‘নির্মমতাকে ছাড়িয়ে গেছে': মিয়ানমারের অভ্যুত্থান ও সেনাবাহিনীর সহিংস গণতন্ত্র দমন

অভ্যুত্থানবিরোধী প্রতিবাদকারীরা একটি স্বাধীনতার দেওয়াল তৈরি করছে। অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

প্রথমে এই নিবন্ধটি গ্লোবাল ভয়েসেসের চিহ্নিত হতে অনিচ্ছুক একজন প্রদায়কের ব্লগে প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে এটি তিন-পর্বের একটি ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।

পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়ে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভগুলি প্রতিনিয়ত মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিশোধের মুখোমুখি হয়েছে। দমনাভিযান সত্ত্বেও সাহসী বিক্ষোভকারীরা এখনো শান্তিপূর্ণ উপায়ে অন্যায়, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নৃশংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে রাস্তায় নামছে।

নীচের সময়রেখাটিতে কিছু নিবর্তনমূলক আইন ও সামরিক বাহিনীর নৃশংস দমনাভিযানের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

হিংস্র দমনাভিযান বাড়ছে

৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সামরিক পর্ষদ দেশব্যাপী ৫ জনের বেশি জনসমাগম নিষিদ্ধ করার জন্যে সান্ধ্য আইন (১৪৪ ধারা) এবং সমাবেশ আইন জারি করেছিল

৯ ফেব্রুয়ারি সামরিক পর্ষদের নিয়ন্ত্রণাধীন টেলিযোগাযোগ ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় অনলাইন বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করতে ব্যবহার করা যেতে পারে এমন একটি নিবর্তনমূলক খসড়া সাইবার সুরক্ষা আইন প্রবর্তন করে। সুশীল সমাজের ১৬১টি সংগঠন এবং মিয়ানমার কম্পিউটার ফেডারেশন এই খসড়া আইনটির বিরোধিতা করে।

একই দিন রাজধানী নেপিদতে পুলিশ জ্যান্ত গোলাবারুদ ও জলকামান নিয়ে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালালে ১৯ বছর বয়সী এক নারী বিক্ষোভকারী ম্যা থ্যু থ্যু খাইনের মাথায় গুলি লাগে। এই প্রতিবাদ আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে ১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি হাসপাতালে মারা যান।

সাইবার নিরাপত্তা আইনটি পাস করা না হলেও ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে সামরিক পর্ষদ নাগরিকদের গোপনীয়তা সুরক্ষার বিভিন্ন আইন সংশোধন করার ফলে পুলিশ এখন কোন সমন ছাড়াই গ্রেপ্তার করে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় আটক রাখার অনুমতি পেয়েছে। এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে  পূর্ববর্তী সামরিক জান্তার যুগের ওয়ার্ড বা গ্রামাঞ্চল প্রশাসন আইন পুনরায় চালু করেছে। এই আইনের কারণে জনগণকে রাতে ঘোরাফেরা করার অনুমতি পেতে নিবন্ধন করতে হবে।

১১ ফেব্রুয়ারির কাছাকাছি সময় থেকে সান্ধ্য আইন চলাকালীন সময়ে গণ অবাধ্যতা আন্দোলনে অংশ নেওয়া লোকদের রাত্রিকালীন গ্রেপ্তার বেড়ে যায়। সম্প্রদায়ের সদস্যরা একত্রিত হয়ে পুলিশকে বাধা দিয়ে এরকম কয়েকটি প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিল।

এরপরে ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে সেনাবাহিনী সমন জারি করে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের সাতজন নেতা ও শিল্পীকে গ্রেপ্তার করে।

১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সেনাবাহিনী কাচিন রাজ্যের রাজধানী মিতকিনাতে বিদ্যুৎ অফিসের কাছে বিক্ষোভকারীদের আক্রমণ করে। কোন আঘাত না করেই কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করে।

১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে দমনাভিযানের সময় দাঙ্গা পুলিশ একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নির্মমভাবে আক্রমণ করেছিল

১৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানী নেপিদতে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ একটি সহিংস দমনাভিযান পরিচালনা করে প্রায় ৫০জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে। এখান থেকেই সারাদেশের শহরগুলিতে বিক্ষোভ চলাকালীন গণগ্রেপ্তারের সূচনা হয়।

২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে ধর্মঘটের সময় বিক্ষোভকারীরা মান্দালয়ের জেটিতে সামরিক বাহিনীকে জাহাজ চালানো থেকে বিরত করার চেষ্টা করার সময় পুলিশ ও সেনাবাহিনী সাধারণ নাগরিকদের উপর গুলি চালায়। ঘটনাস্থলেই দু'জন মারা যায় এবং বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী আহত হয়। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গ্যাদের উপর নৃশংসতার দায়ে অভিযুক্ত সেই কুখ্যাত ৩৩ হালকা পদাতিক ডিভিশন মান্দালয়ের হামলাটি পরিচালনা করে।

সেই সপ্তাহের শেষের দিকে একজন সৈনিকের আসল বন্দুক ও অস্ত্র প্রদর্শন এবং লোকজনকে মাথায় গুলি করার হুমকি দেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাগাভাগি করা হয়েছিল। এদিকে সৈনিকদের সহিংসতার উস্কানি এবং বিক্ষোভকারীদের হুমকি দেওয়ার বেশ কয়েকটি ক্লিপ টিকটকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।

২৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পুলিশের একটি বিশাল বাহিনী ইয়াঙ্গুনের টার্মউই জনপদে হামলা চালিয়ে ১৫ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার ছিল মিয়ানমারের বৃহত্তম শহরটিতে শক্তি প্রয়োগ ও গ্রেপ্তারের প্রথম ঘটনা।

২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে ইয়াঙ্গুনে সামরিক বাহিনীর শব্দ বোমা, টিয়ার গ্যাস ও তাজা গোলাবারুদের ব্যবহার বড় ধরনের বিক্ষোভের কেন্দ্রগুলি ছত্রভঙ্গ করার মাধ্যমে এই শহরটিতে সহিংস দমনাভিযান বাড়তে শুরু করে। একই দিনে অন্যান্য বড় বড় শহর যেমন মান্দালয় এবং নেপিদতেও একই রকম দমনাভিযান ঘটে। ২৭ এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি ইয়াঙ্গুনে সামরিক তৎপরতা সামরিক তৎপরতা অব্যাহত থাকে এবং বেশ কয়েকজন প্রতিবাদকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়

২৭ ফেব্রুয়ারি মধ্য মিয়ানমারের মনোওয়া শহরে সেনাবাহিনী বর্বরতার সাথে বিক্ষোভ দমন করে। মারাত্মক আহত হন দু'জন।

বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঘটে নৃশংসতম দমনাভিযান: দেশব্যাপী দুধ চা জোট সম্পর্কিত বিক্ষোভ চলাকালীন সাতটি শহর– ইয়াঙ্গুন, মায়িক, দাওয়েই, মান্দালয়, মাওলামাইন, ব্যাগো এবং পাক্কোকুতে নিহত হয়েছে ১৮ জন। এটা ছিল পুরো ফেব্রুয়ারির সবচেয়ে সহিংস দিন

রাজনৈতিক বন্দীদের সহায়তা সংস্থার তথ্য অনুসারে  ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১,৩০০ জনকে গ্রেপ্তার, অভিযুক্ত করা বা সাজা দেওয়া হয়েছে এবং ৯৮৮ জন এখনো আটক অবস্থায় আছে অথবা তাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা বহাল রয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃত এবং সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুরা হলেন সাংবাদিক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক

৩ মার্চ তারিখে এর চেয়েও বড় নৃশংসতা ঘটে মনিওয়ামান্দালয়, মিয়াঞ্চান, মাওলামাইন, কালে এবং ইয়াঙ্গুন শহরে যেখানে ৩৮জন মারা যায়

ইয়াঙ্গুনের উত্তর ওক্কালা [সতর্কতা: গ্রাফিক চিত্র) শরতলীতে সামরিক বাহিনীর সাবমেশিন গান ব্যবহারের অভিযোগ পাওয়া যায়; এর ফলে কমপক্ষে ২০ জন মারা যায়। সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার ফুটেজের উদাহরণ হিসেবে ইয়াঙ্গুনে গ্রেপ্তারকালে একজন প্রতিবাদকারীকে মাথায় গুলি করার একটি ভিডিও [সতর্কতা: গ্রাফিক চিত্র) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভাগাভাগি হয়।

চিকিৎসা স্বেচ্ছাসেবীদের লক্ষ্যবস্তু করে আক্রমণসহ সামরিক বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ডগুলি ফেসবুক ও টুইটারে ছড়িয়ে পড়েছে।

এটা নির্মমতাকেও ছাড়িয়ে গেছে।

৩ মার্চ পর্যন্ত বিক্ষোভ চলাকালীন নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ জনে দাঁড়িয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগকেই সামরিক কাউন্সিল মোতায়েনকৃত সৈন্যরা মাথায় গুলি করেছে।

১ মার্চ তারিখে উৎখাত হওয়া জান্তাবিরোধী গণতন্ত্রের জাতীয় লীগ গঠিত পিদাউংসু হ্লুত্তাও প্রতিনিধিত্বকারী কমিটি (সিআরপিএইচ) শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী ও বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার কারণে অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর নেতৃত্বাধীন রাজ্য প্রশাসনিক পর্ষদকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে।

সুরক্ষার জন্যে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান

মিয়ানমারের নাগরিকরা ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেশটির সেনাবাহিনী তাত্মাডো সংঘটিত অভ্যুত্থান প্রতিরোধে জাতিসংঘের সমর্থনের আহ্বান জানাতে শুরু করেছে। সারাদেশে হওয়া বিক্ষোভগুলিতে জাতিসংঘ বা এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আহ্বান জানানো বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা যাচ্ছে।

১২ ফেব্রুয়ারি তারিখে জেনেভাতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের মানবাধিকার  পর্ষদের প্রথম সভায় জেনেভাস্থ জাতিসংঘে মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধি মাইন্ত থু সামরিক পর্ষদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

২৬ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের জাতিসংঘের দ্বিতীয় সাধারণ অধিবেশন চলাকালে জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কিইয়াও মো তুন একটি অবস্থান নিয়ে অবিলম্বে বেসামরিক সরকারের পক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পর্ষদের কাছে আবেদন জানিয়ে একটি আকস্মিক বক্তব্য রাখেন। ভাঙ্গা গলায় মিয়ানমারের জনগণকে প্রশংসা করে এবং ধন্যবাদ জানিয়ে বর্মি ভাষায় ভাষণ শেষ করে তিনি যেভাবে তিনটি আঙ্গুল তুলে ধরেন, তার সেই ভঙ্গিটি জান্তা প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরের দিন সামরিক পর্ষদ কিইয়াও মো তুনকে জাতীয় বিশ্বাসঘাতক  অভিহিত করে বরখাস্ত করলেও রাষ্ট্রদূতের তিন আঙুলের সালাম দেওয়ার চিত্রটি মানুষের কাছে আশাবাদের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে সামরিক বাহিনী সংঘটিত সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মিয়ানমারের নাগরিকদের অনেক প্রত্যাশা ছিল যে জাতিসংঘ হয়তো হস্তক্ষেপ করবে। সামাজিক গণযোগাযোগের মাধ্যম এবং বিক্ষোভের প্ল্যাকার্ডগুলিতে “বর্মি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘের কয়টি লাশের দরকার?” এর পাশাপাশি “জাতিসংঘের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে আপনার আরেকটা লাশের দরকার হলে আমাকে গুলি কর” এর মতো গভীর ব্যঙ্গাত্মক বিভিন্ন বার্তা ছিল।

◼ কয়টি লাশ হলে জাতিসংঘ বর্মি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে?

◼ বর্মি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘের কয়টি লাশের দরকার?

◼ এখানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার আগে আপনার কতটা বেসামরিক মৃত্যুর দরকার? #ফেব্রুয়ারি২৮অভ্যুত্থান

এই পোস্টে মন্তব্য বন্ধ করা হয়েছে।