পাকিস্তানে নারীরা যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে সম্মুখীন হন এক কঠিন যুদ্ধের

Image by Nick Youngson CC BY-SA 3.0 Alpha Stock Images

ছবিটি তুলেছেন নিত ইয়াঙ্গসন – আলফা স্টক ইমেজ থেকে। ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স এর আওতায় প্রকাশিত।

পাকিস্তানের আইনে লিখিতভাবে যৌন হয়রানিকে অপরাধকে আওতায় এনে দেশটি নারী অধিকার রক্ষায় এক ধাপ এগিয়েছে ধরা হয়। তবে, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বাস্তবতা পুরোপুরিই ভিন্ন। যদি কোনো নারী আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাকে মুখোমুখি হতে হবে টানা আইনি জটিল প্রক্রিয়া, সমাজের কলঙ্ক মাথায় আসবে আর সবার অস্বাভাবিক ব্যবহারের মুখোমুখি হতে হবে।

এত প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বে সম্প্রতি অশ্লীল ব্যবহার সংশ্লিষ্ট কিছু অভিযোগের অগ্রগতি হয় অবশ্য গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে; কারণ সেগুলোর ভিডিও প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করা হলে পুলিশের পক্ষে অপরাধীদের ধরা সহজ হয়।

গত আগষ্ট মাসে লাহোরের তাসিনা পারওয়াজ একটি ভিডিও রেকর্ড করে পোস্ট করেন টুইটারে। সেখানে দেখা যায় এক লোক রাস্তার পাশে মোটরবাইকে বসে আছেন এবং হস্তমৈথুন করছেন। এই ভিডিওতে পাঞ্জাব পুলিশদের ট্যাগ করা হয় এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেন পুলিশ সুপার আহসান সাইফুল্লাহঃ

@তাসিনাপারওয়াজ আমরা আসামীকে গ্রেফতার করতে পেরেছি। তিনি মি. তায়েব আহমেদ, আর/ও ওয়েস্টউন্ড কলোনি, রাইওয়ান্ড লাহোর. – এসপি আহসান সাইফুল্লাহ (পিএসপি) @আহসান_সাইফুল্লাহ

কয়েক সপ্তাহ আগে একই রকম আরেক মামলার রিপোর্ট করা হয় টুইটারে – অভিযুক্তের ছবিসহঃ

#মিটু
এলাকা: ইতিহাদ টাউন, রাইওয়ান্ড রোড, লাহোর
সময়: বিকেল ৫টা
বাইক # এলইপি ৯৯৯২
(ছবি) @মাহওয়াশাহাজ @এনএললাহোরি @তাজিন @সানজাফ #মিটু
আমি যে ঘটনাটা পোস্ট করেছি এটা প্রতিটা মেয়ের গল্প, যারা বাইরে বের হতে চায়; যে কোনো কারণেই হোক।

- কে@আলিতাস্কাইওয়াকার

@আলিতাস্কাইওয়াকার-এর উত্তরে

আমি একজন শিক্ষার্থী। অন্য আরো মেয়েদের সাথে আমাকে মোটরসাইকেল রিকশায় বের হতে হয়। আজকে বাসায় যাওয়ার পথে, একটা ছেলে বাইকে আমাদের ধাওয়া করে। রিকশায় আমরা সবাই মেয়ে ছিলাম। সে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো, তখন আমরা খুবই আতঙ্কিত বোধ করি।

সে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে আর তার যৌনাঙ্গ দেখাতে থাকে। সবাই আমরা ভয়ে কাঁপছিলাম। যাই হোক, আমি মাথা নিচু করে ছিলাম না, মোবাইল হাতে নিয়ে ছেলেটা, তার যৌনাঙ্গ আর গাড়ির নম্বর প্লেটের ছবি তুললাম।
@বাজিপ্লিজ @আইহালালফেমিনিস্ট

এই লোকটিকেও পুলিশ সুপার আহসান সাইফুল্লাহ গ্রেফতার করেন।

আমরা অভিযুক্ত আসামীকে গ্রেফতার করেছি এবং তার মোটরসাইকেল জব্দ করি। এখন আমি @আলিতাস্কাইওয়াকার-কে অনুরোধ করছি আমার সাথে শীঘ্র যোগাযোগ করুন এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এজাহার নিবন্ধনের জন্য প্রাসঙ্গিক তথ্য দিন।

সিসিটিভিতে ধরা পড়া আরেকটি ঘটনায় দেখা গেছে, ডেরা গাজি খান এলাকার রাস্তায় এক লোক একজন নারীর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাতড়াছেন। পুলিশ সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও গ্রেফতার করেন।

ডিজি খান পুলিশরা দুর্দান্ত কাজ করেছেন এই বিকৃত মানসিকতার মুনির আহমেদ খারালকে চিহ্নিত ও গ্রেফতার করে। একজন দুশ্চিরিত্র লোক তিনি। – @দানিয়েলজিলানি

ভুক্তভোগীকে পড়তে হয় সামাজিক চাপ ও জনসাধারণের রোষানলে ।

পাকিস্তানের মানুষের কাছে এই ধরনের আচরণ স্বাভাবিক গোছের। সেখানকার মানুষ এখন আর ভীত নয় রিপোর্ট করতে যদিও আইনি প্রক্রিয়ায় রয়েছে জটিলতা এবং সময়ও লাগে বেশি। তাসিনা পারওয়াজ টুইটারে সমর্থন পেলেও ভিডিওটি রেকর্ড করার জন্য তার অ্যাকাউন্ট ডিলিট করতে (মুছে ফেলতে) বাধ্য হন অনবরত বিদ্বেষমূলক কমেন্ট পাবার পর।

অনেকেই আবার লিখেছেন “আমার শরীর আমার অধিকার”, এই স্লোগানটি নারী দিবসে ২০১৮ সালের মার্চে দেখা যায়। অপরাধীদের পক্ষে সাফাই গাওয়া এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে নারীদের হয়রানির মাত্রাটাও বোঝা যায়।

যদি একজন পুরুষ শিক্ষিত এবং অকালকুষমাণ্ড না হোন এই ভিডিওর মতো, তাহলে সে এই প্ররোচণায় মোটেও কান দিবে না। আপনাদের মতো ফালতুরাই নিজের কৃপণতা জাহির করার জন্য এগুলো করেন। – আলিশবা@ফিনহারিস৯

প্রত্যুত্তরে @মুহাম্মদ হারিস কোরেশী

এটা ”আমার শরীর, আমার খুশি” প্রসঙ্গে একজন পুরুষ সেখানে হস্তমৈথুন করলে একটা মেয়ের কেন সেটা দেখতে হবে? সে পুরো দৃশ্য দেখেইনি শুধু, এটা রেকর্ডও করেছে। সে এসব দেখে মজা পেয়েছে নয় কি? নির্লজ্জ মেয়েরাই ছেলেদের যৌন বিষয়ক পরামর্শ দেয় এবং উস্কায় এসব করার জন্য।

আইন থাকলেও, এই ধরণের যৌন হয়রানি মহামারি আকার ধারণ করেছে

আইনানুযায়ী, পাকিস্কান দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুসারে “নারীর শালীনতাকে তিরস্কার করা হলে অথবা তাদেরকে যৌন হয়রানি করলে, তা দণ্ডনীয়। এই অপরাধে অভিযুক্ত হলে উক্ত ব্যক্তি তিন বছর কারাভোগ করবে অথবা পাঁচ লাখ রূপি জরিমানা করা হবে অথবা উভয়ই।

গ্লোবাল ভয়েসের সাথে সাক্ষাৎকারে পারওয়াজের মামলার প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার আহসান সাইফুল্লাহ বলেছেনঃ

This is the first time arrests have been made (in such a case) but that does not mean such incidents have not been happening, unfortunately, street harassment and sexual harassment is part of our society. The only difference is, (this time) it was recorded and reported.

এই ধরনের অভিযোগে প্রথমবার কেউ গ্রেফতার হলো। কিন্তু এর মানে এই নয় যে এই ধরনের ঘটনা তেমন ঘটছে না। দুঃখজনক হলেও, রাস্তায় সংঘঠিত হয়রানি আর যৌন হয়রানি আমাদের সমাজের অংশ হয়ে গিয়েছে। শুধু পার্থক্য হলো, এখন এগুলো রেকর্ড ও রিপোর্ট করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, “মি টু’ ক্যাম্পেইন দারুণ সচেতনতা সৃষ্টি করেছে নারীদের মাঝে। আগে নারীরা হয়রানি বা যৌন অত্যাচারের বিষয়গুলোকে চুপচাপ থাকতো। কিন্তু এখন সময় বদলিয়েছে; এখন সহজেই মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে সবকিছু ধারণ করা সম্ভব।”

পারওয়াজ টুইটারে প্রকাশ্যে এমন অশ্লীল ব্যবহারের বিষয়টি সবার সামনে তুলে ধরার পর আরো অনেক নারী এই রকম গল্প শেয়ার করছে যেখানে দেখা যায় যৌন হয়রানি কিভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যাহত করছেঃ

লাহোরের রাস্তা এবং পার্ক সেভেন ফেজ ৫ এর দিকে আমি প্রাত্যহিক দৌড়ানো প্রায় বন্ধ করে দিয়েছি। ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি এসব দেখতে দেখতে। – @ফারখুনদাখান

আমার সাথে ঠিক এমনটা হয়েছে…যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম। – কানওয়াল

প্রত্যুত্তরে @তাসিনা৪২৬৯ – অনুগ্রহ করে লাহোরের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এরকম বিষয়ে ট্যাগ করুন।

লাহোরের একজন শিক্ষক সানা গ্লোবাল ভয়েসের সাথে কথা বলে নিজের অভিজ্ঞতা জানান:

A rickshaw driver used to stand at the bus stop where she took her bus and would take out his private part as she went by. This kept happening for weeks and when I complained to my family I was asked to quit the job, as this is the norm in most families.

একজন রিকশাচালক বাসস্টপের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো যেখান থেকে আমি বাসে উঠতাম। আমি পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে সে তার যৌনাঙ্গ বের করে দেখাতো। এই ঘটনা কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলতে থাকলো। যখন পরিবারকে বিষয়টা জানালাম, তারা আমাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলেন। এই ধরনের ঘটনা পাকিস্তানে সচরাচরই দেখা যায়।

ডিজিটাল রাইটস ফাউন্ডেশনের মনোবিজ্ঞানী ও প্রোগাম ম্যানেজার জান্নাত ফজল গ্লোবাল ভয়েসকে জানান:

These incidents have a lasting effect on victims, as their personal space is violated, they feel vulnerable and helpless, and they usually find no support or redressal against these perverse acts because of how our system is rigged against the victims.

Exhibitionism is a type of mental health disorder where a person feels the urge to expose their genitals to nonconsenting adults, but we cannot attribute this behavior to this mental health condition altogether, many times people indulge in such acts because they derive pleasure from making others uncomfortable and also because of the lack of adequate reporting mechanisms to curb it. Even if anyone is suffering from this condition this act still needs to be reported and individuals need to be taught ways to better cope with their sexual urges instead.

ভূক্তভোগীর ওপর এই ঘটনাগুলোর দীর্ঘমেয়াদ প্রভাব ফেলে। এগুলো তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় আঘাত হানে, তারা দুর্বল ও অসহায় বোধ করে। প্রায়সময়ই তারা কোনো সহযোগিতা পান না কিংবা এ ধরনের বিকৃত আচরণগুলো থেকে প্রতিকারের আশা করেন না; পুরো কাঠামোটাই ভুক্তভোগীর বিপক্ষে কাজ করে।

অশ্লীলভাবে নিজের দেহকে অনাবৃত করা হলো এক ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি; যে অবস্থায় একজন ব্যক্তি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে যৌনাঙ্গ দেখানোর চেষ্টা করে আরেকজনকে। তবে এই ধরনের আচরণ পুরোপুরি তার মানসিক স্বাস্থ্যকে দায়ী করতে পারে না, অনেক সময় উক্ত ব্যক্তি এই রকম আচরণ করে, কারণ সে অন্য মানুষদের বিব্রত করে আনন্দ পায়; এছাড়া এগুলো রোধ করার জন্য পর্যাপ্ত প্রতিবেদন করারও কোনো ব্যবস্থা নেই তেমন। এমনকি যারা এই ধরনের আচরণে ভুগছে, এখনো সময় আছে রির্পোট করার এবং উক্ত ব্যক্তিদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া উচিত; যাতে তারা নিজেদের যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

পাকিস্তানের নারীরা এখনো এসব হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার নয় এবং রিপোর্ট করতেও পিছপা হয়; এর ফলে এই ধরনের মামলাগুলো অন্য আরেক ধরনের আলোড়ন সৃষ্টি করছে।

1 টি মন্তব্য

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .