ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ক্ষমতায় ফেরার সিঁড়ি?

A flag displaying the text in Hindi - Bharat Jodo Nyay Yatra (India Unity and Justice March). Image via Wikipedia. Public Domain.

একটি পতাকা হিন্দিতে লেখা “ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা” (ভারত ঐক্য ও ন্যায়বিচার মিছিল) প্রদর্শন করছে। উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে পাওয়া ছবিপ্রকাশ্য ডোমেন

ভারতের পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন সন্নিকটে, আর মাত্র কয়েক মাস বাকি, রাজনৈতিক দলগুলি পরবর্তী সরকার গঠনের জন্যে নির্বাচনী দৌড়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ আসন্ন নির্বাচনে একটি সুবিধা লাভের আশায় অযোধ্যা শহরে হিন্দু দেবতা রামের উদ্দেশ্যে একটি বিতর্কিত মন্দিরের অভিষেক অনুষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে তার প্রচারণা শুরু করেছে। মূল বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (আইএনসি), বিজেপিকে মোকাবেলা করার জন্যে ব্যাপকভাবে “ইন্ডিয়া” নামে পরিচিত ভারতীয় জাতীয় উন্নয়ন অন্তর্ভুক্তিমূলক জোট নামে একটি জোট গঠন করেছে। এছাড়াও আইএনসি নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্যে জনগণের মধ্যে দলের জনপ্রিয়তা বাড়াতে একটি প্রচারণা পথচিত্র তৈরি করেছে।

আইএনসি ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৩ ভারত জোড়া ন্যায় যাত্রা (ভারত একতা ও ন্যায়বিচার মার্চ) ঘোষণা করে। এই আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচার সমাবেশটি আইএনসি’র প্রাক্তন সভাপতি ও ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর প্রপৌত্র রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে, যার পরিবার সর্বদা আইএনসি-এর নেতৃত্ব দিয়েছে৷ পূর্ববর্তী ভারত জোড়ো যাত্রার (ভারতীয় ঐক্য মিছিল) ধারাবাহিক এই পদযাত্রাটি বিভিন্ন বিশেষ করে আগের যাত্রাটিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকা ভারতের রাজ্য ভ্রমণের জন্যে পরিকল্পিত। ভারতের পূর্ব থেকে দক্ষিণ অঞ্চলের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এই পদযাত্রার লক্ষ্য তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও ২০২৪ সালের এপ্রিলে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি করা।

#রাজনীতি | মণিপুর থেকে শুরুর সময় রাহুল গান্ধী ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রাকে ‘শান্তি আনার প্রতিশ্রুতি’ বলেছেন

যাত্রাটি মণিপুরের থৌবাল থেকে মুম্বাই পর্যন্ত ১১০টি জেলা স্পর্শ করে ৬,৭০০ কিলোমিটার কভার করবে।

পদযাত্রাটি ৬৬দিন ধরে ভারতের ১৫টি রাজ্যের ৬,৭০০ কিলোমিটারেরও বেশি জুড়ে বিস্তৃত। পূর্ববর্তী ভারত জোড়ো যাত্রার বিপরীতে এই সফরটিতে পদব্রজের সাথে বাস ভ্রমণ থাকবে। যাত্রাটি প্রাথমিকভাবে ভারতের জনগণের জন্যে তিনটি ন্যায় নীতি: সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচারের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।

এই পদযাত্রাটি রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার মোট ৫৪৫টির মধ্যে ৩৫৫টি নির্বাচনী এলাকা (৬৫ শতাংশ আসন)  কভার করে। বিজেপি ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৩৫৫টি আসনের মধ্যে ২৩৬টিতে জিতেছে।

মণিপুরে ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা শুরু হয়েছে

উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্যের থৌবাল জেলা থেকে ১৪ জানুয়ারি পদযাত্রা শুরু হয়। রাজ্যটি ২০২৩ সালের মে থেকে আন্তঃ-সম্প্রদায়িক সহিংসতায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। মূলত রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল থেকে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিজেপি-নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার এই পদযাত্রার অনুমতি প্রত্যাখ্যান করে।

মণিপুরে সমাবেশ চলাকালে গান্ধী সাম্প্রতিক সহিংসতার সম্মুখীন এবং ঐক্য ও শান্তি চাওয়া অনেক এলাকা অতিক্রম করেছেন। ২০২৩ সালের মে মাসে মণিপুরে প্রধান হিন্দু মেইতি সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘু খ্রিস্টান কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত উত্তেজনা জনিত সংঘাতে প্রায় ৬০,০০০ লোক বাস্তুচ্যুত হয় এবং শত শত প্রাণহানী ঘটেছে।

গান্ধী মণিপুরে অসংখ্য মানবাধিকার কর্মী ও অন্যান্য অংশীজনদের সাথে কথা বলে তাদের অভিযোগ শোনেন। তিনি সহিংসতা শুরুর পর থেকে রাজ্যে না আসার জন্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও সমালোচনা করে ভূক্তভোগীদের শান্ত করার পরিবর্তে ভোগান্তির সুযোগ দেওয়ার দায়ে অভিযুক্ত করেন।

পরে তিনি ইউটিউবে মণিপুরের মানবাধিকার কর্মীদের সাথে তার সম্পৃক্ততার একটি ভিডিও পোস্ট করেন:

মিছিলটি নাগাল্যান্ডে প্রবেশ করে

যাত্রাটি দুই দিনের ব্যবধানে ২৫৭ কিলোমিটার কভার করে ১৫ জানুয়ারি নাগাল্যান্ড রাজ্যে প্রবেশ করে। নাগাল্যান্ডে, গান্ধী অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কথা বলেন; জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও পার্বত্য গ্রামাঞ্চলে উচ্চ মানের শিক্ষা, হাসপাতাল ও বিদ্যুতায়নের মতো প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের উপর মনোনিবেশ করেন।

