
গ্লোবাল ভয়েসেস সম্পাদিত ছবি: আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হাভিয়ের মিলে। সূত্র: ইউটিউব/এল ট্রেস পর্দাছবি।
আর্জেন্টিনার সমাজে বিখ্যাত বিভাজনের জন্যে দায়ী দুটি প্রধান জাতীয় শক্তি হুন্তোস পোর এল কাম্বিও (পরিবর্তনের জন্যে একসাথে) এবং বর্তমান সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী উনিওন পোর লা পাত্রিয়া (পিতৃভূমির জন্যে ইউনিয়ন), লিবেরতাদ আভাঞ্জার (স্বাধীনতা অগ্রগতি) নেতা হাভিয়ের মিলের ব্যাপক বিজয়ে হতবাক।
আর্জেন্টিনায় ২২ অক্টোবরের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৩ আগস্ট রাষ্ট্রপতি পদের প্রাক-প্রার্থী বাছাইয়ের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনগুলি অবস্থান বরাদ্দ না করলেও দলের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে বিজয়ীদের নির্ধারণ করে। সেই মুহূর্ত পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল উনিওন পোর লা পাত্রিয়া (মধ্য-বাম আন্দোলন কার্চনারবাদ থেকে জন্ম নেওয়া পেরনবাদের একটি রূপ) এবং হুন্তোস পোর এল কাম্বিও (২০০৩ সালে উদ্ভূত ম্যাক্রিবাদ থেকে জন্ম একটি মধ্য-ডান আন্দোলন)।
নিজেকে নৈরাজ্যিক-পুঁজিবাদী সংজ্ঞায়িত করা অর্থনীতিবিদ মিলের এই অপ্রত্যাশিত বিজয় আর্জেন্টিনার রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দিয়েছে। বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ১০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার সময় রাজনীতিবিদদের প্রতি সমাজের বিতৃষ্ণা এই বিভাজন কাটিয়ে উঠেছে।
কোনো হিসেবই আগের প্রাদেশিক নির্বাচনে কোনো চিহ্ন তৈরি করতে না পারা সম্পূর্ণ নতুন প্রার্থীর ৩০.০৪ শতাংশ ভোটে প্রাপ্তির পূর্বাভাস দিতে পারেনি। তার ভোটারদের বেশির ভাগই ৩০ থেকে ৫০ এর মধ্যেকার তরুণ প্রজন্ম। মিলে কঠোর রাজনীতির পক্ষে এবং “ক্ষমতার বিশেষ সুবিধা” বাদ দেওয়ার পক্ষে একটি অত্যন্ত গভীর পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছেন। সেই রাতের অন্ধকার থেকে একটি কালো রাজহাঁস বেরিয়ে এসেছে।
গত ১২ মাসে আর্জেন্টিনার পুঞ্জীভূত মূল্যস্ফীতি ১১৫.৬ শতাংশ। যখন ভঙ্গুর অর্থনীতিতে অবসরপ্রাপ্তরা মাসের প্রথম দিনগুলি পার করতে পারছে না, স্কুলগুলির মতো হাসপাতালগুলিও বাজেভাবে চলছে; রাস্তাগুলি সহিংসতার জগাখিচুড়ি (মাদক ব্যবসায়ীদের বুলেটের কারণে গরিব পাড়ার বাসিন্দাদের বিকেল ৪টা থেকে নিজেদেরকে আটকে রাখতে হয়); নাগরিকরা যা পায় তা (সাইকেল, জুতো, মোটরসাইকেল, ব্যাকপ্যাক ইত্যাদি) চুরি করা সশস্ত্র কিশোরদের হাতে মারা যাচ্ছে, দেশের রাজধানীর অদূরেই জনগণের পানীয় জলের মতো মৌলিক জিনিসের অভাব, তখন প্রার্থী মধ্য, বাম বা ডান পন্থী কিনা তা বিবেচ্য নয়।
মিলে শুধু জয়ী হতে যাচ্ছেন কারণ তিনি তার অভিহিত “রাজনৈতিক শ্রেণিটি“র যাদের জনগণের জরুরি চাহিদা থেকে অনেক দূরবর্তী নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বলেছেন বলে অনেকেই মনে করে।
নির্বাচনের মাত্র দুই বছর আগে দল গঠন করা এই একেবারে নতুন প্রার্থী অদ্ভুত ও উন্মত্ত বাগাড়ম্বরপূর্ণ শাসন কাঠামো ছাড়াই ফুটন্ত সামাজিক পরিস্থিতির দর্পন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রতিনিধিত্বকারী অরক্ষিত নাগরিকদের দুর্দশার মুখে বেশিরভাগ রাজনীতিবিদদের জনগণের অর্থের দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবস্থাপনা এবং অশ্লীল ব্যয়ের কারণে অনেকেই বিরক্ত। এই ধরনের একটি পরিস্থিতিতে সকল প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ার উপক্রম।
মুশকিল হলো এই ‘বিরক্তি'র মধ্যে যেকেউ চলে আসতে পারে, আর সেটাই হয়েছে
মিলের মনে কী আছে তা বোঝা সহজ নয়। তিনি গর্ভপাতের বিরোধিতা ও অস্ত্র বহনের স্বাধীনতার প্রচার করেন; তিনি চান লিঙ্গ স্বাধীনতা ও মাদক বৈধকরণ; তিনি নিজেকে রাষ্ট্রের শত্রু সংজ্ঞায়িত করলেও তিনি মনে করেন ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা রাষ্ট্রের দায়িত্বে থাকা উচিত; ক্যাথলিক চার্চের সাথে তার কঠিন সম্পর্ক থাকলেও সর্বোপরি পোপকে তিনি “কমিউনিজম প্রচারকারী যিশুবাদী” হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
এই প্রার্থী শুধু বন্ধু বা শত্রু এই দুটি বিভাজন বিবেচনা করেন; তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে “আগুন লাগাতে” চান; তার সমালোচনা করার জন্যে সাংবাদিকদের সাথে তার ভীষণ দ্বন্দ্ব রয়েছে; তিনি অর্থনীতির ডলারকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; তার হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন হয়, চিৎকার করেন, রেগে যান এবং তারপর হঠাৎ শান্ত হয়ে যান।
সংক্ষেপে এটি একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতি হলেও তার চেয়ে বিপজ্জনক হলো এই নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক ডানপন্থী রাজনীতিবিদদের পাঠ। তারা ঘটনাটিকে একটি পক্ষপাতমূলক মোড়ের মতো ভাবছে। তা একেবারেই নয়, এটা হতাশার কান্না!
আর্জেন্টিনায় এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। নাগরিক ও তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে ২০০১ সালে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তখন প্রবাদ: “!কে সে ভাইয়ান তোদোস!” (সবাই চলে যাচ্ছে) তৈরি হয়।
“ক্যাসেরোলাদ্দো” নামে পরিচিত সেই বছরের ডিসেম্বরের সঙ্কটটি ছিল একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক গোলযোগ। রাষ্ট্রপতি ফের্নান্দো দে লা রুয়ার পদত্যাগের দাবিতে জনপ্রিয় বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটে। এতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়; কয়েক দিনের মধ্যে পাঁচজন রাষ্ট্রপতি নির্বাহী ক্ষমতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর শেষ পর্যন্ত জাতীয় সিনেটর এদুয়ার্দো দুহালদে চার বছরের সাংবিধানিক ক্ষমতা শেষ করেন। এটি “কোররালিতো” (খেলাঘর) নামে পরিচিত ব্যাঙ্কের আমানত উত্তোলন নিষেধাজ্ঞার কারণে শুরু হয়।
সেসময় স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে আবির্ভূত দুটি শক্তি: কার্চেনারবাদ (জনপ্রিয়তাবাদী, মধ্য-বাম) এবং ম্যাক্রিবাদ (ব্যবহারবাদী এবং রক্ষণশীল মধ্য-ডান) ২০ বছরেরও বেশি স্থায়ী দেশকে বিভক্ত করে রাখা এখনো সমাধান না হওয়া বিখ্যাত বিভাজনের জন্ম দেয়। জনগণ তাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করায় এই সর্বশেষ নির্বাচনে উভয় শক্তিই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভোট হারিয়েছে।
আজ থেকে রাজনৈতিক দাবাখেলায় পুনর্গঠনের কঠিন ও তীব্র দুটি মাস হবে। ১৩ আগস্টের নির্বাচনকে চিহ্নিত করা অর্থনৈতিক বিপর্যয় পরের দিন আর্জেন্টিনার পেসোর অবমূল্যায়নের মাধ্যমে আরো খারাপ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আর্জেন্টিনাবাসীরা প্রকৃত নির্বাচন পর্যন্ত অনেক কিছু পরিবর্তনের দুই মাস অতিক্রম করবে।
তা সত্ত্বেও ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত বারবার ভয়াবহ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট ও একনায়কতন্ত্রের মধ্য দিয়ে যাওয়ায় নির্বাচনকে স্বাগত জানাই। সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আমরা দীর্ঘদিন কাটিয়েছি। এই দিনটিতে জনগণ মানুষ নিজেকে প্রকাশ ও ইতিহাস পরিবর্তন করতে পারে। তাই আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এটি চর্চা করবো।