ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একজন কবিকে কমপক্ষে তিন বছর কারাদণ্ডের শাস্তিযোগ্য একটি ফৌজদারী অপরাধ “ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় অনুভূতি ক্ষুন্ন করা”র দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
তার অপরাধ? ভারতের রাজ্যসভা নির্বাচনকে ইঙ্গিত করা একটি কবিতা। । শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনকে উল্লেখ করে ১২-লাইনের ‘অভিশাপ’ শিরোনামের কবিতা। এই রাজ্যে বিরোধীদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির যোগী আদিত্যনাথ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
হিন্দু পুরোহিত যোগী আদিত্যনাথকে হঠাৎ করেই মনোনীত করে ভারতীয় জনতা পার্টি। কবিতাটিতে নির্বাচন এবং হিন্দু দেব-দেবীর ব্যবহৃত ‘ত্রিশূল’ উল্লেখ করা হয়েছে।
কবিতাটি বিশ্ব কবিতা দিবসে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছিল – তবে সবাই এর পংক্তিগুলোকে স্বাগত জানায় নি।
সমসাময়িক এই কবির বিরুদ্ধে হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত জন্যে শিলিগুড়ি পৌর থানায় একটি অভিযোগ নিবন্ধিত হয়। শিলিগুড়ি পুলিশ বুধবার শ্রীজাতর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫ক ধারা (ধর্মীয় অনুভূতি ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বা কুৎসা সৃষ্টিকারী কর্ম) এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার আওতায় অভিযোগ আনে। কথিত রয়েছে, তারা ফেসবুকের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোম্পানীটিকে কবিতাটি সরিয়ে ফেলতে বলেছিল।
কেউ কেউ বাক স্বাধীনতা রক্ষার কথা বললেও অন্যেরা কবির লেখার নিন্দা করেছে:
On international poetry day, there is an FIR against beloved bengali poet Srijato, few voices remaining in Bengal, who dare,a translation. pic.twitter.com/TiHJTab2qc
— Sudeshna Basu (@basusudeshna) March 22, 2017
আন্তর্জাতিক কবিতা দিবসে বাংলার প্রিয় কবি শ্রীজাতর বিরুদ্ধে এজাহার করা হয়েছে, বাংলার অবশিষ্ট কয়েকটি কণ্ঠস্বরের একটি – সাহস রাখেন (সত্য) অনুবাদের।
Exclusive interview with Poet Srijato on FIR booked against him for hurting religious sentiments https://t.co/rDrJpyGGRV
— Samya Sen (@Samya_tweets) March 22, 2017
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার জন্যে এজাহারভুক্ত কবি শ্রীজাতর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার
The likes of Srijato may please note that they don't have the right to insult any community/culture under the pretext of creativity.
— Surajit Sengupta (@sgsura1) March 22, 2017
শ্রীজাতকে যারা পছন্দ করেছেন তারা দয়া করে মনে রাখতে পারেন যে সৃজনশীলতার অজুহাতে কোন সম্প্রদায/সংস্কৃতিকে তাদের অপমান করার অধিকার নেই।
কবিতাটিকে নিয়ে উন্মাদনা দেশটির বৃহত্তম দুই ধর্মের অনুসারীদের মধ্যেকার ফাঁটলগুলোকেও তুলে ধরেছে।
Why was Srijato silent when I was hounded out of Bengal by Muslim fundamentalists: Taslima Nasreen https://t.co/XokN2BZUsL via @dna
— taslima nasreen (@taslimanasreen) March 30, 2017
মুসলমান মৌলবাদীরা যখন আমাকে বাংলা থেকে তাড়িয়ে দেয় শ্রীজাত তখন কেন নীরব ছিলেন: তসলিমা নাসরিন
একজন বাঙালি ব্লগার উভয় কবির প্রতি টুইটারে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন:
Both r Bengali authors.Both r hounded by religious fanatics. Both r incredibly brave.Both r fantastic writers. #Bengal stands with #Srijato https://t.co/xa6MFYBxvy
— Saileena (@saileenas) March 24, 2017
উভয়েই বাঙালি সাহিত্যিক। দুইজনকেই ধর্মান্ধরা তাড়া করেছে। উভয়েই অবিশ্বাস্যভাবে সাহসী। দুইজনই চমৎকার লেখক। #বাংলা #শ্রীজাত-এর সঙ্গে রয়েছে
Stop.interference with the freedom of writers .freedom of speech is the fundamental human rights.attack on mandakranta &srijato is barbaric pic.twitter.com/ArdyOJe5Gz
— Bikashranjan (@bikashranjan51) March 30, 2017
লেখকদের বাক-স্বাধীনতা নিয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করুন। বাক-স্বাধীনতা হলো মৌলিক মানবাধিকার। মন্দাক্রান্তা এবং শ্রীজাতর উপর হামলা বর্বরোচিত
অল্প সময়ের জন্যে ফেসবুকে সেন্সর
অনেক হৈচৈয়ের পর ২৬ মার্চ তারিখে কবিতাটি ফেসবুক থেকে সরানো হয়েছিল:
#Facebook has removed my poem: #Srijato https://t.co/wYNKJ8ajUr
— EnglishPost (@english_post) March 26, 2017
ভারতীয় সরকারের সরাসরি একটি অনুরোধের প্রতিক্রিয়ায় অথবা কেবল ব্যবহারকারীদের ফেসবুকের “অপব্যবহারের অভিযোগ” পদ্ধতিতে কবিতাটিকে চিহ্নিত করার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সামাজিক গণমাধ্যম কোম্পানী কবিতাটি মুছে দিয়েছিল কিনা সেটা স্পষ্ট নয়। ফেসবুকের নেটওয়ার্কের মধ্যেকার অংশগ্রহণের নিয়ম নির্দেশকারী অভ্যন্তরীণ “সম্প্রদায়গত মান” এই ধরনের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বাঁধা প্রদান করে না। তবে নির্দিষ্ট কোন বিষয়বস্তু কোন দেশের আইনের পরিপন্থী আদালতের এমন একটি বৈধ আদেশ পেলে কোম্পানীটি রাষ্ট্রীয় স্তরের সেন্সর বাস্তবায়ন করে থাকে।
২৭ মার্চ তারিখে সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইটটি কবিতাটিকে পুনঃস্থাপন করে এটি সরানোর জন্যে ক্ষমা চায়।
#Facebook apologises for ‘mistakenly’ removing poet #Srijato‘s controversial poem, restores post#ReligiousSentiment https://t.co/ii9R3zbMxF
— India Blooms (@indiablooms) March 27, 2017
‘ভুল করে’ কবি #শ্রীজাতর বিতর্কিত কবিতা সরানোর জন্যে #ফেসবুক ক্ষমা চেয়ে পোস্টটি পুনঃস্থাপন করেছে #ধর্মীয়অনুভূতি
পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরেকজন কবি মন্দাক্রান্তা সেন ফেসবুকে শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার কবিতার জন্যে প্রকাশ্য সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তার পরপরই ফেসবুকে মানুষ তাকে অশ্লীল বার্তা এবং গণধর্ষণের হুমকি দিতে থাকলে তিনি পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। এই বার্তাগুলি ফেসবুকের সম্প্রদায় মানের লংঘন – যাতে স্পষ্টভাবেই হয়রানি ও সহিংসতার হুমকি নিষিদ্ধ।
ভারতে বাক-স্বাধীনতা কতটা স্বাধীন?
বাক-স্বাধীনতার অধিকার ভারতীয় সংবিধানে সুরক্ষিত, তবে সীমাবদ্ধতা ছাড়া নয়। জনসংখ্যায় বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে এই বিশেষ স্বাধীনতা বাস্তবে কতখানি পরিমাণ সহ্য করা হবে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো সে বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক ঘটিয়েছে। এই অসহিষ্ণুতা এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে লেখক, কৌতুকাভিনেতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মতো অনেক শিল্পী নিজেদের ভুল দিকটিতে খুঁজে পেয়েছে।
সংবিধানের ১৯(১)(ক) ধারা প্রত্যেক নাগরিকের কথা বলা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। কথা বলা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার মানে হলো মুখ, লেখা, মুদ্রণ, ছবি অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে অবাধে নিজের বিশ্বাস এবং মতামত প্রকাশের অধিকার। এটি সংবিধানে নিশ্চিত করা ছয়টি মৌলিক অধিকারের অন্যতম। এসব মৌলিক অধিকার কিন্তু পরম নয়। সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং তাদের আইনী সাহায্য চাওয়ার অধিকার আছে বলে কথা বলা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা রাষ্ট্রদ্রোহ, অপবাদ, মানহানি ও অশ্লীলতা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে না।
শিল্পীদের যেমন তাদের কাজ এবং তাদের মতামত প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে – এবং তেমনি কারো (অধিকার) রয়েছে তাদের কাজ এবং ধারনায় বিক্ষুব্ধ বোধ করার। বিতর্ক গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান।
তবে যখন ভারতে বাক-স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি আসে তখন এই ধরনের ঘটনাগুলো বুঝিয়ে দেয় যে “কতটা স্বাধীন” সেই প্রশ্নটির উত্তর এখনো বাকি রয়েছে।