আপনি হয়তো ফুটন্ত ব্যাঙের রূপকটির কথা জানেন। গল্পটি থেকে জানা যায় ধীরে ধীরে উত্তপ্ত জলের পাত্রে ব্যাঙটি তাৎক্ষণিক বিপদ বুঝতে না পারায় শেষ পর্যন্ত জীবিত সিদ্ধ হবে। এটি বৈজ্ঞানিক সত্যের চেয়ে বেশি পৌরাণিক কাহিনী বিবেচিত হলেও রূপকটি এখনো শক্তিশালী।
দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগতভাবে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত দেশ হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক সূচকগুলি সাধারণত এটি প্রতিফলিত করে, কোন উল্লেখযোগ্য ওঠানামা ছাড়াই স্থিতিশীল ও সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান দেখায়। তবে এই নিবন্ধটির লক্ষ্য বৈশ্বিক বিশ্লেষণে পুরোপুরি প্রতিবেদন না করা একটি সমস্যাজনক অন্তঃস্রোত গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার পরিবেশে দেশের সাম্প্রতিক অবনমন তুলে ধরা।
মে ২০২২ সালে মাসে কার্যভার গ্রহণ করা বর্তমান রক্ষণশীল সরকার বাকস্বাধীনতার উপর একটি শীতল প্রভাব তৈরি করা কৌশল প্রয়োগের অভিযোগের মুখোমুখি। অভিযোগগুলির মধ্যে প্রধান রাষ্ট্রপতি ইউন সুক ইওল, ফার্স্ট লেডি কিম কিওন হি এবং তাদের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর ছড়ানোর অজুহাতে সমালোচক সাংবাদিক ও সংবাদ সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া। প্রতিবেদনে ভিন্নমত পোষণকারী সাংবাদিকদের সংবাদ সম্মেলনে বাধা দেওয়ার এবং ইউন ও কিমের কথিত দুর্নীতির কভারেজের ভিত্তিতে মানহানি ও নির্বাচনে হস্তক্ষেপের তদন্তে অন্তর্ভুক্ত করার উদাহরণ রয়েছে। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের বাসা-বাড়ি ও অফিসে অভিযানে পর্যন্ত গড়িয়েছে।
Prosecutors raid Newstapa, JTBC over fake interview allegations https://t.co/9ZhShu6XQr
— Yonhap News Agency (@YonhapNews) September 14, 2023
ভুয়া সাক্ষাৎকারের অভিযোগে নিউজটাপা, জেটিবিসিতে অভিসংশকদের অভিযান
রাষ্ট্রপতি প্রচারণার সময় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচিত হলে তার স্বামীর বিরোধিতাকারী সকল সাংবাদিকদের কিমের কারাগারে রাখার হুমকি দেওয়া একটি ফোনালাপ ফাঁস হলে এই প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপটির পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
এছাড়াও রাষ্ট্রপতি ইউন অভূতপূর্ব সংখ্যক প্রয়োগের ডিক্রি জারি করে তার একই পদের পূর্বসূরিদের রেকর্ড ছাড়িয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ার আইনি কাঠামোতে সংবিধান সর্বোচ্চ আইন ও জাতীয় সংসদে গৃহীত আইনগুলি সাংবিধানিক মূল্যবোধকে মূর্ত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির ডিক্রির মতো প্রশাসনিক আইন এসব আইনকে কার্যকর করার জন্যে পরিকল্পিত নির্বাহী হাতিয়ার। এধরনের ডিক্রি অবশ্যই উচ্চতর আইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এবং সকল প্রশাসনিক বিষয়ে এখতিয়ারসম্পন্ন। ইউনের এই ডিক্রির ব্যবহার প্রায়শই তাকে সংসদের অনুমোদনের ক্ষমতাকে এড়িয়ে প্রভাবশালী পদে মিত্রদের নিয়োগের অনুমতি দিয়েছে। সাম্প্রতিকতম ২০২৩ সালের অক্টোবরে প্রণীত ডিক্রিটি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের কাছাকাছি মিছিল ও সমাবেশকে সীমাবদ্ধ করে।
সরকারের বিতর্কিত নিয়োগের মধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার পর্যবেক্ষণ সংস্থা কোরিয়া যোগাযোগ কমিশনের (কেসিসি) নতুন প্রধান হিসেবে লি ডং-গোয়ান এবং সরকারি অর্থায়িত জাতীয় সম্প্রচারকারী কোরীয় সম্প্রচার ব্যবস্থার (কেবিএস) নতুন প্রধান হিসেবে পার্ক মিন রয়েছে। উভয় নিয়োগপ্রাপ্তের “মতাদর্শগত পক্ষপাত” দূর করার প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি ২০২৪ সালের এপ্রিলে আসন্ন আইনসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রশাসনের “ভুয়া খবর” বিরোধী তীব্র বক্তব্যের অবস্থান আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রপতি ইউন যে দলের সদস্য সেই জনশক্তি পার্টির নেতা কিছু উদারপন্থী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের নিন্দা করে দাবি করেছেন তাদের পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন দেশের গণতন্ত্রকে ক্ষুন্ন করে যা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান। সত্যের বিচারক হিসেবে সরকার বিশেষ করে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় জনগণের আখ্যান মেনে চলার চেষ্টা করেছে। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলির মধ্যে অন্তত ১৫৯ জন মারা যায় ও ১৯৬ জন আহত হওয়া ২০২২ সালের হ্যালোউইন উৎসবের সময় সিউলের ইতাওনে মর্মান্তিক পদদলন এবং অপর্যাপ্ত পদক্ষেপের ফলে উল্লেখযোগ্য হতাহতসহ একজন মেরিন কর্পোরালের মৃত্যু ঘটা ওসোং ও ইয়েচিওনে ২০২৩ সালের জুলাইয়ের বন্যা রয়েছে। জবাবদিহির জন্যে ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারগুলির অক্লান্ত চেষ্টার পরেও তা সামান্যই কার্যকর।
সরকারের আখ্যান প্রচেষ্টা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ পর্যন্ত বিস্তৃত। ইউন প্রশাসনের অবস্থান ঐতিহ্যগত স্মৃতিচারণ থেকে একটি উল্লেখযোগ্য দূরত্ব প্রতিফলিত করে। সম্প্রতি ১৯২০-এর দশকে জাপানি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করা একজন বিখ্যাত উপনিবেশ বিরোধী নায়ক হং বিওম-ডো এবং কঠোর কমিউনিস্ট-বিরোধী নীতির জন্যে পরিচিত দেশটির প্রথম রাষ্ট্রপতি সিংম্যান রি’র গৌরবেকে তুচ্ছ করা তার মার্কিন ও জাপানি স্বার্থঘনিষ্ঠ একটি আখ্যানের দিকে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। ইতিহাসের এই পুনর্লিখন জাপানি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের উত্তরাধিকারকে প্রান্তিক করার পাশাপাশি সমসাময়িক ভূ-রাজনৈতিক জোটের সুবিধার্থে দেশের অতীতকে কৌশলগত পুনর্নির্মাণ করে বলে মনে হয়।
জনশক্তি পার্টিসহ ইউন প্রশাসন নারীবিদ্বেষ ও ঘৃণাত্মক বক্তৃতাকে উৎসাহিত করে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা, সামাজিক গণমাধ্যম ব্যস্ততা ও নীতিনির্ধারণে এই ধরনের বক্তব্য সমন্বয়ের জন্যে সমালোচিত। সম্প্রতি নারীবিরোধী মনোভাবের উত্থানের ফলে নারীরা চাকরিচ্যুতি এবং এমনকি শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি ইউন লিঙ্গ সমতা ও পরিবার মন্ত্রণালয় বাতিল এবং বিশেষ করে অভিবাসী কর্মীদের শ্রম সুরক্ষা হ্রাস করার প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কের মুখোমুখি। উপরন্তু, রাষ্ট্রপতি ও তার স্ত্রী উগ্র ডানপন্থী ইউটিউবারদের সাথে যুক্ত হয়েছেন, তাদের রাষ্ট্রপতির অভিষেকের আমন্ত্রণ, ছুটির উপহার পাঠানো এবং এমনকি তাদের সরকারি ভূমিকায় নিয়োগের কথা জানা গেছে।
প্রবাদের ব্যাঙের মতো একইরকম একটি কোরীয় প্রবাদ অনুসারে – কেউ ভিজে না যাওয়া পর্যন্ত গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি লক্ষ্য করতে পারে না – এই রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলির প্রতিটি পৃথকভাবে তাৎক্ষণিক হুমকির মতো এবং প্রকাশ্যভাবে কেউই অবৈধ বা কর্তৃত্ববাদী হয়তো মনে হচ্ছে না। তবুও তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব দেশের গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারের ভিন্ন রাজনৈতিক মতের উপর কঠোর হস্তক্ষেপ ও গণমাধ্যম তদারকিতে গণতান্ত্রিক নীতিমালা ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি দেশের অঙ্গীকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হবে।