বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ভৌগলিকভাবে মেগাসিটি হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এই শহরে দুই কোটির বেশি মানুষ বসবাস করেন।
তবে জনসংখ্যার তুলনায় এ শহরে খোলা জায়গা, পার্ক ও খেলার মাঠের সংখ্যা খুবই কম। আর সেই সংখ্যা দিন দিন কমছে। বিগত কয়েক দশকে, পার্ক এবং খোলা জায়গায় বাজার, মসজিদ, রিকশা গ্যারেজ, পার্কিং লট এবং বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করেছে সরকারী সংস্থাগুলি। সম্প্রতি নগরীর কলাবাগান এলাকায় শিশুদের খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত একটি খোলা জায়গায় থানা ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হলে এলাকাবাসীর বিক্ষোভের মুখে পড়ে।
শিশুরা খেলবে কোথায়?
জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ঢাকায় খোলা জায়গা দুষ্প্রাপ্য ও অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে।
শহরের ঘিঞ্জি কলাবাগান এলাকার একটি ছোট গলির পাশে ২০ শতাংশ (০.২ একর) খোলা জায়গা তেঁতুলতলা মাঠ নামে পরিচিত এবং স্থানীয় শিশুরা গত পাঁচ দশক ধরে এটিকে খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। গত ৩১শে জানুয়ারী ২০২২ তারিখে, কলাবাগান থানার জন্য একটি স্থায়ী ভবন নির্মাণের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে ঐ স্থানটি বরাদ্দ করা হয়েছিল। থানাটি বর্তমানে একটি ভাড়া বাড়িতে রয়েছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে, পুলিশ কাঁটাতার দিয়ে জায়গাটি ঘেরাও করে দেয়। এর পরই স্থানীয়রা শিশুদের খেলার জন্য জমি ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে প্রতিবাদ শুরু করে। এলাকাবাসী বিভিন্ন সময় প্ল্যাকার্ড নিয়ে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন করে। “তেঁতুলতলা মাঠ আমাদের প্রাণের দাবী” শিরোনামের ফেসবুক পেজে প্রতিবাদ প্রচারণাগুলো রয়েছে কিন্তু বিষয়টি শহরের অনেকের কাছেই অজানা ছিল।
বিষয়টি খবরের শিরোনাম হয় গত ২৪শে এপ্রিল যখন স্থানীয়দের প্রতিবাদ প্রচারণার সমন্বয়কারী সৈয়দা রত্না এবং তার ছেলে মোহাম্মদ ইশা আবদুল্লাহকে পুলিশ আটক করে। সেসময় তারা তেঁতুলতলা মাঠে একটি সীমানা প্রাচীর নির্মাণের প্রতিবাদ করছিল। পুলিশ জানিয়েছে যে তারা মাঠ থেকে ভিডিও ধারণ ও ফেসবুকে লাইভ স্ট্রিমিং করছিল এবং কর্তৃপক্ষকে তাদের দায়িত্ব পালনে বাধা দিচ্ছিল। মূলধারার গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে, ১৩ ঘন্টা আটকে রাখার পর ২৫ এপ্রিল ভোরে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ।
টুইটার ব্যবহারকারী রূপস বাংলা কার্টুনিস্ট মেহেদীর একটি কার্টুন শেয়ার করেছেন:
সৈয়দা রত্না: খেলার মাঠে পুলিশের ভবন নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করায় মা ও ছেলে আটকের পর মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেল pic.twitter.com/QBPXZGIYxh
— Ruposh Bangla (@ruposhbangla) April 25, 2022
ডয়েশে ভেলে বাংলা জানিয়েছেঃ
পুলিশ মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী মা সৈয়দা রত্না ও তার কিশোর ছেলেকে বিনা ওয়ারেন্টে , বিনা মামলায় ১৩ ঘন্টা আটক রেখে প্রচলিত আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন করেছে। #Bangladesh https://t.co/Vre1uXlOYu
— DW বাংলা (@dw_bengali) April 25, 2022
রাজনৈতিক কর্মী রাফিদ আল বুখারি তালুকদার লিখেছেন:
বিশ্বের অধিকাংশ শহর যেখানে স্থাপনা অপসারণ করে উন্মুক্ত স্থানের পরিমাণ বাড়াচ্ছে, ঠিক তার বিপরীতে ঢাকাকে ক্রমেই কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত করা হচ্ছে। জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত।
বর্তমানে খেলার মাঠের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ঢাকার শিশুরা বেশিরভাগই চার দেয়ালের মধ্যে বেড়ে উঠছে। দৈনিক শিক্ষা অনলাইন পত্রিকার একটি উপসম্পাদকীয়তে তানজিনুল হক মোল্লা দেখিয়েছেন যে খেলার মাঠ হ্রাস এবং শহরে অপরাধ বৃদ্ধির মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
বর্তমানে খেলার মাঠ কমে যাওয়ার কারণে ছেলেমেয়েরা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। যার ফলে তাদের আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। ইচ্ছাকৃতভাবে স্কুল পালাচ্ছে। কিংবা সেখানকার নিয়মশৃংখলা ভঙ্গ করছে। এমনকি রাষ্ট্রিক আইন বা পৌর বিধিবহির্ভূত কাজ করছে। মাতা-পিতা বা অভিভাবকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ছেলেমেয়েরা পর্নোগ্রাফি বা মাদকে আসক্ত হচ্ছে দিন দিন।
সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম সিফাত লিখেছেন:
খেলার মাঠ যত কমবে, থানার প্রয়োজনীয়তা ততো বাড়বে। এবার ভাবতে হবে আমরা কোনটা বেশি চাই। থানা, নাকি খেলার মাঠ?
ঢাকার উধাও হওয়া খেলার মাঠ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক আদিল মোহাম্মদ খানের মতে, ঢাকা শহরের ৩০ শতাংশ ওয়ার্ডে খেলার মাঠ বা পার্ক হিসেবে কোনো খোলা জায়গা নেই, যা ওই এলাকার শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ২০১৯ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে ঢাকায় আগে কয়েক বছর আগেও মাঠের সংখ্যা ২৩০ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ১৪০টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ, যেগুলো ওই প্রতিষ্ঠানের কম্পাউন্ডের ভেতরে অবস্থিত। অর্ধশতাধিক জায়গা ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন, ওই খোলা জায়গায় শিশুরা মাঠ হিসেবে ব্যবহার করে খেলতো। পরে সেসব জায়গায় অট্টালিকা গড়ে ওঠে। তবে ৪০টির মতো মাঠ ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে আবার ১৬টি মাঠ দখল হয়ে গেছে। এখন ঢাকায় উন্মুক্ত সরকারি মাঠ আছে মাত্র ২৪টি। কিছু মাঠ সংস্কার করা হয়েছে এবং অল্প সময়ের জন্য খোলা থাকে। বাচ্চাদের আর খেলাধুলা করা হয় না।
অন্য একটি প্রতিবেদনে বিস্তারিত বলা হয়েছে যে কীভাবে শিক্ষাগত প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের কম্পাউন্ডের খোলা জায়গাগুলোতে নতুন কমিউনিটি সেন্টার, জিমনেসিয়াম, কর্মীদের থাকার জায়গা ইত্যাদি তৈরি করছে। ফলে খেলার জায়গা হারিয়ে যাচ্ছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) উল্লেখ করেছে যে ঢাকা শহরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১২,৫০০ লোকের জন্যে দুই থেকে তিনটি খেলার মাঠ থাকতে হবে – যার আয়তন হবে প্রায় ৩ একর। তবে, এই মানদণ্ড বজায় রাখা হয় না ঢাকা শহরে।
খেলার জায়গা না থাকায় শহরের শিশু-কিশোরদের মধ্যে মানসিক সমস্যাও বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল চৌধুরী। তিনি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন:
শহরে বেড়ে উঠা শিশুদের মানসিক ও শারীরিক সমস্যা আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ার একটা অন্যতম কারন তারা শারীরিক শক্তি নির্ভর কোনো খেলাধূলায় নাই বা তার সুযোগ নাই।
সমালোচনার মুখেও তেঁতুলতলায় থানা ভবন নির্মাণের কাজ অব্যাহত ছিল। তবে, গত ২৮শে এপ্রিল, প্রধানমন্ত্রী এই নির্মাণ কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেন এবং শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠটি রক্ষা পায়। এই খবরে বিক্ষোভকারীরা আনন্দিত হয়।
আদিল মোহাম্মদ খান দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন যে তেঁতুলতলা মাঠরক্ষার এই আন্দোলনের সাফল্য ঢাকা শহরের অন্যান্য খেলার জায়গাকে রক্ষা করার অনুপ্রেরণা হওয়া উচিত।