বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ‘জাহাজ বাড়ি’ হিসেবে খ্যাত একটি শতবর্ষী ভবন গত ৫ই জুন ঈদের রাতের আধাঁরে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
পুরোনো ঢাকার চক সার্কুলার রোডে অবস্থিত জাহাজের মতো দেখতে এই ভবনটি স্থাপত্যশৈলী ও কারুকার্যের জন্যে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এটিকে ঢাকার প্রথম বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে বিবেচনা করা হয় । আনুমানিক ১৮৭০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিল্ডিং ধ্বংস করার ঘটনা ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণে অবহেলার ব্যপারটি উন্মোচন করে দিয়েছে।
বিভিন্ন পত্রিকার ভাষ্যমতে আওয়ামী লিগের কর্মীরা তিনটি বুলডোজার নিয়ে এসে ভবনটি ভাঙ্গা শুরু করেন। তাদের ভাষ্যমতে স্থানীয় আওয়ামী লিগের সংসদ সদস্য (ঢাকা -৭) হাজি মোহাম্মদ সেলিম এই বাড়িটি কিনেছেন এবং এখানে একটি বহুতল ভবন বানাবেন। তারা আরও বলেন যে এই বাড়িটি কোন ঐতিহ্যবাহী ভবন ও স্থাপনার তালিকায় নেই।
A statement from the Member of Parliament HAJI SELIM's office claiming that he has bought the property and that he has the right to decide whether to keep the building get rid of it . what about High Court Judgement ?…it seems he… https://t.co/afLCbu0pWh
— usg.dhaka (@USG_Dhaka) June 15, 2019
সংসদ সদস্য হাজি মোহাম্মদ সেলিম এর অফিস থেকে জানানো হয় যে তিনি বাড়িটি কিনেছেন এবং তার অধিকার আছে বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলা বা অটুট রাখার। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনার কি হবে?
গত বছর, ১৩ই আগস্ট ঢাকা হাইকোর্ট ইতিহাসের সাক্ষী ঢাকার ২ হাজার ২০০ ভবন ভাঙতে বা বদলাতে সরকারী এজেন্সিগুলোকে একটি নির্দেশনা দেয়। একইসাথে “জাহাজ-বাড়ি” একটি ওয়াক্ফ সম্পত্তি যা বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসকের কার্যালয় এর অনুমতি ছাড়া হস্তান্তর বা বিক্রি করা যায়না। উক্ত কার্যালয় বলেছে এরকম কোন অনুমতি নেয়া হয়নি “জাহাজ-বাড়ি”র ক্ষেত্রে।
উল্লেখ্য, এর আগে মার্চ মাসেও এই ঐতিহাসিক ভবনটি ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই সময়ে ঢাকার হেরিটেজ সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলনরত সেচ্ছাসেবী সংগঠন আরবান স্টাডি গ্রুপ হাইকোর্টের নির্দেশনার কথা জানিয়ে থানায় জিডি করে ভাঙা বন্ধ করে।
সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী স্থানীয় অনেকে এই ভবনটি ভাঙ্গায় খুশি হয়েছেন কারণ এটি জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল এবং যে কোন সময় ভেঙ্গে পরতে পারত। এটি প্রমাণ করে যে স্থানীয়দের কাছে ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষণ এবং মেরামতের গুরুত্ব নেই।
ঐতিহ্য, ইতিহাস এসব গাল ভরা কথা!
ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ভেঙে ফেলায় অনেকেই ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। শুভ্রা কর লিখেছেন:
ঐতিহ্য, ইতিহাস, কৃষ্টি এসব এদেশে গাল ভরা কথা!!
ঐতিহাসিক স্থাপনাটি রক্ষা করা কেন জরুরি ছিল, তা নিয়ে সাহিত্যিক তানিয়া কামরুন নাহার লিখেছেন:
তিনতলা ‘জাহাজ বাড়ি’র দোতলায় ছিলো নকশা করা রেলিং, ছাদওয়ালা টানা বারান্দা। আর পুরো অবয়বজুড়ে নানা রকম কারুকাজ। কোণাকৃতির আর্চের সারি, কারুকাজ করা কার্নিশ। কলামে ব্যবহার করা হয়েছিল আয়নিক ও করিন্থিয়ান ক্যাপিটাল। পশ্চিম প্রান্তে আর্চ ও কলামের সাথেও নানারকম অলঙ্করণের ব্যবহার দেখা যায়। সব মিলিয়ে এই ভবনটিতে যে ধরনের অলঙ্করণের ব্যবহার, তা একে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছিল। এ ধরনের অলঙ্করণ পুরান ঢাকায় আর কোনো ভবনে দেখা যায় না। সেদিক থেকে এর নান্দনিক গুরুত্বের জন্যই ভবনটি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, রাজধানী হিসেবে ঢাকার বয়স ৪০০ বছরেরও বেশি। ১৬১০ সালে ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করা হয়। এর ফলে প্রশাসনিক এবং অন্যান্য কারণে মোগল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসনকাল পর্যন্ত ঢাকায় অসংখ্য স্থাপনা গড়ে উঠে। যার অনেকগুলোরই আজ ঢাকার ইতিহাস ও আদি ঐতিহ্যের অংশ।
তবে এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার অনেকগুলোই আজ হারিয়ে গেছে। যেগুলো অবশিষ্ট আছে, যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের মুখে এবং যে কোন সময় লোভী প্রভাবশালীদের কুক্ষিগত হয়ে যেতে পারে। যেমন, ১৬৪৪ থেকে ১৬৪৬ সালে মোগল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে নির্মিত দিওয়ান মীর আব্দুল কাশেমের জন্যে নির্মিত বড় কাটরা। অবৈধ দখল আর সংরক্ষণের অভাবে আজ তা ধ্বংসপ্রায়।
ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে অনেকগুলো বই ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন। তিনি বড় কাটরা-সহ ঢাকার ঐতিহাসিক নির্দশনগুলো ধ্বংস হওয়া নিয়ে আক্ষেপ করে লিখেছেন:
গত চার দশক বড়কাটরা ছোটকাটরা সংরক্ষণ করার জন্য কতো আবেদন-নিবেদন করলাম, কেউ শুনল না। আজ সেগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব দপ্তর যেখানে লালবাগ কেল্লার দেয়াল ভেঙে ফেলে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তখন আর কী বলা যায়! মূর্খতার বিরুদ্ধে আর কতো লড়াই করা যায়?
এদিকে ঢাকার একটি অনলাইন পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার ব্যাপারে নিরবতা আর প্রভাবশালীদের ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংসের বিবরণ:
ইতিমধ্যেই শাঁখারী বাজারের হেরিটেজভুক্ত ১৪ নম্বর বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সুত্রাপুরের বড় বাড়িটির সিংহভাগই ধ্বংস করা হয়েছে। মোগল আমলের স্মৃতিবাহী বংশাল মুকিম বাজার জামে মসজিদ, সিদ্দিক বাজার জামে মসজিদ সংস্কারের নামে ধ্বংস করা হয়েছে। [..] এসব স্থাপনা রক্ষায় সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও রাজউক ও ডিসিসির কর্মকর্তারা রহস্যজনক ভূমিকা পালন করেছে। অনেকক্ষেত্রে এদের নীরবতা ঐতিহ্য ধ্বংস সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করছে।
এদিকে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণের দাবিতে মানববন্ধন ও পদযাত্রা করেছে আরবান স্টাডি গ্রুপ। এসবের পাশাপাশি ঢাকার ঐতিহ্য রক্ষায় জনগণকে সচেতন করতেও কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।
ছবিতে ঢাকার ঐতিহ্য ধ্বংসের আরো চিত্রঃ