কণ্ঠরোধ: পাকিস্তানে নির্বাচনের পর এক্স ও ভিপিএন নিষিদ্ধ

Journalists waiting for the results at the premises of the Election Commission of Pakistan (ECP). February 8, 2023. Image by Ramna Saeed. Used with permission.

পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) প্রাঙ্গণে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার অপেক্ষায় সাংবাদিকবৃন্দ, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। ছবি: রমনা সাঈদ। অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

সাম্প্রতিক নির্বাচনের পরে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার অনিশ্চয়তায় পাকিস্তান একটি সংকটময় পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত।

ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখে নির্বাচনের দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পরে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তত্ত্বাবধায়ক সরকার মসৃণ হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে বলে মনে না হলেও এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই, দেশের জনগণের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা আবার এক্স (আগের টুইটার) ও ভিপিএন পরিষেবা নিষেধাজ্ঞা আবির্ভূত হয়েছে। এর আগে নির্বাচনের দিন থেকে করে কয়েকদিন ইন্টারনেট বন্ধ রেখে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়।

আরো পড়ুন: পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইন্টারনেট বন্ধ ও হতাশা

নির্বাচনের পর পাকিস্তানে একটি নতুন সরকার কাজ চালানোর কথা থাকলেও, কোনো একক রাজনৈতিক দল সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারায় বিষয়গুলো প্রত্যাশিতভাবে প্রকাশ পায়নি। বর্তমানে, দেশ পরিচালনার জন্যে কারা জোট গঠন করবে তার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলি একে অপরের সাথে আলোচনা করছে। এই অনিশ্চয়তা পাকিস্তানের ভবিষ্যত গতিপথ নিয়ে জনগণকে আশাহত করেছে।

আরো পড়ুন: পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৃশ্যপট: ২০২৪ সালের নির্বাচন থেকে প্রত্যাশা

সামাজিক গণমাধ্যম নিষিদ্ধ

বিলম্বিত ফলাফলের কারণে এবং কোনো স্পষ্ট বিজয়ী না থাকার অনিশ্চয়তার মধ্যে ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ এক্স আবার অবরুদ্ধ হয় । একইদিনে, রাওয়ালপিন্ডির কমিশনার লিয়াকত আলী চট্টা সাধারণ নির্বাচনে কারচুপিতে জড়িত থাকার ঘোষণা দিলে পাকিস্তানের বর্তমান প্রধান বিচারপতি অভিযোগটি খন্ডন করেছে। পরে বিবৃতি প্রত্যাহার করে চাট্টা তাকে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) কারচুপির অভিযোগ করার বিনিময়ে একটি ‘লাভজনক অবস্থান’ প্রস্তাব  করেছিল বলে দাবি করে। নিষেধাজ্ঞাটি এর সাথে যুক্ত হতে পারে।

আরেকটি জল্পনা হলো পিটিআই কথিত কারচুপির প্রতিবাদ করার পরে পিটিআই-সমর্থিত জাতীয় পরিষদের আসনের প্রার্থী সালমান আকরাম রাজাকে পুলিশ সংক্ষিপ্তভাবে আটক করে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ২৪ ফেব্রুয়ারির খবর অনুযায়ী এক্স অপ্রবেশ্য ছিল এক সপ্তাহেরও বেশী সময় ধরে

বন্ধ জনগণকে মঞ্চ ব্যবহারে বিরত করতে পারেনি; পরিবর্তে তারা নিজেদেরকে প্রকাশ করতে ও দেশের তত্ত্বাবধায়ক কাঠামোর নিন্দা জানাতে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে এক্সে প্রবেশ করলেও কিছুক্ষণ পরেই বেশ কয়েকটি ভিপিএনও কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

পাকিস্তানে বেশিরভাগ জনপ্রিয় ভিপিএন ব্লক করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তবে বিভিন্ন আইএসপির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে৷
উদার সাংবিধানিক অধিকার সত্ত্বেও বিধিনিষেধ দৃঢ় করতে এবং পাকিস্তানকে ফায়ারওয়ালের চীনা মডেলের দিকে নিয়ে যেতে রাষ্ট্র ও @পাকিস্তানসরকারিপিটিএ সচেষ্ট।

উচ্চতর বিচার বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে।

পাকিস্তানের মানবাধিকার কমিশন এই বন্ধের নিন্দা করেছে:

ইন্টারনেট বা যেকোনো সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ ব্যাহত বা বন্ধ করা অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্যকে রক্তাক্ত করে এবং ইতোমধ্যে একটি ভঙ্গুর ও সংগ্রামী অর্থনীতির দুর্দশা বাড়িয়ে দেয়। এটি জনগণের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকারও লঙ্ঘন করে। এই…

ডিজিটাল অধিকার কর্মী উসামা খিলজি ভিপিএনগুলিকেও কেন অবরোধ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে পাকিস্তান টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষ (পিটিএ) এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী উমর সাইফকে প্রতিক্রিয়া জানাতে বলেছেন:

পাকিস্তানে প্রায় ২৪ ঘন্টা টুইটার/ এক্স অবরোধের পর থেকে নির্দিষ্ট কিছু ভিপিএন ছাড়া প্রবেশযোগ্য নয়। বেশিরভাগ ব্যবহারকারী তাদের ভিপিএনগুলিও অবরোধ ও ধীরগতির ইন্টারনেটের অভিযোগ করছে।
ইন্টারনেটে নির্বিঘ্ন প্রবেশ নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা @পাকিস্তানসরকারিপিটিএ বা @উমরসাইফ একটি কথাও বলেনি। লজ্জাজনক।

একজন সাংবাদিক জাভেরিয়া সিদ্দিকী ইন্টারনেট ধীর হওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন:

এক্স (পূর্বে টুইটার) সপ্তাহান্ত থেকে পাকিস্তানে অবরুদ্ধ এবং বেশিরভাগ জনগণ ভিপিএনের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করছে। আজকে এখন থেকে আমরাও ধীর গতির ইন্টারনেট অনুভব করছি।

ডিজিটাল গণমাধ্যম বিপণনকারী আনাস টিপুর মতো ব্যবহারকারীরা অন্যদের সক্রিয় ভিপিএনগুলি ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়েছেন:

পাকিস্তানে টুইটারএখনো বন্ধ রয়েছে।

১.১.১.১ ক্লাউডফ্লেয়ার সেরা ভিপিএন এবং বিনামূল্যে পাওয়া যায়।

ডিজিটাল অধিকার কর্মী সিরাত খান পিটিএ-কে জিজ্ঞেস করেছেন এই নির্লজ্জ লঙ্ঘনগুলির পেছনের যুক্তি কী:

আজ ৪ দিন আমরা এখনো কিছু নির্বাচিত ভিপিএন ছাড়া এক্স/ টুইটারে ঢুকতে পারি না। কোন জবাবদিহিতা ছাড়া চারপাশটা চলছে কীভাবে? কীভাবে এই নির্লজ্জ লঙ্ঘন ন্যায়সঙ্গত? @পাকিস্তানসরকারিপিটিএ

আদালত পিটিএ’কে প্রশ্ন করেছে

গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইন্টারনেট বন্ধের বিরুদ্ধে শুনানির সময় সিন্ধু উচ্চ আদালতের (এসএইচসি) প্রধান বিচারপতি আকিল আহমেদ আব্বাসি বারবার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ও বিঘ্নের জন্যে পিটিএ, স্বরাষ্ট্র ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে প্রশ্ন  করেন কখন ইন্টারনেট পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করা হবে। পিটিএ বলেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এটিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারি করা নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে হয়। এটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ৮ ফেব্রুয়ারি মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করে। এদিকে কেন্দ্রীয়  সরকার বলেছে প্রাদেশিক সরকারগুলির অনুরোধে ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করা হয়। অন্যদিকে, সিন্ধু সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী একজন আইনজীবী কেন্দ্রীয় সরকারকে এমন নির্দেশনা দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।

নির্বাচনের ঠিক আগে অধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট জিবরান নাসির সিন্ধু উচ্চ আদালতে পিটিএ, স্বরাষ্ট্র ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে বারবার দের নির্বাচনী প্রচারণা ও তথ্যের জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে প্রভাবিত করা ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ ও বিঘ্ন সম্পর্কে আবেদন করেন। এসএইচসি মামলায় স্থগিতাদেশ জারি করে নির্বাচনের সময় কর্তৃপক্ষকে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ না করার নির্দেশ দেয়।

Protest outside Islamabad Press Club against alleged rigging in the elections. Image by Ramna Saeed. Used with permission.

নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে ইসলামাবাদ প্রেসক্লাবের বাইরে বিক্ষোভ। ছবি: রমনা সাঈদ। অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

পাকিস্তানের বন্ধের উপর ঘনিষ্ঠ নজর:

ইন্টারনেট পর্যবেক্ষকেরা পাকিস্তানে বন্ধ বৃদ্ধি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন দিয়েছে। সাইবারনিরাপত্তা সংস্থা সার্ফশার্ক তার প্রকাশিত ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলেছে পাকিস্তানে মাত্র এক বছরে রাজনৈতিক কারণে চারটি বন্ধ ঘটেছে

আয়ক্সেস নাউ (এখনি_প্রবেশাধিকার) কীভাবে সিন্ধু উচ্চ আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করা হচ্ছে তা তুলে ধরেছে:

উচ্চ আদালতের সংযোগ পুনঃস্থাপনের আদেশ সত্ত্বেও পাকিস্তানের জনগণ টানা ষষ্ঠ দিন এক্স থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। @পাকিস্তানসরকারিপিটিএ + @তথ্যওসম্প্রচার_কর্মকর্তাদেরকে অবশ্যই অস্বচ্ছভাবে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চগুলিতে জনগণের প্রবেশাধিকার অবরোধ বন্ধ করতে হবে! #চালিয়েযাও

নেটওয়ার্ক বিঘ্নের মুক্ত মাননন্দির (ওওএনআই) পাকিস্তানের আইএসপিগুলির বাস্তব সময়ের ডেটা প্রকাশ করে:

‼️ গতকাল ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ থেকে  #পাকিস্তানের অনেক আইএসপি টুইটার/ এক্স অবরোধ শুরু করেছে।

ওওএনআই ডেটা অনুসারে টিএলএস হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অবরোধটি প্রয়োগ করা হয়েছে।

বাস্তব সময়ে প্রকাশিত ওওএনআই ডেটা

নেটব্লক পাকিস্তানে সাত দিনের জন্যে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ এক্স অবরোধের কথা উল্লেখ করেছে:

⚠️ হালনাগাদ: টেলিযোগাযোগ বন্ধ রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরে ভোট কারচুপির বিষয়ে উচ্চতর উদ্বেগের মধ্যে সরাসরি মেট্রিক্স অনুসারে #পাকিস্তানের এক্স/ টুইটার অবরোধের সপ্তম দিনে চলছে; ভিপিএন পরিষেবাগুলিও ব্যাপকভাবে অবরুদ্ধ, ব্যবহারকারীদের অনলাইনে যেতে অসুবিধা হচ্ছে

ইন্টারনেট বন্ধের ইতিহাস

পাকিস্তানে ইন্টারনেট বা একটি নির্দিষ্ট সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ বন্ধ করা  এবারই প্রথম নয়। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা ২০০৬ সাল থেকে বেশিরভাগ তাদের কথিত নিন্দামূলক বিষয়বস্তুর কারণে ব্লগস্পট, ইউটিউব এবং ফেসবুকের মতো মঞ্চ বন্ধের মুখে পড়েছে। তবে নিরাপত্তার কারণে উৎসবের দিনে ইন্টারনেটে প্রবেশ করতে না পারার ঘটনাও ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ইন্টারনেটে প্রবেশ, মোবাইল পরিষেবা ও সামাজিক গণমাধ্যম অ্যাপগুলি অবরুদ্ধ বা বিঘ্নিত করা হয়েছে।

গত বছর ৯ মে, ২০২৩ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের সময় জনগণ কয়েক দিনের জন্যে ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার বঞ্চিত হয়। ডিসেম্বরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ হয়ে গেলে  ৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের নির্বাচনী প্রচারণায় বেগ পেতে হয়।

পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) বা পিএমএলএন সমর্থিত জাতীয় পরিষদের প্রার্থী সরদার মহসিন আব্বাসি হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন: “কর্মীদের মাধ্যমে পিটিআই নেতৃত্বের তৈরি পাকিস্তানি নাগরিকদের রাজনৈতিক মতামতকে প্রভাবিত করার নিয়ন্ত্রণ ও একচেটিয়াত্ব ভেঙে ফেলে দেশের নাগরিকদের উপর বিধিনিষেধের পরিবেশ চাপিয়ে দেওয়া টুইটার নিষেধাজ্ঞার কারণ।“

স্বাধীনতা নেটওয়ার্ক পাকিস্তানের ইকবাল খট্টক হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে গ্লোবাল ভয়েসেসকে জানিয়েছেন: “পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় ইন্টারনেট বন্ধ করার একটি কুখ্যাত ইতিহাস রয়েছে। ভুল নির্দেশিত এই পদ্ধতিটি নাগরিকদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে।”

গণতন্ত্রের জন্যে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাদাফ খান গ্লোবাল ভয়েসেসকে বলেছেন: “আমাদের যুগে ইন্টারনেট ও মোবাইল আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এটি বন্ধ হয়ে গেলে তা রাজনৈতিক সংহতিকে প্রভাবিত করে; নাগরিকরা গতিশীলতার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, এবং এটি তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকেও বাধা দেয়।”

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .