পরিবেশবাদীদের আন্দোলন আর আদালতের স্থগিতাদেশ কি যশোর রোডের শতবর্ষী গাছদের রক্ষা করতে পারে?

যশোর রোডের শতবর্ষী গাছগুলো। ইউটিউব থেকে স্ক্রিনশট নেয়া।

বাংলাদেশের পরিচিতি একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে। তবে এখানে উন্নয়ন কখনো কখনো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর তাতে হুমকির মুখে পড়ে পরিবেশ ও ঐতিহ্য। গত মাসে, এ ধরনের একটি ঘটনাই ঘটেছিল, যা আদালতের হস্তক্ষেপের কারণে ভেস্তে যায়। আদালত সরকারকে যশোর-বেনাপোল রোডের বেশকিছু শতবর্ষী গাছ কাটার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয়। আর সবকিছুর পিছনে ছিল সাধারণ মানুষ আর পরিবেশবাদীদের আন্দোলন। তবে শতবর্ষী এই গাছগুলোর ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত।

গত বছর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা যশোরে ৩৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের রাস্তা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ২,৭০০ গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ভারতের সাথে সংযুক্ত এই রোডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর দু’পাশে ছড়ানো অসংখ্য গাছ। এর মধ্যে দুইশ’রও বেশি গাছের বয়স ১৭০ বছরেরও বেশি। বর্ডারের ওপাশে, যশোর রোড (যা বর্তমানে ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১২ নামে পরিচিত) পশ্চিম বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী কোলকাতা পর্যন্ত গিয়েছে, যার বৈশিষ্ট্য একই ধরনের শতবর্ষী গাছ।

স্বাভাবিকভাবেই দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে গাছ কাটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন এবং সরকারের কাছে সিদ্ধান্ত বদলের আবেদন জানান। ২১০ একরের বেশি জায়গাজুড়ে গাছগুলোর অবস্থান। যা একটি বনের সমপরিমাণ। আর এই পরিমাণ গাছ কাটলে যে পরিবেশগত ক্ষতি হবে সেটাই তুলে ধরেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।

যশোর রোডের গাছ রক্ষা করুন।

সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যশোর রোডের গাছগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরতে থাকে। ভ্লগার অনুপম দেবাশীষ রায় এক ইউটিউব ভিডিওতে তুলে ধরেন কেন এইসব গাছদের বাঁচানো দরকারঃ

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের একটি মানবাধিকার সংস্থা গাছগুলো রক্ষায় উচ্চ আদালতে রিট করে। আর এর প্রেক্ষিতে আদালত গত ১৮ জানুয়ারি ২০১৮-এ গাছ কাটার ওপর ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা দেয়।

যশোর রোড: গাছগুলো ৬ মাসের জন্য রক্ষা পেল।

যশোর রোড কেন বিখ্যাত?

১৮৪০ সালে জমিদার কালীবাবু যশোর থেকে কলকাতা পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রোড তৈরি করেছিলেন। পথচারীদের সুবিধার জন্য তিনি রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য গাছ লাগিয়েছিলেন।

এই রাস্তার সাথে ৪৭-এর দেশ বিভাগ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এই রোড দিয়েই লাখো লাখো মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই শরণার্থীর ঢল দেখেই বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গসেপ্টেম্বর অন যশোর’ নামে একটি কবিতা লিখেন। পরবর্তীতে বব ডিলান এর সুরারোপ করে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ গেয়ে শোনানঃ

উন্নয়ন না ঐতিহ্য?

এর আগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারও যশোর রোডের ভারতের অংশের গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পরিবেশবাদী এবং স্থানীয় মানুষের বিরোধীতায় আদালত তা স্থগিত করে। গাছগুলিকে না কেটেই রাস্তা চওড়া করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

আদালতের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরে সরকার গাছ রেখেই সড়ক সংস্কারের কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

চলচ্চিত্রকর্মী বেলায়েত হোসেন মামুন যশোর রোডকে জাতীয় ঐতিহ্য ঘোষণা করে একে অবিকৃত রাখার দাবি জানিয়েছেন।

উন্নয়নের নামে মহাসড়কে গাছ কাটার ইতিহাস অনেক পুরোনো। সেদিকে ইঙ্গিত করে সবাক নির্বাক লিখেছেন:

শের শাহ আমলের গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক কিংবা বিখ্যাত যোশোর রোডের শতবর্ষী কাছ কাটা সাময়িক বন্ধ হয়েছে। তবে এই রাস্তা বা অন্য সড়ক গুলোর গাছ চুরি কখনই থেমে ছিল না, যশোর রোডের দু-ধারের স-মিল গুলো এর জলজ্যান্ত প্রামাণ, গাছের জন্য সচেতন নাগরিক এখন কান্না করলেও গাছের কান্না যুগ যুগ পুরানো! দেশের অন্য সড়ক বা মহাসড়ক গুলোর গাছ কাটা ও চুরি কোনটাই থেমে নেই। ঠিক এই সময়ে রাস্তার প্রশস্ত করণে হাজারে হাজারে গাছ কাটা হচ্ছে বা কাটতে হচ্ছে। কর্তিত গাছের বিপরীত নতুন সড়ক বনায়নের পরিকল্পনার অঙ্গীকারও বন অধিদপ্তর করেনি। তারপরেও নাগরিক সচেতনতা সেসব যায়গায় একেবারেই ঘুমন্ত। এই উদাসীনতারও উত্তোরণ চাই!

গাছ কাটার পক্ষে অংশ নেয়া আরেকজন হলেন জিএম মিথুন। তিনি সরকার দলীয় একটি ছাত্র সংগঠনের স্থানীয় পর্যায়ে নেতা। তিনি তার ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন:

যশোর রোডের গাছ কাটা নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। কিন্তু নতুন কিছু সৃষ্টি করতে, পুরাতন কিছু ত্যাগ করতে হয়, এটাই বাস্তবতা। গাছ গুলোর বেশির ভাগই ভঙ্গুর অবস্থা। রাস্তা অত্যন্ত জরুরী। সুতরাং ঐতিহ্যের কথা বলে চার লেন বাঁধাগ্রস্ত করা ঠিক হচ্ছে বলে মনে হয় না। …

এদিকে চার লেনের রাস্তার কথা বলে যে গাছ কাটার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেটা পুরোপুরি মিথ্যা বলে অভিযোগ করেছে সেভ ট্রি’স অন যশোর রোড নামের একটি ফেইসবুক পেইজ। পেইজের একটি নোটের মাধ্যমে জানায়, তারা তথ্য অধিকার আইনে যশোরের সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কাছ থেকে ডেভলপমেন্ট প্রজেক্ট প্ল্যান সংগ্রহ করেন।

চার লেনের কথা বলা হলেও সরকারি প্ল্যানে সেটার উল্লেখ নেই। ছবি কৃতজ্ঞতা: সেভ ট্রি’স অন যশোর রোড ফেইসবুক পেইজ।

তারা নোটে লিখেন:

এই প্রকল্পের কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে যে, এখানে রাস্তাটিকে চার লেন তৈরির কোন পরিকল্পনা নেই। রাস্তাটিকে দুই লেন রেখেই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। অর্থাৎ, বর্তমানে যে অবস্থায় আছে প্রায় সেভাবেই রাস্তাটিকে সংস্কার করা হবে। এই প্রকল্পের আউট কাম হিসেবে কয়েকটি বিষয়ের কথা বলা হয়েছে-
০১. রাস্তাটির পুরুত্ব বাড়ানো হবে ০২. বর্তমান রাস্তাটিকেই সংস্কার করা হবে ০৩. রাস্তার দুই পাশে হার্ড শোল্ডার নির্মাণ করা হবে ০৪. আরসিসি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে ০৫. কিছু ড্রেন তৈরি করা হবে ০৬. রোড সেফটি মার্কার ও রোড লাইনার আঁকা হবে।

যশোর রোডের গাছ কাটা রোধে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে মানিকগঞ্জের সিংগাইর-হেমায়েতপুর রোডের ৪ হাজার গাছ রক্ষার ক্ষেত্রেও। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮-এ উচ্চ আদালত এই আঞ্চলিক মহাসড়কের গাছ কাটা রোধেও ৬ মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

যশোর রোডের বাংলাদেশের অংশ আর ভারতের জাতীয় মহাসড়ক ১১২ প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের অংশ। এটি এশিয়ার সবচে’ বড় হাইওয়ে নেটওয়ার্ক। এর দৈর্ঘ্য ২০,৫৫৭ কিলোমিটার। যা জাপানের টোকিও থেকে শুরু হয়ে এশিয়ার অনেক দেশগুলোকে যুক্ত করে তুরস্ক ও বুলগেরিয়া হয়ে ইউরোপিয়ান ই৮০ মহাসড়কের সাথে যুক্ত হবে। বাংলাদেশ আর ভারত উভয় দেশই উন্নয়ন আর ঐতিহ্য রক্ষা নিয়ে দোটানার মধ্যে পরেছে। পাশাপাশি এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের গুরুত্বের কারণে শতবর্ষী এই গাছগুলো হুমকির মুখে পড়েছে এবং তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পরেছে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .