জর্জীয় স্বপ্ন পার্টি প্রত্যেক জর্জীয় নাগরিকের স্বপ্ন নয়

ছবি আরজু গেবুলায়েভা

রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের অল্প সময় পরে জর্জিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্যে আবেদন করে। তারপর থেকে ক্ষমতাসীন জর্জীয় স্বপ্ন পার্টি পশ্চিমের বিরুদ্ধে একগাদা সিদ্ধান্ত, বিবৃতি ও সমালোচনার কারণে নিজেকে সমস্যায় ফেলেছে। ক্ষমতাসীন সরকার স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়েও উল্টো পথে হাঁটছে। সম্প্রতি ২০২৩ সালের মে মাসে জর্জীয় প্রধানমন্ত্রী ইরাকলি ঘারিবাশভিলি বুদাপেস্টে রক্ষণশীল রাজনৈতিক আব্দোলনের জোটের (সিপিএসি) সভায় যোগ দিয়ে এলজিবিটিকিউ+ লোকেদের তিরস্কার করে দাবি করেন তারা দেশটির “ঐতিহ্যগত পারিবারিক মূল্যবোধের” বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে এটি শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের এলজিবিটিকিউ+ বিরোধী অবস্থান বা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নিয়ে তার আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণকারী নিন্মমুখী ট্র্যাক রেকর্ড নয়। জর্জীয় স্বপ্নও ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে রাশিয়ার সাথে তার সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে।

ইইউ থেকে দূরে, রাশিয়ার কাছাকাছি

জর্জিয়া ২০২৩ সালের মে মাসে পুনরায় রাশিয়ার সাথে বিমান চলাচল চালু করে। এই ফ্লাইটের একটি রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের আত্মীয়দের বহন করে, যার মধ্যে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় থাকা তার কন্যা একাতেরিনা ভিনোকুরোভা ও তার স্বামী আলেকজান্ডার ভিনোকুরভও রয়েছে। ল্যাভরভের পরিবার মেয়ের দেবর মিকা (মোশে) ভিনোকুরভের বিয়েতে জর্জিয়ায় ভ্রমণ করে।

এছাড়াও মে মাসে ব্রাতিস্লাভায় একটি নিরাপত্তা সম্মেলনে জর্জীয় প্রধানমন্ত্রী ঘারিবাশভিলি স্পষ্টভাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার মূল কারণ হিসেবে ইউক্রেনকেই প্রথমত অভিযুক্ত করেন। “আমি রুশ সরকারের বিবৃতি উদ্ধৃত করতে চাই না, তবে এর একটি কারণ ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ইচ্ছা ও সংকল্প। তাই আমরা এর পরিণতি দেখতে পাচ্ছি,” বলেছেন ঘারিবাশভিলি। একই সম্মেলনে তিনি জর্জিয়ার একই মর্যাদা অস্বীকার করে ইউক্রেন ও মোল্দোভাকে প্রার্থীর মর্যাদা দেওয়ার জন্যে প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে ইইউকে আক্রমণ করেন। জর্জিয়া “সংস্কার ক্ষমতা ও এটা-সেটা”র দিক থেকে অন্য দুটি দেশের চেয়ে এগিয়ে ছিল প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন।”

ব্রাতিস্লাভার সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এমইপি রাসা জুকনেভিসিয়েনি টুইটারে লিখেন, “গোভরিট মস্কোভা!” (মস্কো কথা বলছে!) জর্জিয়ায় প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আয়ান কেলি বিবৃতিগুলিকে “খারাপ বিশ্লেষণ” ও “আক্রমনাত্মক” অভিহিত করে “পশ্চিমে যোগদানের সার্বভৌম ইচ্ছার জন্যে ইউক্রেনকে” দোষারোপ করেন।

জর্জীয় স্বপ্ন পার্টির বিপরীতে ইইউ জর্জিয়াকে ইউক্রেন ও মোল্দোভার চেয়ে পশ্চাদপদ বিবেচনা করে। ইইউ-জর্জিয়া সংসদীয় সমিতি কমিটির ১২তম বৈঠকের সভাপতি মেরিনা কালজুরান্ড, “ইউক্রেন ও মোল্দোভার থেকে জর্জিয়ার পিছিয়ে থাকা ইইউ নির্ধারিত প্রার্থীর মর্যাদা পাওয়ার জন্যে পূরণীয় ‘অসম্পূর্ণ, প্যাঁচালো ও প্রায়শই ভাসাভাসা ১২টি সুপারিশ পুনরায় পরীক্ষা করা দরকার বলে দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের একটি ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ হারিয়ে ফেলার ব্যাপারে সতর্ক করে দেন,” ওসি মিডিয়া প্রতিবেদন করেছে। যার প্রতি, জর্জীয় স্বপ্নের সাধারণ সম্পাদক ও তিবিলিসির মেয়র কাখা কালাদজে বলেন, কালজুরান্ড “অন্য একটি দেশের কথা বলছেন এবং সেটা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবতা বিবর্জিত।”

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরে ইউক্রেন তার আনুষ্ঠানিক আবেদন করার একদিন পর ক্ষমতাসীন সরকার ২০২২ সালের মার্চ মাসে ইইউ সদস্যতার জন্যে আবেদনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। সেই সময়ে ক্ষমতাসীন জর্জীয় স্বপ্ন পার্টির ঘুরে দাঁড়ানো হিসেবে বর্ণিত এবং সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত জোর দেওয়া এই পদক্ষেপটিকে তারা ২০২৪ সালে সদস্যতার জন্যে আবেদন করার প্রাথমিক সময়কে ত্বরান্বিত করবে না।

জুন ২০২২-এ ইইউ কমিশনের সভাপতি উরসুলা ফন ডার লেয়েন, বলেছেন, “আমরা পর্ষদকে [জর্জিয়াকে] ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়ার জন্যে এবং ফিরে এসে জর্জিয়া কীভাবে প্রার্থীতার মর্যাদার আগে বেশ কয়েকটি শর্ত পূরণ করে তা মূল্যায়ন করার সুপারিশ করছি।” প্রার্থীর মর্যাদা পেতেদেশটিকে অবশ্যই অন্যান্য কিছুর সাথে রাজনৈতিক মেরুকরণ হ্রাস, বিচার ব্যবস্থার সংস্কার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলি কার্যকারিতা নিশ্চিত, অভিজাততন্ত্র মুক্তকরণসহ দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপগুলিকে শক্তিশালী করার মতো কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। অভিজাততন্ত্র মুক্তকরণ সর্তটি নির্দিষ্ট কোনো নামোল্লেখ না করলেও এতে অনেকেই জর্জীয় স্বপ্নের প্রতিষ্ঠাতা ও কোটিপত বিজিনা ইভানিশভিলিকে বুঝেছে

ইভানিশভিলি জর্জীয় রাজনীতির একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। রাশিয়ায় প্রাক-পুতিন যুগে তার ভাগ্য গড়ে তিনি ২০১২ সালে জর্জীয় স্বপ্ন পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ইভানিশভিলি প্রকাশ্যে ২০২১ সালে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেও কেউ কেউ মনে করেন তিনি এখনো পর্দার আড়ালে কলকাটি নাড়ছেন। ইউরোপীয় সংসদ ২০২২ সালের জুনে “জর্জিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের বিষয়ে” একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নথিটি “জর্জিয়ার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অবনতিতে ভূমিকার জন্যে” জর্জিয়ার কর্মকর্তাদের ইভানিশভিলির উপর ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে।

অভিজাততন্ত্র মুক্তকরণ কার্যকর করতে আইন গ্রহণ বা সংশোধন করা যথেষ্ট নয় বলে “অভিজাততন্ত্র মুক্তকরণের প্রভাব হ্রাস” করার লক্ষ্যে “বোধগম্য ব্যবস্থা” গ্রহণ করা দরকার এমন যুক্তিতে ভেনিস কমিশনের আপত্তি সত্ত্বেও জর্জীয় সংসদে ১৩ জুন, ২০২৩ তারিখে অভিজাততন্ত্র মুক্তকরণ সংক্রান্ত একটি খসড়া আইন গ্রহণে জর্জিয়ায় সরকারের এক বছর সময় লেগেছে।

ভেনিস কমিশনের মতে খসড়া আইনটি উদ্বেগের সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে খসড়া আইনটি ইভানিশভিলির পরিবর্তে বেশ কয়েকজন বিরোধী ব্যক্তিত্বকে লক্ষ্যবস্তু করবে।

ইউরোপীয় কমিশন অক্টোবরে তার অন্তর্বর্তী মতামত জানিয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আবার জর্জিয়ার প্রার্থীতা মর্যাদার উপর ভোট নেবে।

সকল ঘরোয়া ফ্রন্টে অবনতি

বুদাপেস্টে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার অব্যবহিত পরেই ক্ষমতাসীন দল ইউরোপীয় সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দল (পিইএস) থেকে তাদের পর্যবেক্ষক সদস্যপদ প্রত্যাহারের কথা বলেছে। বুদাপেস্টে সম্মেলনে অংশ নেওয়ায় পিইএস ঘারিবাশভিলির সমালোচনা করে। ওসি মিডিয়ার সাথে একটি সাক্ষাৎকারে একজন পিইএস প্রতিনিধি বলেন, “বেশ কয়েক মাস ধরে [তারা] জর্জীয় স্বপ্নের পিইএস এর মূল্যবোধ বহির্ভূত কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা, উদ্বেগ প্রকাশ ও নিন্দা করেছে।”

তিবিলিসিতে ফিরে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকারকে সম্মান করার জন্যে কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানানোসহ রাষ্ট্রটি ইউক্রেন ও এর ন্যাটো আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে ঘারিবাশভিলির বিবৃতির সমালোচকদের পিছু নিতে দেরি করেনি। জুন মাসে একদল রাজনৈতিক কর্মী সংসদের বাইরে ব্যানার ও পোস্টার নিয়ে জড়ো হলে পুলিশ দ্রুত হস্তক্ষেপ করে কিছু পোস্টার ছিঁড়ে কর্মীদের প্রতীক জব্দ করে। আটক নেতাকর্মীদের অন্তত তিনজন এখন গুন্ডামি ও পুলিশের অবাধ্যতার অভিযোগে বিচারাধীন।

কয়েকদিন পরে জর্জীয় পুলিশকে আবারো রাজধানীতে সংসদ ভবনের বাইরে জড়ো হওয়া বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে “আপত্তিকর” বিবেচনায় তাদের ধারণ করা প্রতীক জব্দ করতে বা ছিঁড়ে মাটিতে ফেলতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে ওসি মিডিয়া। কিছু ব্যানারে জর্জীয় বর্ণমালায় প্রধানমন্ত্রী ইরাকলি ঘারিবাশভিলির নাম “শিশ্ন” এর জর্জীয় শব্দ “ყ” অক্ষরের অনুরূপ “k” (‘კ’) অক্ষরটি অদলবদল করে লেখা ছিল। পুলিশ বাতুমিতে “মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার” প্রতিবাদকারী অন্তত ছয়জনকে আটক করেছে

পরের সপ্তাহগুলিতে বিরোধীভাবাপন্ন টিভি কেন্দ্র ফর্মুলার সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক মিশা মশভিলদাদজে এবং দুই বিরোধী রাজনীতিবিদ স্বাধীনতাবাদী বিরোধী দল গির্চি– আরো স্বাধীনতার সভাপতি জুরাব গির্চি জাপারিদজে এবং বিরোধী সংযুক্ত জাতীয় আন্দোলন (ইউএনএম) পার্টির সদস্য ডেভিট ওসিকমিশভিলিসহ ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে রাজধানী তিবিলিসিতে সংঘটিত একাধিক সহিংস ঘটনা সম্পর্কে গণমাধ্যম প্রতিবেদন করেছে

এছাড়াও জুন মাসে সংসদ নির্বাচনী বিধিতে ইইউ-সমর্থিত চুক্তির অংশ হিসেবে প্রস্তাবিত একটি মডেলকে বাতিল করে দিয়েছে। যেমন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন (সিইসি) নিয়োগ ও গঠনের বিষয়ে রাষ্ট্রপতি্ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিবর্তে ১৪ জুন পাস হওয়া নতুন সংশোধনী অনুসারে সংসদ ও সংসদের স্পিকার সেই সিদ্ধান্ত নেবে। জর্জিয়ার ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীদের মধ্যে্কার ২০২১ সালের এপ্রিলের ইইউ চুক্তিটিতে একটি বিচার বিভাগীয় ও নির্বাচনী সংস্কার প্যাকেজ অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিরোধী দলগুলি ২০২০ সালের অক্টোবরে জয়ী ক্ষমতাসীন জর্জীয় স্বপ্ন পার্টির সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বিতর্কের সময় জর্জিয়া একটি রাজনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত থাকাকালে চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় ২০২১ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলি একটি চুক্তিতে উপনীত হয়। কয়েক মাস পরে জর্জিয়া স্বপ্ন একটি সংবাদ সম্মেলনের চুক্তি থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে

কিন্তু জর্জীয় স্বপ্ন যা চায় এবং জর্জিয়ার জনগণ যা কল্পনা করে তার মধ্যে একটি দৃশ্যমান বিভাজন রয়েছে। ২০২২ সালের মার্চে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক প্রজাতন্ত্রী প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা অনুসারে জর্জীয়দের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ রাশিয়াকে হুমকি এবং ৫০ শতাংশেরও বেশি ইইউ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জর্জিয়ার প্রধান অংশীদার হিসেবে দেখে। আর জর্জিয়ার জনসংখ্যার ৭০ শতাংশেরও বেশি চায় দেশটি ইইউতে যোগদান করুক। সম্প্রতি জর্জীয় স্বপ্ন দেশটি (আসন্ন) স্বাধীনতা দিবসে ইইউতে যোগ দিতে যাচ্ছে বলে জনসাধারণকে জানালেও ইইউ-পন্থী ও গণতান্ত্রিক সমর্থকরা বিশ্বাস করে এটি কেবল মৌখিক প্রতিশ্রুতি।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .