ভারতীয় পরিচালক হংসল মেহতার বলিউডের সিনেমা ফারাজ ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে ভারতে মুক্তি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে সিনেমার ট্রেলার রিলিজ হয়েছে। তবে, মুক্তির আগেই বাংলাদেশে ছবিটি নিয়ে তুমুল বির্তক শুরু হয়েছে। কারণ, সিনেমাটি বাংলাদেশের হোলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলার ঘটনা নিয়ে নির্মিত। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনা ঘটে। রাতব্যাপী জিম্মি অবরুদ্ধ করে রাখার পরে ভোরে মিলিটারি অপারেশনের পর সবাই জানতে পারে মোট ২৯ জন মানুষ মারা গেছে – যার মধ্যে ২০ জন জিম্মি (১৭ জন বিদেশি, ৩ জন দেশি), ২ জন পুলিশ অফিসার, দুই জন বেকারি কর্মী এবং পাঁচ বন্ধুকধারী আততায়ী ছিলেন।
হোলি আর্টিজানে হামলায় নিহত বাংলাদেশি তরুণ ফারাজকে কেন্দ্র করেই সিনেমার গল্প আবর্তিত হয়েছে। সিনেমার গল্পটি বাংলাদেশি সাংবাদিক নুরুজ্জামান লাবুর ২০১৭ সালে প্রকাশিত “হলি আর্টিসান: সাংবাদিকের তদন্ত” বই থেকে অনুপ্রাণিত। সেদিন ফারাজ কী আসলেই হিরো ছিল, নাকি সবটুকুই বানানো গল্প সেটা নিয়েই চলছে বিতর্ক। সিনেমাটি নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয় যখন অন্য দুই ভুক্তভোগীর মায়েরা এর গল্পের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, কারণ এতে শুধুমাত্র একজন জিম্মিকে (ফারাজ) নায়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে। তারা জানিয়েছেন যে সিনেমাটি বানানোর আগে ভুক্তভোগীদের পরিবারের সাথে পরামর্শ করা হয়নি বা অনুমতি নেয়া হয়নি।

হোলি আর্টিজানে জিম্মিদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ অভিযান চালান। তবে উদ্ধারের আগেই বহুসংখ্যক জিম্মি আততায়ীদের হাতে মারা যান। ছবি তুলেছেন জুবায়ের বিন ইকবাল। সিসি বিওয়াই-এসএ ৪.০ লাইসেন্সের আওতায় উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া।
কে এই ফারাজ
হোলি আর্টিজান হামলায় নিহতদের একজন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ২০১৬ সালের পয়লা জুলাই রাতে ফারাজ তার দুই বিদেশি বন্ধু, বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক এবিং এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অবিন্তা কবির, এবং আরেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত ভারতীয় নাগরিক তারিশি জৈন এর সাথে ঢাকার হোলি আর্টিজান বেকারিতে গিয়েছিলেন।
হোলি আর্টিজানে ফারাজের বীরত্ব নিয়ে চালু গল্পটি হলো, বাংলাদেশি আর মুসলিম হওয়ার কারণে জঙ্গিরা তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বন্ধুদের মৃত্যুর মুখে রেখে সে চলে আসতে চায়নি। সবার মতো সেও মর্মান্তিক হত্যার পরিণতি বরণ করে।

ফারাজ সিনেমার পোস্টার। উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া। যথার্থ ব্যবহার।
বন্ধুদের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার বীরত্ব নিয়ে সিনেমা বানানো হলেও, ফারাজের এই কল্পিত রূপকে খারিজ করে দিয়েছিলেন অনেকেই। এদের একজন বাংলাদেশি ক্রাইম রিপোর্টার নুরুজ্জামান লাবু। সাংবাদিক হিসেবে তিনি হোলি আর্টিজান ঘটনা সরাসরি কভার করেছিলেন। পরে এটা নিয়ে একটা অনুসন্ধানী বইও লিখেছেন। বলিউডের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফারাজ সিনেমা বানানোর সময় এই বই থেকে তথ্যও নিয়েছে। ফারাজ সিনেমা নিয়ে তিনি তার ফেসবুকে লিখেছেন:
যদিও আমার বইয়ে আমি ফারাজরে আলাদা কইরা হিরোইজমের যে মিথ প্রচার করা হইছে তা নাকচ কইরা দিছিলাম। কারণ এর কোনও প্রত্যক্ষদর্শী আমি পাই নাই। কে বলেছিল যে ফারাজকে জঙ্গিরা ছাইড়া দিতে চাইছিল, কিন্তু তার দুই বান্ধবীরে ছাইড়া আসতে চায় নাই? এর কোনও উত্তর নাই। এইটা বানানো গল্প।
ফারাজের বীরত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিহতদের একজন অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদও। তিনি গত ১৯ জানুয়ারি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন:
যে ঘটনাটিকে বলা হয়েছে যে আমার মেয়ের জন্য একজন মানুষ (ফারাজ) তার জীবন দিয়েছেন, সেই হিরো … নো, দ্যাটস রং। ইটস অ্যা রং স্টেটমেন্ট। এটা হতে পারে না। আমি তা বিশ্বাস করি না। কারণ তার কোনো প্রমাণ নেই। ওখান থেকে কেউ বেঁচে আসেনি। যারা বেঁচে ফিরেছে, তারা এ বিষয়ে কিচ্ছু জানে না, বলতে পারে না। এ বিষয়ে কোন এভিডেন্সও নাই যে এখানে কেউ হিরো হয়েছে।
প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত শহিদুল হক টুইটারে জানিয়েছেনঃ
I watched the trailer of the #Faraaz by #Bollywood and I can tell you that it's like 'rubbing salt on your wound'. Mixing true story with #Bollywood fiction is dangerous and poisonous ……… #BoycottFaraaz https://t.co/eQ7nmiaJ5M
— MG Shahidul Haque(retd) (@haque_shahidul) January 20, 2023
আমি #বলিউডের #ফারাজ সিনেমার ট্রেলার দেখেছি এবং আমি আপনাকে বলতে পারি যে এটি ‘ক্ষতে লবণ মাখানোর’ মতো। #বলিউডের রূপকথার সাথে সত্য গল্প মেশানো বিপজ্জনক এবং বিষাক্ত……… #বয়কটফারাজ
আইনি লড়াই
গত বছর ফারাজের দুই বন্ধু অবিন্তা কবির এবং তারিশি জৈনের মায়েরা সিনেমাটির মুক্তি ঠেকাতে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। তাদের মামলায়, তারা যুক্তি দিয়েছিল যে সিনেমাটিতে ঘটে যাওয়া সত্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তাদের মেয়েদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হয়েছে। একই সাথে সিনেমা নিয়ে তাদের সাথে কোনো আলোচনাও করেনি বলে জানিয়েছেন। তারা দাবি করেছিলেন যে তাদের “গোপনীয়তার অধিকার” চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ঘটনাটিকে বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানোর অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে, চলচ্চিত্র নির্মাতা যুক্তি দিয়েছিলেন যে ঘটনার বিস্তারিত তথ্যগুলো ইতিমধ্যেই ইন্টারনেটে সর্বসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত রয়েছে এবং সিনেমায় একটি নোটিশে বলা আছে যে “ফারাজ” একটি সত্য ঘটনা দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি কাল্পনিক কাজ।
২০২২ সালের ১৫ অক্টোবর মামলার শুনানির পরে দিল্লি হাইকোর্ট বাদীর আবেদন অনুযায়ী “ফারাজ”-এর মুক্তি রোধ করার জন্য অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করে।
পরে, অবিন্তা ও তারিশির মায়েরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করেন এবং গত ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩ তারিখে দিল্লি হাইকোর্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা হংসল মেহতা এবং দুই মাকে দেখা করে এবং যৌথভাবে সমস্যাটি সমাধান করার চেষ্টা করার নির্দেশ দেয়।
এই চলমান আইনি বিরোধ ভারতে একটি নজিরবিহীন আইনি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে যে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি সিনেমায় চিত্রায়িত চরিত্রগুলো মৃত ব্যক্তিদের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে কিনা এবং সেই অধিকারটি তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে প্রসারিত হয় কিনা। পরবর্তী আদালতের শুনানি সিনেমাটির পরিকল্পিত মুক্তির দুই দিন আগে — ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তারিখে নির্ধারিত হয়েছে।
Can films inspired by true life events be injuncted at all? #DelhiHighCourt asks mothers seeking stay of the upcoming movie #Faraaz.
The two women lost their daughters in a 2016 terrorist attack in a Dhaka cafe on which movie is based. Film is set to be released on Feb 3. pic.twitter.com/vEbmKi08lw
— Live Law (@LiveLawIndia) January 24, 2023
সত্য জীবনের ঘটনা দ্বারা অনুপ্রাণিত চলচ্চিত্রগুলি কি আদৌ নিষেধ করা যেতে পারে? #দিল্লি হাইকোর্ট আসন্ন সিনেমা #ফারাজ মুক্তি বন্ধের আবেদন প্রসঙ্গে বাদী মায়েদের জিজ্ঞাসা করেছে।
২০১৬ সালে ঢাকার একটি ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলায় এই দুই মহিলা তাদের কন্যাকে হারিয়েছিলেন যার উপর ভিত্তি করে সিনেমাটি তৈরি হয়েছে। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাবে ছবিটি।
সত্যকে যদি বিকৃত করা যায়, সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা যদি অস্বীকার করা হয়, তাহলে সেটা ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যের অধিকার খর্ব করার বিষয়টি উল্লেখ করে লেখক, গবেষক হাসান মোরশেদ বলেছেন:
যে প্রশ্ন তুলেছেন অবিন্তা'র মা, সে প্রশ্ন কি অবান্তর? ফারাজ'কে নায়ক বানিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেছেন। দেখাচ্ছেন- ফারাজ অন্যদের বাঁচাতে নিজের জীবন দিয়েছে। হলি আর্টিজান কোন কল্পিত ঘটনা না। এটা ঘটে যাওয়া ঘটনা। ফারাজ অন্য নিহতদের মতোই একজন ভিক্টিম। একজন ভিক্টিমকে নিয়ে সিনেমা হতেই পারে। কিন্তু যখন দেখানো হচ্ছে সে অন্যদের বাঁচাতে নিজের প্রাণ দিয়েছে তখন ঐ ’অন্য’দের পোট্রে সত্য থাকেনা। অবন্তির মায়ের প্রশ্ন এজন্যই ভ্যালিড।
শিল্পীর স্বাধীনতা ও সেন্সর বোর্ড
হোলি আর্টিজান ঘটনার চিত্রায়নকে ঘিরে বিতর্কের মধ্যে শিল্পীর স্বাধীনতা এবং সেন্সরশিপের বিষয়টিও রয়েছে। বাংলাদেশি চলচ্চিত্র, শনিবারের বিকেল ও হোলি আর্টিজানে ঘটনার আলোকে নির্মিত, কিন্তু এটি মুক্তি পেতে চার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আবদুল আজিজ, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং শ্যাম সুন্দর দে প্রযোজিত চলচ্চিত্রটি ২০১৯ সালে ৪১তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল। একই বছরে, হোলি আর্টিজানের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা এবং পুলিশের হতাহতের ঘটনা বাদ দেওয়ার বিষয় উল্লেখ করে ১৫-সদস্যের সেন্সর বোর্ড ছবিটিকে বাংলাদেশে প্রদর্শনের জন্য অযোগ্য বলে রায় দেয়।
ভারতীয় সিনেমা ফারাজ নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিতর্কের মধ্যে অনেকেই শনিবারের বিকেল ছবির মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়। চাপের মুখে গত ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের আপিল কমিটি শর্ত সাপেক্ষে ছবিটির ছাড়পত্র দিয়েছে।
হোলি আর্টিজানে হামলা বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা। এরকম একটি ঘটনাকে নিজের মতো করে, নিজের স্টাইলে, এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণ কৌশলের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গা থেকে কিছুর করার স্বাধীনতা সব শিল্পীর থাকা উচিত। এতে হস্তক্ষেপ কাম্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক বিনয় দত্ত।
বাংলাদেশে সিনেমার সেন্সর বোর্ডে আটকে থাকার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে হূমায়ুন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪), রেজা ঘটকের ‘হরিবোল’ (২০১৯), চাকমা ভাষার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মর থেঙ্গারি’ (২০১৫), এবং অনন্য মামুনের ‘মেকআপ’ নামের সিনেমা রয়েছে।