রাহুল নাগা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থতার জন্যে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিরও সমালোচনা করেন। এটি রাজ্যের বিদ্রোহ অবসানে ভারত সরকার ও নাগাল্যান্ডের জঙ্গি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক পর্ষদের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি। বছর পেরিয়ে গেলেও চুক্তি অনুসারে নাগাল্যান্ডের জনগণের প্রতি ভারত সরকার তার প্রতিশ্রুতিগুলি এখনো পূরণ করেনি। বছরের পর বছর বিদ্রোহের পর রাজ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনার সৃষ্টি করা এই চুক্তির বাস্তবায়ন নাগাল্যান্ডের জনগণের জন্যে তাৎপর্যপূর্ণ।

আসামে প্রতিরোধ

সমাবেশটি ১৮ জানুয়ারি আসামে প্রবেশের পর রাজ্যে রাহুল তার সফরের দীর্ঘতম সময় ৮ দিনে ৮৩৩ কিলোমিটার দূরত্ব কাভার করেন।

আসামে বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার বেশ কয়েকটি প্রস্তাবিত রুটে বিধিনিষেধ আরোপ করায় মিছিলটি ধারাবাহিক বাধার মুখে পড়ে। কংগ্রেস রাজ্যের রাজধানী গুয়াহাটি শহরের মধ্য দিয়ে সমাবেশটি নিয়ে ঢুকতে চাইলে যানবাহন ও হাসপাতালে জরুরি অবস্থার মতো কারণ দেখিয়ে তা অস্বীকার করা হয়

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এই পদযাত্রাকে “মিয়াঁ যাত্রা” বলে তকমা দিয়েছেন। সাধারণত আসাম রাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রেণিভূক্ত করে “মিয়াঁ” শব্দটি রাজ্যের মুসলমানদের লক্ষ্য করে একটি অবমাননাকর শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুখ্যমন্ত্রীর ধারণা ছিল সমাবেশটি প্রধানত শুধু মুসলিম ভোটারদের আকর্ষণ করবে।

আসামের লখিমপুর জেলায় নির্ধারিত সমাবেশের আগে ১৯ জানুয়ারি রাতে বিজেপির যুব শাখা ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার (বিজেওয়াইএম) অনেক সদস্য আক্রমণ করে মিছিলের ব্যানার ও পোস্টারগুলি ছিঁড়ে ফেলে। আইএনসি আরও দাবি করেছে যে বিজেপির সদস্যরা তাদের অনেক সদস্য এবং তাদের গাড়িতে হামলা করে। আসাম প্রদেশ যুব কংগ্রেস (আইএনসি রাজ্য যুব শাখা) ফেসবুকে লখিমপুর ঘটনার একটি ভিডিও ভাগাভাগি করেছে।

একইভাবে ২১ জানুয়ারি আসাম প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি ভূপেন বোরাহ বিজেপি সমর্থকদের সাথে সংঘর্ষে আহত হন

ভারতীয় শিক্ষাবিদ অশোক সোয়াইন এক্সে পোস্ট করেছেন:

সকল হুমকি ও মামলা সত্ত্বেও আসামে রাহুল গান্ধীর কথা শোনার জন্যে হাজার হাজার লোক তার #ভারতজোড়োন্যায়যাত্রায় জড়ো হলে রাম মন্দির নাটক করেও মোদি এখনো তার পুনর্নির্বাচন নিয়ে উদ্বিগ্ন!

রাহুল গান্ধী ২২ জানুয়ারি নগাঁও জেলার বাত্রদেব মন্দির দেখতে গেলে মন্দির প্রশাসন বিকাল ৩টার আগে মন্দিরে তাকে প্রবেশ করতে না দিয়ে, দাবি করে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের পবিত্রতার জন্যে চলমান উদযাপন উভয় পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।

কংগ্রেস ও রাহুল গান্ধী ২৩ জানুয়ারি সমাবেশের জন্যে গুয়াহাটিতে প্রবেশ করতে গেলে আসাম পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে তাদের বাধা দেয়। কংগ্রেস কর্মীরা কিছু ব্যারিকেড ধ্বংস করায় পুলিশ ও তাদের মধ্যে বড় ধরনের হাতাহাতি ঘটে।

পরে সেইদিনই আসামের মুখ্যমন্ত্রী আসাম পুলিশকে গান্ধীর বিরুদ্ধে মামলা নথিভুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে তাকে গ্রেপ্তারের হুমকি দেন।

তবে অভূতপূর্ব জনসমর্থনে গুয়াহাটির পরের মিছিলটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়। গান্ধী ২৪ জানুয়ারি আসামের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ধুবরিতে একটি বিশাল সমাবেশে ভাষণ দেন। পুরো যাত্রায় গান্ধী আসামের মুখ্যমন্ত্রীকে ভারতের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত মুখ্যমন্ত্রী দাবি করে আসামের জনগণের কাছে বিচারের আবেদন করেন।

পশ্চিমবঙ্গে সমাবেশ

সমাবেশটি ২৫ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করে দুই দিনের বিরতি দিয়ে ২৮ জানুয়ারি পুনরায় শুরু হয়। এটি এখন পশ্চিমবঙ্গে বিহারের পথে রয়েছে। পদযাত্রাটি নতুন পবিত্র রাম মন্দির অবস্থিত রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশে সর্বাধিক সংখ্যক (১১)  দিন ব্যয় করে মহারাষ্ট্রে গিয়ে শেষ হবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .