দক্ষিণ বিশ্বের জন্যে টুইটার একটি দ্বি-ধারী তলোয়ার

Iঅলঙ্করণ করেছে গ্লোবাল ভয়েসেস

এই গল্পটি গ্লোবাল ভয়েসেসের নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দিরের মুখপত্র আন্ডারটোনসের অংশ। আন্ডারটোনসের গ্রাহক হোন

অজুত কোটিপতি ব্যবসায়ী এলন মাস্ক টুইটারের মালিকানা গ্রহণের পর অনেকেই মনে করেছিল টুইটার হয়তো ছাঁটাই এবং আকস্মিক দার্শনিক পরিবর্তনের মধ্যে টিকে থাকতে পারবে না। মার্কিন ভাষ্যের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কথাটি বলা হলেও টুইটারের ধীরগতি বা আকস্মিক পতন হয়তো দেশগুলিকে বিশেষভাবে উচ্চ মাত্রার নজরদারি, বিভ্রান্তি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় আক্রান্ত করতে পারে। তুরস্ক, ব্রাজিল, ভারত, পাকিস্তান, এল সালভাদর, আফগানিস্তান এবং ভেনেজুয়েলার নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দির এবং পরাধীনতা পর্যবেক্ষকের গবেষকরা টুইটারের সংকট কীভাবে তাদের গণমাধ্যম প্রতিবেশকে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছে।

সবার বিশ্বাস যে ব্রাজিল ছাড়া মুদ্রণ, ডিজিটাল এবং সম্প্রচার গণমাধ্যমে সরাসরি নজরদারির কারণে তুরস্ক, আফগানিস্তান এবং ভেনিজুয়েলার মতো – বা ভারতের মতো অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম দৃশ্যপটে টুইটার জাতীয় প্রকাশ্য আলোচনায় অন্যতম প্রধান একটি ভূমিকা পালন করে। এল সালভাদরে টুইটার রাষ্ট্রপতির সমালোচকদের হয়রানি করার জন্যে পরিচিত এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সরকারপন্থী কণ্ঠস্বরের দখলে থাকা ফেসবুকের মতো অন্যান্য সামাজিক গণমাধ্যম থেকে একেবারে আলাদা।

ভালোর জন্যেই হোক আর বা মন্দের জন্যেই হোক, ভেনিজুয়েলা, আফগানিস্তান এবং তুরস্কের বিভিন্ন জনমতের জন্যে টুইটার হলো প্রধান চ্যানেল। “শ্যাভেজবাদ চলাকালীন, ৬০টিরও বেশি স্বাধীন (প্রধানত ডিজিটাল) গণমাধ্যম, ২৩৩টি বেতার কেন্দ্র এবং ৮০টি সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ভেনিজুয়েলায় সামাজিক গণমাধ্যম মূলত বিনোদনের উৎসের মতো: তথ্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্যে একটি মৌলিক জানালা,” বলেছেন নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দিরের একজন গবেষক গ্যাব্রিয়েলা মেসোনেস রোজো। ভিন্নমতাবলম্বীদের জন্যে তুরস্কে টুইটার কোনোভাবেই নিরাপদ স্থান না হলেও এটি প্রান্তিক গোষ্ঠীর উদ্বেগ প্রকাশ করার একটি পথ। তুরস্কের গবেষক সেন্সার ওদাবাসি বলেছেন, “ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন (সংখ্যালঘু, নারী, এলজিবিটিআই+, প্রাণী ইত্যাদি) গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে বা সরকারের সাথে যুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সংঘটিত অনেক ঘটনা টুইটারে চাউর হওয়ার পরেই কেবল জন্গণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে।” পাকিস্তানেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হত্যা মামলা টুইটারে জনসাধারণের চাপে দৃশ্যমান হওয়ার ফলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়, পাকিস্তানের একজন গবেষক আলী ওসমান বলেছেন।

নিজ দেশে যা ঘটছে তা জানা এবং বিভিন্ন সমস্যার কভারেজ আরো বাড়ানোর জন্যে প্রবাসে থাকা লোকেদের জন্যে টুইটার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তান, ভেনিজুয়েলা এবং এল সালভাদর সহিংসতা, রাজনৈতিক উত্থান বা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে এবং তাদের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ তাদের সীমান্তের বাইরে রয়েছে। “ভেনিজুয়েলার ৭১ লক্ষেরও বেশি অভিবাসী এবং শরণার্থী রয়েছে  অনেক ক্ষেত্রে এদের ভেনিজুয়েলার সাথে সংযোগ সামাজিক গণমাধ্যমেই হয়” – বিশেষ করে যখন সরকার অন্যান্য গণমাধ্যম চ্যানেলগুলি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

গণমাধ্যমের বিষয়ে টুইটারের অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব থাকলেও দেশগুলির ব্যাপক সমস্যার তুলনায় টুইটারের আসন্ন মৃত্যুর খবর খুব বেশি উদ্বেগের বিষয় নয়। তুর্কি সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীরা তাদের দেশের আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতির বিষয়ে এবং সক্রিয় ডিজিটাল কর্মীরা সরকারের নতুন পূর্ণ নজরদারির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বিগ্ন। পাকিস্তানি ব্যবহারকারীরা দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রধানত বিদেশ থেকে টুইটকারী নির্বাসনে থাকা আফগানরা তালেবান সরকারের ভাষ্য মোকাবেলা করার চেষ্টা করছে। দক্ষিণ বিশ্বে মাস্কের মালিকানা এবং পরবর্তী “টুইটার সংকট” এর খবরটি মূলত কৌতুক এবং মেমের মাধ্যমে ভাগাভাগি হয়।

টুইটার যদি টিকেও থাকে তাতে যেকোনভাবেই হোক মাস্কের মঞ্চটির পরিচয় প্রমাণীকরণ পরিবর্তন এই দেশগুলির জন্যে খারাপ হবে। ইতোমধ্যেই আফগান টুইটারে কে কী তা জানা কঠিন হয়ে পড়েছে, নিরাপত্তার কারণে যাকে বেনামে রাখা আফগানিস্তানে আমাদের গবেষক বলেছেন। তাদের জন্যে, টুইটারের নতুন পরিশোধিত যাচাইকরণ ব্যবস্থার “মানে হলো যে তালেবান এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অনেক সদস্য সম্ভাব্যভাবে যাচাইকৃত অ্যাকাউন্ট পেতে পারে এবং তাদের সুবিধার জন্যে ভুল তথ্য দিতে পারে, এবং এটা উদ্বেগজনক,” তারা বলে। ওসমান বলেছেন, পাকিস্তানেও, উচ্চতর বিভ্রান্তি “জনসংখ্যাকে আরও বিভক্ত করতে পারে” এবং কিছু ক্ষেত্রে, “সহিংসতার দিকে ধাবিত করতে পারে”। মেসোনেস রোজো আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ভেনিজুয়েলায় টুইটারের প্রাক্তন সঞ্চালকেরা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মঞ্চটির স্প্যাম নীতি লঙ্ঘনের জন্যে ২২৭টি অ্যাকাউন্ট উপড়ে ফেলে প্রকারান্তরে সরকারের অনলাইন প্রচারণাকেই সাহায্য করেছিল।

ব্রাজিল এবং ভারতের উগ্র ডানেরা মাস্কের মালিকানা এবং ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট পুনঃস্থাপনের প্রশংসা করেছে এই আশায় যে মাস্ক তাদের নিজেদের উগ্র-ডান ব্যক্তিবর্গ এবং টুইটের ক্ষেত্রেও একই কাজ করবে।

ব্রাজিল “তার পর্যালোচনা তালিকায় রয়েছে” বলে মাস্ক ব্রাজিলীয় রক্ষণশীল বিশেষজ্ঞদের যে নিশ্চয়তা দিয়েছেন তা ব্রাজিলের কথিত নির্বাচনী জালিয়াতি সম্পর্কে একগাদা মন্তব্য উগড়ে দিয়েছে। ব্রাজিলীয় ডানপন্থী আলোচনায় মাস্কের অংশগ্রহণ ভুল তথ্যের একটি মঞ্চ তৈরি করেছে। ঐ একই দিনে অ্যাকাউন্টে ভুল তথ্য ভাগাভাগির জন্যে পরিচিত জনপ্রিয় রক্ষণশীল ব্যক্তিত্ব মার্সেলো রোচা মন্তেইরো টুইটারে ফিরে আসেন

এবং এমনকি আদৌ পরিবর্তিত না হয়ে টুইটার এখনকার মতো এমনকি একটি সেন্সরবিহীন প্রকাশ্য ফোরাম থাকলেও তা মোটেই নিরাপদ নয়। , , তুর্কি টুইটারে সিরীয় শরণার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংস হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করতে সাহায্যকারী বড় বড় অ্যাকাউন্টগুলি এখনো খোলা এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংবাদ সংস্থাগুলি নিষিদ্ধ রয়েছে। “টুইটার সরকারের সাথে তাদের ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে তথ্য ভাগাভাগি করার পাশাপাশি চাহিদা অনুযায়ী অ্যাকাউন্ট সেন্সরের বিষয়ে সন্দেহের তালিকায় রয়েছে,” ওদাবাসি বলেছেন। “কোম্পানিটি এতোটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে এটিকে আরো খারাপ করা খুবই কঠিন।” এল সালভাদরে সরাসরি গণমাধ্যম নজরদারি না থাকলেও সরকার টুইটারে মত প্রকাশকারী ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরকে হয়রানি এবং অপরাধী করেছে বিশেষ করে, নারী সাংবাদিকদের

ভারত এবং ব্রাজিলে অন্যান্য মঞ্চে স্থানান্তরিত হওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ এবং সমর্থকরা টুইটারের নড়বড়ে পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে ভারতের টুইটারের সমতুল্য মোদির দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত “কু” এর প্রচারণা চালাচ্ছে। গণবিক্ষোভের সময় টুইটার সরকারের সমালোচনামূলক বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ করতে অস্বীকার করলে ২০২০ সালে এটি তৈরি করা হয়। “অনেকটাই টুইটারের অনুলিপি এই কু বিপর্যয়ের সময় একটি জাতীয় বিকল্প হিসেবে উত্থিত হয়, এবং অনেক ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও আমলা অ্যাকাউন্ট তৈরি করে এটি নিয়মিত ব্যবহার করে এটিকে সমর্থন করে,” ভারত গবেষক সেতু বন্ধ উপাধ্যায় বলেছেন৷

ব্রাজিলে উদারপন্থী ও প্রগতিশীলরা টুইটার ত্যাগ করার হুমকি না দিলেও ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা সংগঠিত করছে। তারা “সংবেদনশীল ডিএমগুলি মুছে ফে্লে অতি সাম্প্রতিককালের ‘কু’-এর মতো মাস্টোডন এবং অন্যান্য মঞ্চে স্থানান্তরিত হচ্ছে,” পরাধীনতা পর্যবেক্ষকের গবেষক লাইস মার্টিন্স বলেছেন৷ এদের অধিকাংশই ভারত সরকারের সাথে কু-এর সম্পর্কের বিষয়ে অবগত না হলেও তারা “কু” শব্দটি পর্তুগিজ ভাষায় “গাধা” শব্দের মতো শোনায় বলে এটি নিয়ে রসিকতা করছে।

রাজনৈতিক আলোচনায় টুইটারের অনেকটা একচেটিয়া অধিকার, এর আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারীদের বিস্তৃত ভিত্তি এবং এর দ্রুত-শিখতে পারা অ্যালগরিদম এটিকে অনেক সফল করে তুললেও এটি বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক, কর্মী এবং ভিন্নমত পোষণকারীদের জন্যে বিপজ্জনক। মাস্কের কিনে নেওয়ার আগে থেকেই টুইটার একটি দ্বি-ধারী তলোয়ার হলেও বর্তমানে এর ফলকটি আরো ধারালো হয়েছে।

পরাধীনতা পর্যবেক্ষকের মিশন এবং কার্যপদ্ধতি  সম্পর্কে আরো জানুন। আমরা যা করি তা কেন করি সেটা সম্পর্কে জানার একটি ভাল জায়গা এই গল্পটি

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .