারছে পারছে না। যখনই কেউ ভিন্নমত পোষণ করে তখনই মামলা দেয়া হয়, তুলে নেয়া হয়
এদিকে সরকারের সমালোচনা মানেই রাষ্ট্রের বিরোধীতা নয় বলে টুইট করেছেন বিদ্যুৎ:
State and government are different. Being critique of government doesn’t mean they are against the state. It’s a shame that the government is not differentiating between them like most of the autocratic states.#Bangladesh#dailystarnewshttps://t.co/Carhduz4Xd
— Vidyut (@BeingRashedul) May 6, 2020
সরকার এবং রাষ্ট্র দু’টো আলাদা। সরকারের সমালোচনা মানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যাওয়া নয়। এটা লজ্জার ব্যাপার যে, বেশিরভাগ স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের মতো সরকার সেটা পার্থক্য করতে পারছে না।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব
অন্য অনেকের মত কার্টুনিস্ট কিশোরও ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের অব্যবাস্থপনা ও ব্যর্থতাগুলোর সনালচনা করার জন্যে।
মোঃ রাসেল তালুকদার ফেসবুকে কিশোরের আরও কার্টুন শেয়ার করেছেন এবং সেগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করেছেনঃ
People in the talk shows in the television directly and nakedly criticize the government for its policies and underperforming ministers from time to time, and compared to what they say and how they say, the cartoons of Kishore are just symbolic depiction of present realities, which can be coined with different explanations.
If the government's mechanisms are not directed to allow this sort of space to the citizen, it may be a direct violation of freedom of expression at a gross level.
টেলিভিশনে টকশোতে লোকেরা সরকারি নীতিমালা এবং ক্ষমতাসীন মন্ত্রীদের সরাসরি এবং নগ্নভাবে সমালোচনা করে এবং তারা কী বলে এবং কীভাবে বলে সেটা তুলনা করলে তো বলতে হয় কিশোরের কার্টুনগুলি এখনকার বাস্তবতার প্রতীকী চিত্র, যা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
যদি সরকারের সংস্থাগুলো নাগরিকদের এই ধরণের মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া প্রকাশকে অনুমতি না দেয় তবে এতে স্থূলভাবে বলতে বাকস্বাধীনতার সরাসরি লঙ্ঘন হয়।
রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সমালোচনা ব্যক্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে মনে করেন বেলায়েত হোসেন মামুন:
রাষ্ট্রীয় বিষয়ে সমালোচনা করা ব্যক্তির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ; এতে আপনার ক্ষতি হতে পারে… এই রকম এক বার্তা পাচ্ছি চারপাশে… কী দুঃখজনক নিমজ্জন…
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার বাড়ছে
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা এবং গ্রেফতার বাড়ছে। জানুয়ারি ১ তারিখ থেকে মে মাসের ৬ তারিখ পর্যন্ত ৬০টি মামলা হয়েছে। আর এই মামলায় ২২ জন সাংবাদিকসহ ১১০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সারাদেশে মামলার সংখ্যা ছিল ৬৩টি। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল ১৯ এর গবেষণা প্রতিবেদন থেকে মামলার এই সংখ্যা জানা গেছে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হয় বিতর্কিত আইসিটি আইনকে প্রতিস্থাপন করে। এই আইন নিয়ে শুরু থেকেই তীব্র সমালোচনা ছিল।
বাম রাজনৈতিক কর্মী ফিরোজ আহমেদ বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতা কখনো এতো বাধার মুখে ছিল না উল্লেখ করে লিখেছেন:
মনে হয় না বাংলাদেশের ইতিহাসে বাকস্বাধীনতা কখনো এত বেশি বাধার মুখে ছিল। [..] ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাউকে দোষারোপ করবার কিছু নাই, জনগণের সংগঠনগুলো যদি শক্তিশালী না হয়, কথা বলবার সংস্কৃতিটা কারও কারও ব্যক্তিগত সাহস হিসেবেই থাকবে, সমাজের স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত হবে না।
এদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়, এমন পোস্ট, ছবি, অডিও বা ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে পরিপত্র জারি করেছে সরকার। গত ১৮ই এপ্রিল সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগও ডাক্তার, নার্সদের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলার ব্যাপারে নানা বিধি নিষেধ আরোপ করে।
যদিও সরকার শুরু থেকে বলে আসছে, কাউকে হয়রানি করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়নি। অনলাইনে কেউ যাতে হয়রানি এবং মিথ্য তথ্যের শিকার না হোন, সেজন্য এই আইন করা হয়েছে।