আর্জেন্টিনায় বালিকাদের জোর করে গর্ভধারণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে

ছবির কৃতজ্ঞতা: উদীয়মান/ ফ্লিকার, ১১ মে, ২০১৮ এর বিক্ষোভের সময় নেওয়া। সিসি লাইসেন্স-এর আওতায়।

গ্লোবাল ভয়েসেসের বিশেষ কভারেজ লাতিন আমেরিকাতে নারীরা যেভাবে লিঙ্গ-সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়াই করে দেখুন।

অনুরোধে গর্ভপাতে বৈধতার একমাত্র এখতিয়ার রয়েছে লাতিন আমেরিকার কিউবা, উরুগুয়ে এবং মেক্সিকোর কয়েকটি রাজ্যে। আর্জেন্টিনায় গর্ভপাত বৈধ শুধু দুটি পরিস্থিতিতে: গর্ভাবস্থা মায়ের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুললে এবং ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণ করলে।

১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে সমর্থনকারীরা গর্ভপাতকে পুরোপুরি আইনী করে তোলার খসড়া আইন অনুমোদনের আহ্বান জানিয়ে রাজধানী বুয়েনস আয়ার্সের আর্জেন্টিনীয় জাতীয় কংগ্রেসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। বিক্ষোভকারীরা আর্জেন্টিনার আইন দিয়ে ইতোমধ্যে অনুমোদিত পরিস্থিতিতে গর্ভপাতের অধিকারও পূরণ করা উচিৎ বলে  দাবি করেছে।

বিক্ষোভকারীরা নানীর অপর স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার পরও চিকিৎসক, ধর্মীয় নেতা এবং আইনী কর্তৃপক্ষের গর্ভাবস্থা বহন করতে বাধ্য করা ১১ বছর বয়সী লুসিয়ার কাহিনীটির কথা স্মরণ করেছিল। আর্জেন্টিনাকে হতবাক করা মামলাটি দেশে  নিরাপদ গর্ভপাতের অধিকারের লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

আর্জেন্টিনায় (যৌন) সম্মতির বয়স ১৩ বছর হওয়ায় শাস্তি আইনে এই বয়সের নীচের নাবালিকাদের সাথে যে কোন যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ বলে গণ্য করা হয়। গর্ভপাত সমর্থক আন্দোলনকারীরা এই প্রতিবাদের প্রচারণার মূলমন্ত্র হিসেবে: “গর্ভবতী বালিকা মানেই ধর্ষিত বালিকা” যুক্তিটি তুলে ধরেছে।

লুসিয়ার সর্বনাশ

ভুক্তভোগীর সুরক্ষার জন্যে তৈরি করা ছদ্মনামের লুসিয়াকে তার মা উত্তর আর্জেন্টিনার টুকুমান প্রদেশের একটি গ্রাম্য ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার সময় সে পেট ব্যাথায় ভুগছিল। তারপর চিকিৎসকরা জানতে পারে যে সে ১৯ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা।

তারপর লুসিয়ার মা তাকে একটি প্রাদেশিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসকদের গর্ভপাত করার অনুরোধ করেন বলে আর্জেন্টিনীয় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন তার মা। কিন্তু চিকিৎসা কর্মীরা কথিত বিবেকের বাধা অর্থাৎ তাদের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে ক্ষুন্ন করে বলে লুসিয়ার গর্ভাবস্থা বন্ধ করতে অস্বীকার করেছিল।

মা বলেছিলেন যে গর্ভপাত লুসিয়ার জীবনকে বিপদে ফেলবে বলে যুক্তি দিয়ে চিকিৎসকরা বালিকাটিকে গর্ভাবস্থা বজায় রাখার চাপ দিয়েছিল। তিনি আরো বলেন তাদের চলে যাওয়ার সময় হাসপাতালের আশপাশে জড়ো হওয়া একদল লোক তাদের দিকে “হত্যাকারী” বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল।

লুসিয়ার গল্পটি দ্রুত সারা প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে। “গর্ভপাতকে বাধাগ্রস্থ করতে” বালিকাটির শহরের ধর্মান্ধরা সংগঠিত হয়েছিল। প্রদেশটির প্রধান বিশপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি শাব্দিক বার্তায় “সমস্ত মানুষের জীবন রক্ষা করার জন্যে” রেকর্ডিংয়ে লুসিয়ার প্রকৃত নাম পর্যন্ত প্রকাশ করে তার গির্জার সদস্যদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এদিকে প্রাণপন্থী (গর্ভপাতবিরোধী) দলগুলি ধর্ষণের পর বেঁচে যাওয়া বালিকাটিকে “[জন্ম না নেওয়া] সন্তানের মঙ্গলের জন্যে” গর্ভাবস্থা অব্যহত রাখার দাবি করে প্রদেশটির রাজধানী সান মিগুয়াল দে টুকুমানে মিছিল করে।

একটি আঞ্চলিক আদালত এই হাসপাতালে গর্ভপাত করানোর নির্দেশ দেওয়ার আগেই লুসিয়া ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে একটি অস্ত্রোপচার করার দশ দিন পর শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতায় ভ্রূণটির মৃত্যু হয়। মৃত্যুটি কাকতালীয়ভাবে ৮ মার্চ তারিখের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সাথে মিলে গিয়েছিল।

আর্জেন্টিনার ধর্মীয় ও মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলি সমর্থিত খ্রিস্টীয় গণতান্ত্রিক দল নরহত্যা দায়ে অভিযুক্ত করার জন্যে অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে একটি পুলিশী অভিযোগ দায়ের করে

দুই সপ্তাহ পরে একজন টুকুমান পারিবারিক বিচারক বালিকাটির “প্রসূতি হওয়ার কোন ইচ্ছে বা সম্মতি ছিল না” তাই মৃত ভ্রূণটি লুসিয়ার কন্যা হিসাবে নিবন্ধিত হবে না বলে রায় প্রদান করেন

“হেসে খেলে বেঁচে থাকো: ন্যায্য বিশ্বে বালিকারা মা হয় না।” বিতরণ নেটওয়ার্ক-এর ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

আর্জেন্টিনা এবং বিশ্বজুড়ে গর্ভবতী বালিকারা

শিশু, কিশোর ও পরিবার বিষয়ক জাতীয় সচিব গ্যাব্রিয়েল ক্যাসেলির মতে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আর্জেন্টিনায় অল্পবয়সী বালিকাদের গর্ভাবস্থার হার ২০ শতাংশ কমেছে। তবুও ২০১৮ সালে ৮৭,১৮৮ জন কিশোরী গর্ভবতী হয়েছিল। সমাজবিজ্ঞানী সিলভিনা র‍্যামোসের মতে ১৫ বছরের কম বয়সের মেয়েদের গর্ভধারণ পরিবারের ভেতরের যৌন নির্যাতনের ফলেই ঘটে থাকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লুএইচও) অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী বালিকাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো গর্ভকালীন বা অনিরাপদ গর্ভপাতের প্রচেষ্টা পরবর্তী জটিলতার পাশাপাশি প্রসবের সময় প্রতিবন্ধকতা।

লাতিন আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলে ৩০ শতাংশ গর্ভবতী নারীদের বয়স ১৮ বছরের নীচেনিনাস নো মাদ্রেস (“বালিকারা [আর] মা  নয়”) প্রচারণা অনুসারে, লাতিন আমেরিকা বিশ্বের একমাত্র অঞ্চল যেখানে অল্পবয়সী বালিকাদের গর্ভাবস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এই প্রচারণা অভিযানটি বালিকাদের আইনী গর্ভপাত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভাবস্থা রোধের প্রয়োজনীয় উপায় অবলম্বনে বাধা দেওয়ার নির্দিষ্ট কতগুলি ঘটনা ভাগাভাগি করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সামনে বেশ কয়েকটি লাতিন আমেরিকার দেশকে নিন্দা জানিয়েছে।

অন্যান্য লুসিয়াদের সাহায্য করার প্রোটোকল?

লুসিয়ার ঘটনাটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম  এবং অধিকার বিষয়ক এনজিওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

২০১৯ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাই কমিশনার (ওএইচসিএইচআর) এর কার্যালয় ধর্ষণের শিকাররা যাতে নিরাপদ গর্ভপাতের সুযোগ পায় আর্জেন্টিনাকে সেই নিশ্চয়তা প্রদানের অনুরোধ করেছিল।

“আমার মা বলেছে যে তুমি হয়তো ভাবছো সবুজ রুমাল পরার মতো আমার খুব কম বয়স [প্রো-গর্ভপাতের প্রতীক] নয়, তুমি আমাকে জোর করে জন্মদানে বাধ্য করা কেউ হিসেবে ভেবে নিতে পারো। #এটা_আইন_কর #আইনী_গর্ভপাত_এখনি #নিরাপদ_গর্ভপাত #বিনামূল্যে_গর্ভপাত।“ @lলিলিডিবুজা থেকে নেওয়া ছবি, অনুমতি নিয়ে ব্যবহৃত।

কয়েক মাস পরে ছয়টি মানবাধিকার সংগঠন “যৌন সহিংসতার শিকার, বিশেষ করে অল্পবয়সী বালিকাদের, আইনি গর্ভপাতের সুযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মানবাধিকার আইনের বাধ্যবাধকতা পালন করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্যে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে আন্তঃ-আমেরিকা মানবাধিকার কমিশনে (আইএএইচআর) সাক্ষ্য প্রদান করেছিল

২০১২ সালে আর্জেন্টিনার সর্বোচ্চ আদালত ধর্ষণের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের অধিকারকে অনুমোদন দিয়েছিল। এবং ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সম্প্রতি নির্বাচিত আলবার্তো ফার্নান্দেজ প্রশাসনের স্বাস্থ্য মন্ত্রনাণালয় আইনী পরিস্থিতিতে রোগীদের গর্ভপাতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হাসপাতালের জন্যে একটি প্রোটোকল তৈরি করেছে।

তবে বর্তমানে আর্জেন্টিনার ২৩টির মধ্যে মাত্র ১০টি প্রদেশের মেনে চলার মতো পর্যাপ্ত প্রোটোকল বা জাতীয় মান রয়েছে।

আর্জেন্টিনার বাস্তবতা পরীক্ষণ সংস্থা চেকেয়াদোর মতে ” এটি আর্জেন্টিনীয় আইন দ্বারা সমুন্নত অধিকার হওয়ার কারণে প্রোটোকল না থাকার মানে এই নয় যে এই প্রদেশগুলিতে আইনী গর্ভপাত করা সম্ভব নয়। তবে আদালতের রায় মেনে চলার পর্যাপ্ত প্রোটোকলের অভাব এই অধিকারে মহিলাদের প্রকৃত প্রবেশাধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে।”

লুসিয়ার ঘটনাটি আইনটি একাই তার মতো শিশুদের সুরক্ষার জন্যে যে যথেষ্ট নয় তার জীবন্ত প্রমাণ।

প্রায় এক বছর পরে ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি লুসিয়ার ধর্ষককে ১৮ বছরের কারাদন্ডে দণ্ডিত করা হয়। পরিবারের পাওয়া সমর্থনের জন্যে মা একটি হৃদয়গ্রাহী চিঠিতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এই ইচ্ছে করেন যেন অন্য কোন মেয়েদের তাদের মতো একই বাধা অতিক্রম করতে না হয়।

১৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে সমাবেশের সময় চিলির লাস টেসিস মণ্ডলী তাদের সুপরিচিত সূচনা-সঙ্গীত  “আপনার পথে এক ধর্ষক” এর কথাগুলো গ্রহণ করেছে:

Duerme tranquila mi niña madre,
Sin que te importe quién te violó,
Que por tu hijo, bebé inocente,
Vela la Santa Inquisición.

আমার ছোট্ট বালিকা মা শান্তভাবে ঘুমাও,
তোমাকে যেই ধর্ষণ করে থাকুক,
তোমার শিশু, নিষ্পাপ শিশু,
তার সুরক্ষা দেবে পবিত্র বিচারকেরা।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .