বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। এদেশে বন্যা এখনো সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে কারণ বর্ষা মৌসুমে দেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার (মূল ভূমির ১৮%) পর্যন্ত পানির নিচে তলিয়ে যায়। প্রতি বছর হাজার মানুষ মারা যায় এবং লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুৎ হয়।
এ বছর জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা অঞ্চলে বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর আগে মে মাসে সিলেট বিভাগ মৌসুমের প্রথম বন্যায় প্লাবিত হয়েছিল। তবে জুন মাসের মাঝামাঝি ভারতের সীমান্তবর্তী মেঘালয় ও আসাম রাজ্য গুলিতে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের ফলে পুনরায় বন্যার সূত্রপাত হয়। এই অতিরিক্ত পানির ঢল দ্রুত স্রোতধারার সাথে নিচে নামতে গিয়ে নদী উপচে নিন্মাঞ্চল প্লাবিত করে। সীমান্তবর্তী নিচু হাওর এলাকা ছাড়াও এই অঞ্চলের প্রধান শহর ও ব্যবসা কেন্দ্র, যেমন সিলেট ও সুনামগঞ্জ দ্রুত পানির নিচে চলে যায়।
The worst #flood in decades has hit #Sylhet and other localities in Bangladesh. People & animals stranded on rooftops. Schools, businesses & houses in undated. Electricity & transport disrupted. @GretaThunberg#Sylhetflood #Bangladesh pic.twitter.com/beETNjTIbX
— Fridays For Future – Bangladesh (@FFF_Bangladesh) June 18, 2022
বিগত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ #বন্যা #সিলেট এবং বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় আঘাত হেনেছে। ছাদে আটকা পড়েছে মানুষ ও পশুপাখি। স্কুল, দোকান এবং বাসাবাড়ি পানির নিচে। বিদ্যুৎ ও পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ আছে। @গ্রেটাথানবার্গ #সিলেট বন্যা #বাংলাদেশ
কিছু কিছু এলাকায় পানি ৮ ফুট পর্যন্ত বেড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। অনেকে বলছেন এটি এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক বন্যা। দুর্ঘটনা এড়াতে প্লাবিত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত লক্ষ লক্ষ মানুষকে অন্ধকারে ফেলে দেয়। বিশেষ করে রাতের আধারে অঞ্চলটিগুলোকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকার মতো মনে হচ্ছিল। বিদ্যুৎ দীর্ঘ সময় না থাকায়, এই অঞ্চলের ৩৬০০টিরও বেশি মোবাইল টাওয়ারের বেশিরভাগ বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে লক্ষ লক্ষ পানিবন্দি মানুষ যারা ইতোমধ্যেই খাদ্য এবং বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকটে ভুগছে, তারা যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পরে। রানওয়ে পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সিলেটের স্থানীয় বিমানবন্দর ছয় দিন বন্ধ ছিল। আক্রান্ত শহরগুলো ও দেশের বাকি অংশের মধ্যে সড়ক ও রেল যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়, ফলে এই অঞ্চলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এমন ভয়াবহ বন্যা এ অঞ্চলের মানুষ আগে দেখেনি জানিয়ে একজন ছাত্রী মারিয়া কিবশিয়া লিখেছেন:
The people of #Sylhet have never seen such a catastrophic #flood before. Most of the peoples living spaces are now under flood water.Electricity & internet supply is unavailable due to flood. #BangladeshArmy carrying out rescue operation. The airport flooded, and flights canceled pic.twitter.com/a3hPXwVvpP
— Maria Kibtia 🇧🇩 (@Mariakibtia4065) June 18, 2022
সিলেটের মানুষজন আগে কখনো এমন ভয়াবহ বন্যা দেখেনি। অধিকাংশ মানুষের বাড়িঘর এখন পানির নিচে। বন্যার কারণে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিমানবন্দর প্লাবিত, ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেছে।
মে মাসের মাঝামাঝি থেকে ২৪ জুন, শুক্রবার পর্যন্ত বন্যা থেকে ৬৮ জনেরও বেশি লোক মারা গেছে। বন্যার আকস্মিকতা এবং সবধরনের যোগাযোগ বিঘ্নিত হওয়ার কারণে সরকারি ত্রাণ প্রচেষ্টা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছাতে সময় নিচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে জরুরি ত্রাণ বিতরণ এবং বন্যার্তদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
মানুষ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে
বন্যা কিছুটা কমলেও মানুষ এখনো নিরাপদ নয়। বন্যাদুর্গতদের সহায়তা দিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠন ও সাধারণ মানুষ নানাভাবে এগিয়ে এসেছেন ও তহবিল/রিলিফ সংগ্রহ করছেন। সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তারা বন্যা কবলিত মানুষদের উদ্ধার ও তাদের মাঝে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি বিতরণ করছেন। লেখক হাসান মোরশেদ ২০০৪ এবং ২০১৭ সালের বন্যায় এ অঞ্চলে সরাসরি কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন উদ্ধার অভিযান। তিনি তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন:
[…] তাহলে এই মুহুর্তে মানুষের আসলে প্রয়োজন কী? এই মুহুর্তে মানুষের আসলে প্রয়োজনে- উদ্ধার। মানুষকে আক্রান্ত এলাকা থেকে দ্রুত নিরাপদে সরিয়ে আনা। সরিয়ে আনার পর খাওয়া দাওয়ার চিন্তা। সরিয়ে আনার কাজ কি যে কারো পক্ষে সম্ভব? না সম্ভব না। এর জন্য বিশেষায়িত উদ্যোগ প্রয়োজন।
এই বিশেষায়িত উদ্যোগটুকু স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগী হিসেবে শুরু করে সেনাবাহিনী।
বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক সারাদেশে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। সুনামগঞ্জে তাদের সব অফিস পানিতে গেছে জানিয়ে ট্ইুট করেছেন প্রতিষ্ঠানটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আসিফ সালেহ:
Sylhet flood situation is really bad and is going from bad to worse quickly. We are mobilising support. This is picture that came from our field staff just now. All our offices in Sunamganj are flooded. pic.twitter.com/opFWWaWGEH
— Asif Saleh (@asifsaleh) June 17, 2022
সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এটা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমরা জরুরি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদেও মাঠপর্যায়ের কর্মীর কাছ থেকে এই ছবিটি মাত্রই পেলাম। সুনামগঞ্জে আমাদের সব অফিস বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
এই সংগঠন ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে তারা ৫২,০০০ পরিবারকে জরুরি ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সহায়তা করবে।
এদিকে মানুষের দুর্ভোগকে পুঁজি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ নেই, এই অবস্থায় সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মোমবাতি পাওয়া যাচ্ছে না। দুয়েক জায়গায় পাওয়া গেলেও ২০ টাকার মোমবাতির দাম ১০০ টাকা। উদ্ধার অভিযানের জন্য সবচেয়ে জরুরি নৌকা ও ট্রলার। সেটার ভাড়াও বেড়ে গেছে বহুগুণ – কেউ কেউ দু ঘণ্টার ট্রিপের জন্যে ৩০,০০০ টাকা চাচ্ছে। এমনকি টাকা দিয়েও ভাড়া করতে পারছে না দুর্গত মানুষ।
তবে, এর বিপরীত চিত্রও আছে। বিপদের সময়ে এগিয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে। তেমন একটা গল্পই জানালেন আলিম আল রাজি:
গতকাল গোয়াইনঘাট এলাকার এক হাওর থেকে ফুপু এবং ফুপাতো ভাই-বোনদের উদ্ধার করে আনলাম।
কোনো নৌকাই পাওয়া যাচ্ছিলো না। কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পর শেষমেষ মাঝারি আকৃতির একটা নৌকা জোগাড় হয়েছিলো। নৌকার চালক কম বয়েসী। ১৭ বা ১৮ হবে বড়জোর।
বিশাল হাওর পাড়ি দিয়ে, কিছু যায়গা ঠেলে, কিছু যায়গা বৈঠা বেয়ে সে যখন সবাইকে নিয়ে আবার তীরে ফিরে এলো তখন সে কোনো টাকাই নিতে চায়না। অনেক জোরাজোরির পর তার হাতে ৫০০ টাকা গুঁজে দিয়ে এসেছিলাম।ছেলেটির নাম ছিলো বাসার। বাসারের কথাও টাইমলাইনে থাকুক।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের এক টাকায় আহার কর্মসূচী তাদের ভ্রাম্যমাণ রান্নাঘর নিয়ে অতি দুর্গম স্থানে ছুটে চলেছেন পানিতে আটকে পরা হাজারো মানুষকে খাদ্য দিয়ে জীবন বাঁচাতে।
ভ্রাম্যমাণ রান্নাঘর এখন সুনামগঞ্জের চালবনের উদ্দেশ্যে…. রান্না হচ্ছে ডিম খিচুড়ি….গরম গরম খাবারের অপেক্ষায় আছে শত শত শিশু….
বারে বারে বন্যা, কারণ কী?
সিলেট, সুনামগঞ্জে হঠাৎ এই বন্যার পিছনে ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির প্রবল বৃষ্টিপাত মূলত দায়ী। সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকার শুরু হয়েছে। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি সিলেট ও সুনামগাঞ্জের নিন্মাঞ্চল ও হাওরে এসে মেশে।
আইটি প্রফেশনাল এম কে ফাহিম টুইট করেছেনঃ
Cherrapunji records 811.6 mm rainfall in a single day yesterday. Highest in last 27 years while Mawsynram, which is 10 km aerial distance away and also the wettest place on planet earth records 710.6 mm rainfall. #Cherrapunji #Sylhetflood #Meghalaya #Sunamganj #Bangladesh pic.twitter.com/Gih06eiwsp
— Fahim (@Fahimiaan) June 18, 2022
চেরাপুঞ্জিতে গতকাল এক দিনে ৮১১.৬ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এটি গত ২৭ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়াও ১০ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত মাওসিনরাম, যা পৃথিবীর সবচেয়ে আর্দ্র স্থান – সেখানেও ৭১০.৬ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
মেঘনা নদী এবং এর উপনদীগুলি উত্তরে উজান থেকে পানি বহন করে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণে সমুদ্রে নিয়ে যায়। কিন্তু নদীর নাব্যতা কমায় সেই অতিরিক্ত পানি নদী সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত করেছে।
এছাড়াও অপরিকল্পিত উন্নয়ন বন্যার কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। বিবিসি বাংলা’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান:
হাওরে বিভিন্ন জায়গায় পকেট পকেট আমরা রোড করে ফেলেছি। ফলে পানি প্রবাহে বাধার তৈরি হচ্ছে। শহর এলাকায় বাড়িঘর তৈরির ফলে পানি আর গ্রাউন্ডে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। যার ফলে বন্যার তীব্রতা আমরা বেশি অনুভব করছি। এসব কারণে আগাম বন্যা হচ্ছে এবং অনেক তীব্র বন্যা হচ্ছে।
অতিবৃষ্টির কারণে এমন বন্যার পিছনে অনেকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির দায় দেখতে পেয়েছেন। মোহাইমিনুল ইসলাম এখনই তাই অ্যাকশন নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন:
Climate has already changed! This time Sunamganj in Bangladesh is floating in the flood water. There is no new word. Proper implementation of the word is required. Climate justice at the moment! 🇧🇩 #ClimateCrisis #ClimateEmergency #ClimateActionNow @GretaThunberg pic.twitter.com/O6iBnrpWUt
— Mohaiminul Islam Zipat (@Zipat_YN) June 17, 2022
জলবায়ু ইতোমধ্যে বদলে গেছে। এবার বন্যার পানিতে ভাসছে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ। নতুন করে আর কোনো কথা নয়। যথাযথ বাস্তবায়ন এখনই প্রয়োজন। এই মুহূর্তে দরকার জলবায়ু নিয়ে ন্যায়বিচার।
যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের সদস্য বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুশনারা আলী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব উল্লেখ করে টুইট করেছেন:
Bangladesh is one of the most climate vulnerable countries in the world. Heavy monsoon downpours means hundreds of thousands stranded.Sylhet where I & many of my constituents have family has been hit extremely hard. My thoughts are with all those affected.https://t.co/6Qba68Hszz
— Rushanara Ali 💙 (@rushanaraali) June 17, 2022
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বর্ষায় ভারী বৃষ্টি হলেই লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। সিলেটে, যেখানে আমার এবং আমাকে যারা নির্বাচিত করেছেন, তাদের অনেকের পরিবার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রতি আমার সমবেদনা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর ৪ লাখ মানুষ গ্রাম থেকে স্থায়ীভাবে শহরে চলে আসছেন। তাদের মধ্যে শতকরা ৭০% জলবায়ু উদ্বাস্তু। সমূদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানির লবণাক্ততা বাড়া, নদী ভাঙ্গন এবং ঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার অভিঘাতে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে৷