ফেসবুকের নাইরোবি অফিসে কথিত শোষণ ও বিষাক্ত কাজের পরিবেশের জন্যে ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটার বিরুদ্ধে এর প্রাক্তন সঞ্চালক ড্যানিয়েল মোতাংয়ের দায়ের করা মামলাটি এগিয়ে যেতে পারে বলে কেনিয়ার একটি আদালতের সাম্প্রতিক রায় এখতিয়ার না থাকার দাবি করে স্থানীয় আইনি ঝামেলা এড়ানোর চেষ্টারত প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির ক্ষেত্রে একটি নজির স্থাপন করতে পারে। এছাড়াও মোতাং মেটা মঞ্চ আয়ারল্যান্ড লিমিটেডের স্থানীয় আউটসোর্সিং এজেন্ট সামাসোর্স কেনিয়া ইপিজেড লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
গতবছর কেনিয়ার কর্মসংস্থান এবং শ্রম সম্পর্ক আদালতে দায়ের করা মামলায় মোতাং এবং অন্য ১২ জন প্রাক্তন কর্মচারী দাবি করেছে যে বারবার অত্যন্ত পীড়াদায়ক, জীবন্ত হিংসাত্মক বিষয়বস্তু সম্মূখীন হওয়ার পাশাপাশি বিষাক্ত কাজের পরিবেশের কারণে তারা মানসিক আঘাত পেয়েছে।
মেটা তার আইনজীবীর মাধ্যমে যুক্তি দেখায় মেটা মঞ্চ ইনকর্পোরেশন ও ফেসবুক বিদেশী কর্পোরেশন এবং কেনিয়াতে অবস্থান বা ব্যবসা করে না বলে তারা সেই দেশের এখতিয়ারভূক্ত নয়। তবে ৬ ফেব্রুয়ারি কর্মসংস্থান ও শ্রম আদালত মেটার বিরুদ্ধে কেনিয়াতে মামলা করা যেতে পারে বলে রায় দেয়। কোন অন্যায় ঘটা্র পর এবারই প্রথম শুধু পশ্চিমের বাইরে নয়, আফ্রিকাতে কোন বৈশ্বিক প্রযুক্তি দৈত্যের বিরুদ্ধে একটি মামলা শুনানির জন্যে এগিয়ে চলেছে।
এই আদালতের সিদ্ধান্ত কেনিয়া এবং অন্যান্য দেশে অন্যান্য প্রযুক্তি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলার সদর দরজা খুলে দিতে পারে। টাইমস ম্যাগাজিনের একটি সাম্প্রতিক প্রকাশ অনুসারে প্রায়শই প্রকাশ্য এবং পীড়াদায়ক উপাদান পর্যালোচনা সত্ত্বেও কেনীয় কর্মীদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রশিক্ষণের জন্যে ২ ডলারের কম অর্থ প্রদান করায় এর মধ্যে ওপেনএআই অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
বিষয়বস্তু সঞ্চালনের ক্ষতি
মঞ্চের কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব থেকে আরো স্পষ্ট হয়েছে যে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিষয়বস্তু সঞ্চালন, কোন বিষয়বস্তু মঞ্চের নীতি লঙ্ঘন করে কিনা তা নির্ধারণ করার জন্যে সামাজিক গণমাধ্যম পোস্ট, ফটো এবং ভিডিও পর্যালোচনা করার প্রক্রিয়া আরো বেশি যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় এসেছে।
বিষয়বস্তু পরিবর্তন বা সঞ্চালন যেকোনো সামাজিক গণমাধ্যম সাইটের মূল কাজ হওয়া সত্ত্বেও ফেসবুক তাদের বিষয়বস্তু পরিবর্তনকারী ১৫,০০০ লোকোকে সরাসরি নিয়োগ না করার পথ বেছে নেয়। এর পরিবর্তে তারা ভারতের জেনপেট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কগনিজেন্ট, আয়ারল্যান্ডের কোভালেন ও অ্যাকসেঞ্চার এবং সাম্প্রতিককালে কেনিয়ার সামাসোর্সের মতো তৃতীয় পক্ষের ঠিকাদারদের কাছে এই গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাকর্মটি আউটসোর্স করে।
এই ফেসবুক ঠিকাদারদের নিয়োগ করা বিষয়বস্তু সঞ্চালকদের গল্পগুলি সবই পীড়াদায়কভাবে একইরকম: দীর্ঘ সময় ধরে তারা জঘন্য বিষয়বস্তুর মধ্যে থাকার শিকার হয়, এই ধরনের বিষয়বস্তুতে অবস্থানের ক্ষতি মোকাবেলা করতে একেবারেই না বা খুব কম সমর্থন দেওয়া হয়, অন্যায্য অর্থ প্রদান করা হয় এবং অপ্রকাশিত চুক্তির মাধ্যমে তাদের ফাঁসানো হয়। ২০২০ সালের মে মাসের মামলার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১,০০০ টিরও বেশি বিষয়বস্তু সঞ্চালককে চাকরিতে থাকাকালীন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মীমাংসা বাবদ মেটা ৫.২ কোটি ডলার (প্রায় ৫৫০ কোটি টাকা) দিয়েছে এবং কোম্পানিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু সঞ্চালকের কাজের পরিস্থিতির উন্নতি করেছে। তারা বিদেশে অন্যদের সাথে এরকম কিছু করেনি।
কেনিয়ার গবেষক ও নীতি বিশ্লেষক নানজিরা সাম্বুলির মতে আফ্রিকা পূর্ণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াসহ বিষয়বস্তু সঞ্চালক রপ্তানির পরবর্তী সেরা গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
মজিলা গবেষণা সহযোগী, স্বাধীন ডেটা সাংবাদিক এবং ওডিপো দেবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ওদাঙ্গা মাদুং বলেছেন যে মোতাংয়ের মামলাটি শক্ত৷ তিনি গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন সম্পূর্ণ আগের বিষয়বস্তু সঞ্চালন মামলার মতো মেটা সম্ভবত আদালতের বাইরেই মীমাংসা করবে।
এই মামলাটি পূর্ণাঙ্গ শুনানিতে গেলে সম্ভবত ফেসবুকের ভেতরকার জটিলতা প্রকাশিত হয়ে যাবে। জনসাধারণ তাদের বিষয়বস্তু সঞ্চালন অনুশীলনে প্রবেশাধিকার পাবে। যা তাদের বিষয়বস্তু থাকার বা নামিয়ে নেওয়ার সুযোগ হলে সেগুলি আরো মামলা বা যাচাই-বাছাইয়ের জন্যে উন্মুক্ত হবে।
ওদাঙ্গা ২০২০ সালের মে মাসের মীমাংসার কথা উল্লেখ করেন।
‘আমরা খুব বিপজ্জনক একটি নজির এড়াতে পেরেছি’
নাইরোবিতে অগ্রহণযোগ্য শ্রমচর্চার দিয়ে শোষণ করার মতো তরুণ ও প্রযুক্তিঋদ্ধ কর্মীবাহিনীর ডিজিটাল চারণভূমি দেখা মেটা সেদেশের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে অন্ধ বা অজ্ঞ ছিল। কেনিয়ার উচ্চতর আদালত ২০২১ সালের অক্টোবরে কেনিয়ার গাড়ি চালকদের সাথে চুক্তি লঙ্ঘনের জন্যে উবারের বিরুদ্ধে যুগান্তকারী আরেকটি রায় দেয়। মেটার মতো উবার কেনিয়াতে বসবাস না করার একই যুক্তি ব্যবহার করে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বছরের পর বছর ধরে গাড়ি চালকরা উবার কেনিয়া লিমিটেড এবং উবার বিভি প্রকৃতপক্ষে এক এবং একই কোম্পানি প্রমাণ করার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত তারা জিতে যায়।
ওদাঙ্গা ব্যাখ্যা করেছেন:
যারা মঞ্চের জবাবদিহিতার জায়গাতে আছেন তাদের জন্যে এই রায়টি একটি বড় বিষয়, বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে জবাবদিহিতা এড়িয়ে যেতে ফেসবুক এবং মেটা যখন নিজেদের অনাবাসিক বলার চেষ্টা করছে। তাদের অন্য দেশের নাগরিকদের যেকোন ধরনের ক্ষতির দায় এড়ানোর চেষ্টা সত্যিই উদ্বেগজনক।
মজিলা সহযোগী ওদাঙ্গা গবেষণা-ভিত্তিক প্রতিবেদন ব্যবহার করে কেনিয়াতে জেগে ওঠা অপপ্রচার শিল্পকে উন্মোচিত করার পাশাপাশি সামাজিক গণমাধ্যমের মঞ্চগুলিকে আরো দায়বদ্ধ করার জন্যে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন।
কেন এই রায়টি এত গুরুত্বপূর্ণ এবং এর তাৎপর্য সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমি মনে করি আমাদের আদালতের এমন একটি রায় দিয়ে আমরা খুব বিপজ্জনক নজির এড়াতে পেরেছি।”
প্রজাপতি প্রভাব
ওদাঙ্গা তার মতো শিল্পের অনেক লোকের জন্যে এই সাম্প্রতিক রায়টির প্রজাপতি প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে তাদের অস্বচ্ছ বিষয়বস্তু সঞ্চালন চর্চার শিকার ফেসবুক ব্যবহারকারী এবং ডিজিটাল অধিকার কর্মীদের ব্যাপারে কথা বলেছেন।
এর মধ্যে দুইজন ইথিওপীয় গবেষক রয়েছে যারা কেনিয়ার অধিকার গোষ্ঠী কাতিবা প্রতিষ্ঠানের সাথে একত্রে মেটাকে তাদের মঞ্চে ঘৃণাপূর্ণ বিষয়বস্তু বিকাশের অনুমতি এবং ইথিওপীয় জাতিগত সহিংসতাকে উস্কে দেওয়ার জন্যে ১৬০ কোটি ডলারের (প্রায় ১৭,০০০ কোটি টাকার) মামলা করতে যাচ্ছে।
মেটার বিরুদ্ধে মোতাংয়ের রায়ের পরে একটি ভিডিও লিঙ্কের মাধ্যমে নাইরোবিতে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার সময় দুটি মামলায় একটি অলাভজনক প্রযুক্তি ন্যায় প্রতিষ্ঠান ফক্সগ্লাভ এর ভূমিকার তাৎপর্য নিয়ে এবং কীভাবে বিষয়বস্তু সঞ্চালন (বা ইথিওপীয়দের ক্ষেত্রে এর অভাব) উভয়টির মূলে ছিল তা নিয়ে এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং অন্যতম পরিচালক কোরি ক্রাইডার কথা বলেছেন।
তিনি উল্লেখ করেছেন সামা সোর্সের একই নাইরোবি বিষয়বস্তু সঞ্চালন কেন্দ্রে যা ঘটেছিল তা থেকেই উভয় মামলাটি উদ্ভূত হয়েছে।
ফক্সগ্লাভের কাছে একজন প্রাক্তন মেটা কর্মচারীর প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় যে ফেসবুকের অপপ্রচার বাজেটের ৮৭ শতাংশ ইংরেজিভাষী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে বরাদ্দ এবং বাকি বাজেট বাকি বিশ্বে ভাগাভাগি করা হয়।
সাব-সাহারা অঞ্চলের গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও মেটা এই কোটি কোটির জন্যে বিনিয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তিনি বলেন।
ক্রাইডার ব্যাখ্যা করেছেন বিষয়বস্তু সঞ্চালন করার জন্যে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বাজেট বরাদ্দের ব্যর্থতাই দুর্বল কর্মীদের স্তর তৈরি করার ফলে তারা ইথিওপিয়া থেকে হিংসাত্মক এবং ঘৃণাপূর্ণ পোস্ট সমৃদ্ধ করে যা দেশে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ প্রজ্বলিত করে। এটাই বিষয়বস্তু সঞ্চালকদের শোষণ এবং দুর্বল কাজের পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়ে মোতাং এবং তার সহকর্মীদের ক্ষেত্রে মানসিক আঘাত এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্য সৃষ্টি করে, তিনি আরো বলেন।
মানবাধিকার থেকে একটি অর্থনৈতিক যুক্তি
যুব বেকারত্ব আফ্রিকার একটি বাস্তব সংকট। স্ট্যাটিস্টার মতে কেনিয়ার হারটি আগের বছরের তুলনায় ২০২১ সালে ০.৩ শতাংশ বেড়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, কেনিয়ার যুব বেকারত্বের হার ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ১৩.৮৪ শতাংশে পৌঁছেছে।
কেনিয়ার ক্রমবর্ধমান ছোট-চুক্তির গিগ অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণকারী নীতির অভাব বড় বড় প্রযুক্তিগুলির শোষণের শিরোনাম হওয়ার ক্রমবর্ধমান ঘটনা তার ডিজিটাল জ্ঞানী যুবকদের ডিজিটাল ক্রীতদাসে পরিণত করার হুমকি দিচ্ছে৷ এছাড়াও ওদাঙ্গা তার সহ-গবেষক, কেনিয়ার মানবাধিকার ও ডিজিটাল অধিকারের প্রচারকদের একটি সত্যিকারের ভয়ের কথা বলেন যে রাজনৈতিক শ্রেণী এটিকে দ্রুত মানবাধিকার থেকে একটি অর্থনৈতিক যুক্তিতে পরিণত করে তাদের নীতি-নির্ধারণী ভূমিকা বাদ দিয়ে ডিজিটাল স্থানে এমনকি শ্রম আই্নকে প্রসারিত করতে পারে।
ক্রাইডার দু’টি মামলাকে কেনিয়া (এবং অঞ্চলটি) এর মতো গুরুত্বপূর্ণ গণতন্ত্র এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী প্রযুক্তি সংস্থাগুলির মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের একটি সুযোগ হিসেবে দেখলেও নানজিরা সতর্ক করে দেন যে “আফ্রিকীয় নীতিনির্ধারকরা মহাদেশটিতে ছোট-চুক্তির অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের বেষ্টনী স্থাপন না করা” পর্যন্ত এই সুযোগগুলি সম্পূর্ণ হবে না।