আফ্রিকার কোন কোন দেশ ব্রিকস গোষ্ঠীতে যোগ দিতে পারে এবং কেন?

ব্রিকস সম্মেলন ২০১৭-তে অংশগ্রহণকারীরা, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, জিয়ামেন, চীন। উইকিমিডিয়া সাধারণ (সৃজনী সাধারণ ৩.০ অনুমতি) থেকে রাষ্ট্রপতির প্রকাশনা ও তথ্য কার্যালয়েছবি

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকস গোষ্ঠী বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী উপস্থিতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গোষ্ঠীটির অর্জিত উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির কারণে আফ্রিকার ক্রমবর্ধমান সংখ্যক দেশ এই প্রভাবশালী জোটের অংশ হওয়ার গভীর আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

বিশ্লেষকদের ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্রিকসের বাস্তব অর্জন সম্পর্কে মতামত ভিন্ন হলেও কোনো বিশ্লেষক গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার মূল্যায়নের জন্যে অপেক্ষা করে দেখা যাক পদ্ধতি বজায় রাখেন, অন্য একজন দাবি করেন ব্রিকস ইতোমধ্যে প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে। তবে কিছু কণ্ঠ গোষ্ঠীটির ক্ষেত্রে আরো বাস্তবসম্মত পথচিত্রের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।

ব্রিকস দেশগুলি ২০১৪ সালে এতে ৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের প্রাথমিক বিনিয়োগের মাধ্যমে নতুন উন্নয়ন ব্যাংক (এনডিবি) প্রতিষ্ঠা করে। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটিকে উন্নয়নশীল দেশগুলির উপর কঠোর অর্থনৈতিক নীতি আরোপের জন্যে সমালোচিত বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর মতো প্রভাবশালী পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলির বিকল্প হিসেবে ভাবা হয়েছে। এনডিবি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের সাথে যুক্ত সীমাবদ্ধতা ছাড়াই উন্নয়ন অর্থায়নের সুযোগ প্রদান করে সদস্য দেশগুলিকে ভারসাম্য বিধানের প্রস্তাব দেয়। এর সাথে ব্রিকস দেশগুলি আপৎকালীন সঞ্চয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে যা অর্থনৈতিক অশান্তির সময়ে অর্থপ্রদানের সমস্যায় জর্জরিত সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্যে পরিকল্পিত।

এই বছরের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন ২২-২৪ আগস্ট জোহানেসবার্গে গোষ্ঠীটির সদস্যপদ সম্প্রসারণের আলোচনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বলে ধারণা করা হয়েছে। তবে বর্তমান সকল সদস্য এই সম্প্রসারণকে সমর্থন করে না বলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। একটি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে ভারত ও ব্রাজিল ব্লকে তাদের বিদ্যমান প্রভাব হ্রাসের ভয়ের কারণে এই সম্ভাবনা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে বেইজিংয়ের সাথে আলজেরিয়া, ইরান, আর্জেন্টিনা, ইথিওপিয়া ও নাইজেরিয়ার মতো কিছু সম্ভাব্য নতুন প্রবেশকারীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি সম্ভাব্যভাবে চীনের কৌশলগত প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে ভারত বিশেষভাবে সতর্ক।

স্বীকার করার মতো একটি আকর্ষণীয় দিক হলো জোটের এজেন্ডাকে রূপ দিতে সচেষ্ট বিশিষ্ট ব্রিকস সদস্য রাশিয়া ও চীনের গতিশীলতা। উভয় দেশই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিয়োজিত নিয়ন্ত্রণ কৌশলের কারণে নিজেদের ফাঁদে পড়া ও বিচ্ছিন্ন মনে করে – যেখানে চীন তার আশেপাশে একটি বৈরী জোটের মুখোমুখি আর রাশিয়া পূর্ব ইউরোপে রুশবিরোধী জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। উপরন্তু মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ ও রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞার মতো অর্থনৈতিক পদক্ষেপের প্রভাব রোধ করার লক্ষ্যে ব্রিকস ধারণার আকর্ষণকে চালিত করেছে। রাশিয়া ও চীনের ক্ষেত্রে ব্রিকস মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে একটি পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।

দক্ষিণ আফ্রিকা ২০১০ সালে ব্রিকস গোষ্ঠীতে যোগদানকারী প্রথম আফ্রিকীয় দেশ। অন্তর্ভুক্তির পর থেকে এটি অন্যান্য আফ্রিকীয় দেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে জোটের সম্প্রসারণ প্রচারে সক্রিয়। বর্তমান ব্রিকস সভাপতি দক্ষিণ আফ্রিকা ভয়েস অব আমেরিকা সংবাদের এই প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে ৪০টিরও বেশি দেশ এই জোটে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে যা এই ব্লকের ক্রমবর্ধমান আবেদনকে প্রদর্শন করে।

ইথিওপিয়া ব্রিকসে যোগদানের প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এই বছর ২৯ জুন ব্রিকসের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কনসোর্টিয়ামে যোগদানের জন্যে ইথিওপিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি আবেদন জমা দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়কথোপকথনের একটি অনুচ্ছেদ ইথিওপিয়া কেন ব্রিকসে যোগ দিতে আগ্রহী তার কৌশলগত কারণগুলির উপর আলোকপাত করেছে। প্রথমত, মানবাধিকার উদ্বেগের কারণে পশ্চিমা শক্তিগুলির সাথে এর অবনতিশীল সম্পর্ক ব্রিকস সদস্যপদ চাওয়ার একটি কারণ হতে পারে, কারণ এটি সম্ভাব্যভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলিকে ইথিওপিয়ার মানবাধিকারের সমস্যাগুলিকে হ্রাস করতে উৎসাহিত করে দেশটিকে কৌশলগতভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে৷ দ্বিতীয়ত, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির কারণে ইথিওপিয়া প্রবৃদ্ধির বিশেষ করে চীন ও ভারতের সাথে তার শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিকল্প উপায় খুঁজছে। ব্রিকসে যোগদান সহযোগিতা বাড়াতে ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। তৃতীয়ত, ব্রিকসে যোগদানের মাধ্যমে, ইথিওপিয়া আইএমএফের সাথে আলোচনায় আরো বেশি সুবিধা পেতে এবং একটি নতুন ব্রিকস মুদ্রা তৈরির মাধ্যমে মার্কিন ডলারের আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জের অংশ হতে পারে। চতুর্থত, ব্রিকস শক্তিগুলি সাধারণত অন্যান্য রাষ্ট্রের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা সমর্থন করে। সবশেষে, ব্রিকস সদস্যপদ থেকে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের ভাবমূর্তি উপকৃত হতে, বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করতে এবং বড় বিশ্ব শক্তির মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা দেখাতে পারে।

ব্রিকসে ইথিওপিয়ার প্রবেশ সম্ভাব্য ঝুঁকি ও সুবিধা দুটোই উপস্থাপন করে, এটিকে একটি বিকল্প ভূ-রাজনৈতিক ব্লকের সাথে সঙ্গতি বিধান হিসেবে দেখা যেতে পারে। এই প্রান্তিককরণটি সম্ভাব্যভাবে পশ্চিমা শক্তির সাহায্য ও বিনিয়োগ হ্রাস করলেও একই সাথে ইথিওপিয়ার কৌশলগত তাৎপর্য বাড়াতে পারে।

সমান্তরাল ঘটনা হিসেবে নাইজেরিয়া স্পষ্টভাবে ব্রিকসের সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ না করলেও লিডারশিপ পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নাইজেরীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতি (এনপিএসএ) সরকারকে অন্যান্য দেশের পদক্ষেপ অনুসরণ করে ব্রিকস জোটে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছে। নাইজেরিয়ার অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি প্রদর্শন করে গত বছর ৬.৬ শতাংশ প্রসারিত হয়েছে এবং বিবিসির একটি প্রতিবেদন অনুসারে অব্যাহত অগ্রগতির জন্যে প্রস্তুত।

দৃষ্টিভঙ্গি ও সম্ভাবনা

ব্রিকস গোষ্ঠীর প্রতি আফ্রিকীয় দেশগুলির প্রদর্শিত আগ্রহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দৃশ্যপট গঠনে এর সম্ভাব্যতার উপর জোর দেয়। আফ্রিকার মধ্যে ব্রিকস সম্প্রসারণের পক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার সক্রিয় ভূমিকা আলাদা। ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও অন্যান্য আগ্রহী আফ্রিকীয় দেশগুলি নতুন বাজার, বিনিয়োগ, ও ভাগাভাগি করা চ্যালেঞ্জগুলির সহযোগী সমাধানগুলির একটি দ্বার হিসেবে সদস্যপদকে দেখে৷

বেশ কিছু মাত্রাব্রিকসে আফ্রিকীয় দেশগুলির আগ্রহের ভিত্তি। ব্রিকস দেশগুলি বৈশ্বিক জিডিপির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গঠন করায় অর্থনৈতিক বিবেচনা আফ্রিকীয় অর্থনীতির জন্যে বিস্তৃত বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সুযোগ দেয়। ব্রিকসের সাথে জড়িত থাকার ফলে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

অধিকন্তু, ব্রিকস বৈশ্বিক শাসন ব্যবস্থায় সংস্কার ও বহুমুখীতাকে জয়ী করার পক্ষ সমর্থক একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রায়শই প্রান্তিক আফ্রিকীয় দেশগুলির ক্ষেত্রে ব্রিকস তাদের কণ্ঠস্বর প্রসারিত করার এবং স্বার্থ জাহিরের একটি মঞ্চ উপস্থাপন করে।

উপরন্তু, ভাগাভাগি করা উন্নয়নমূলক চ্যালেঞ্জগুলি ব্রিকস ও আফ্রিকীয় দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতার উর্বর স্থল প্রদান করে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই প্রবৃদ্ধি উভয় পক্ষের মধ্যে গভীরভাবে অনুরণিত। ব্রিকসের মাধ্যমে আফ্রিকীয় দেশগুলি এই চ্যালেঞ্জগুলিকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা জোগাড় করতে চায়।

তবে সম্ভাব্য অপূর্ণতা দেখা যাচ্ছে। ব্লকের মধ্যে প্রধান অর্থনীতি বিশেষ করে চীনের উপর অর্থনৈতিক নির্ভরতার ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। অসম অংশীদারিত্ব ও প্রতিকূল বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা আফ্রিকীয় সম্পদকে সম্ভাব্যভাবে শোষণ করতে পারে। উপরন্তু, আফ্রিকীয় দেশগুলির অর্থনৈতিক কাঠামো, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও উন্নয়নমূলক স্তরের বৈচিত্র্য সমন্বয় ব্রিকসের মধ্যে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।

ব্রিকসে যোগদানের জন্যে আফ্রিকীয় দেশগুলোর দেখানো উৎসাহ জোটের রূপান্তরের ক্ষমতাকে তুলে ধরলেও আফ্রিকীয় দেশগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে ব্রিকসের সম্ভাব্য সম্প্রসারণ প্রশ্ন উত্থাপন করে এটি বৈশ্বিক মঞ্চে উদীয়মান অর্থনীতির ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠকে বড় করে তোলার একটি দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। আফ্রিকীয় দেশগুলি ব্রিকস সদস্যপদ বিবেচনা করে বলে এর অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের পথ প্রশস্ত  করার প্রভাবগুলিকে সূক্ষ্মভাবে মূল্যায়ন করা অপরিহার্য। এই মূল্যায়ন সহযোগিতামূলক অগ্রগতি চিহ্নিত একটি প্রতিশ্রুতিশীল ভবিষ্যতের জন্যে একটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .