নিস আক্রমণের পর আমাদের এখন সুযোগ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়ানো বেদনাকে জয় করা, একসাথে, সম্মানের সাথে


নিস এর সিমিএজ বরো , ছবি প্যাট্রিস সেমেইরার,  পাবলিক ডোমেইন থেকে।


নিস এর সিমিএজ বরো , ছবি প্যাট্রিস সেমেইরার, পাবলিক ডোমেইন থেকে।

আমার জন্ম ফ্রান্সের নিস শহরে। আমার বাবা কাজের জন্যে কয়েক বছর সে শহরে থাকার পর নিজের দেশ মাদাগাস্কারে ফিরে যান। শহরটির পাহাড়ি এলাকায় আরেনে দো সিমিয়ে নামক পার্কে দাদার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছি। আমার তিন বছর বয়সকালে সেই পার্কে তাঁর সঙ্গে ছিলাম যখন তিনি প্রথম স্ট্রোকের শিকার হন এবং কয়েক বছর পর স্ট্রোকেই তিনি মারা যান।

গত রাতের বাস্তিল দিবস উদযাপনের সময় এই শহরে এক ভয়ানক সন্ত্রাসী ধ্বংসযজ্ঞ হোল – একজন পাগল লোক হাজার হাজার লোকের ভিড়ের মধ্যে একটি ট্রাক চালিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্তত ৮০ জনের প্রাণসংহার করলো। আমি দিব্য চোখে যেন দেখতে পাচ্ছিলাম শিশুরা দৌড়ে পালাচ্ছে, নারী এবং পুরুষ প্রাণভয়ে আর্তচিৎকার করছে কারণ একটি দানবীয় ট্রাক পূর্ণ গতিতে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে।

ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার, তাদের সহকর্মী কিংবা স্থানীয় বাসিন্দারা আজ সকালে জেগে উঠেছেন ক্রোধ এবং দু:খভারাক্রান্ত হৃদয়ে। তারা প্রিয়জনদের হারানোর বাস্তবতা এবং শহরময় শোকের পরিস্থিতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করছেন। গত প্রায় ২০ মাসের মধ্যে ফ্রান্সের মাটিতে এটি তৃতীয় হামলা হল। আজকের দিনটিকে শোকদিবস ঘোষণা করা হয়েছে, এবং গত নভেম্বরে প্যারিসে হামলার পর যে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল তা আরও তিন মাসের জন্য বাড়ানো হয়েছে (এটা ২৬শে জুলাই শেষ হওয়ার কথা ছিল)। এটি গত কয়েক মাসের মধ্যে বিশ্বজুড়ে যে কয়েকটি ব্যাপক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে অন্যতম।

কেন, কে করেছে এবং এটি কিভাবে হয়েছে বা একে কিভাবে প্রতিহত করা যেত তা নিয়ে এখুনি বিশ্লেষণ ও উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা করার আগে আপনাদের কাছে অনুরোধ, একটু ধীরেসুস্থে সবকিছু অনুধাবন করুন। আমাদের উচিৎ হবে না সন্ত্রাসবাদের মত সারা বিশ্বে প্রভাবিত একটি বৃহদায়তন সমস্যা বোঝা বা তার জন্যে সমাধান এই মুহূর্তে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। উচিৎ হবে না বিভিন্ন হামলার ঘটনার মধ্যে তুলনা করার চেষ্টা করা বা আলোচনা করা যে কোনটাতে মানুষ বেশী ব্যথা পেয়েছে বা কোনটাতে বেশী ক্ষতি হয়েছে। আসুন, এখনকার জন্য, মানুষের বেদনাকে সম্মান করি। কারণ ব্যথা সর্বত্র, সবাইকেই আক্রান্ত করেছে।

আমি বড় হয়েছি মাদাগাস্কারে। যখনই এ দেশে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বেদনাদায়ক কিছুর জন্যে কারো মৃত্যু হয়, সবসময় একইরকম দৃশ্য দেখেছিঃ আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুরা বাড়ি আসে মৃতদের যত্ন নেওয়ার জন্য, তাদের গোসল করিয়ে পরপারে যাত্রার জন্যে তৈরি করে। এরপর আত্মীয়স্বজন, পরিবার ও প্রিয়জনরা জড়ো হয়ে সারা রাত কথা বলে কাটায়, মূল লক্ষ্য থাকে শুধু একসঙ্গে সময় কাটানো। তখন শুধু মৃতজনদের সুখকর স্মৃতি থাকে কথোপকথনের বিষয়বস্তুঃ কেন? কোন কারণে? বা কোন কিন্তু নিয়ে আলোচনা হয়না কখনো …

নিস এর

নিস এর “প্রমনে দো আংলেই” রাস্তার একটি চিত্র। ছবি তুলেছেন ডব্লিউ এম কনলি – সিসি বাই-এসএ ৩.০

আমার যে শহরে জন্ম, তাকে আঘাত করা হয়েছে, তাই আমিও বেদনার্ত। যদিও বলতে পারেন আমার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের অধিকাংশ সময় অন্যত্র ব্যয় করেছি। গত বছর এই সময় আমি নিস শহরে ছিলাম। “প্রমনে দো আংলেই”, যেখানে এই বিয়োগাত্মক ঘটনা ঘটেছে, সেখানে আমি যাইনি সেবার। কিন্তু কাছাকাছি লোকালয়ে গিয়েছিলাম এবং ফুলের বাজারের সৌন্দর্য এবং নিকটবর্তী পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করেছিলাম।

এখন নিঃস্বের কথা চিন্তা করলে আমার শুধু সে এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞের কথা মনে হচ্ছে, এবং মনে পড়ছে আমার ধর্মমাতার কথা যিনি সম্ভবত সেখানকার আহতদের সারিয়ে তুলতে ব্যস্ত হয়েছেন। আর মনে পড়ছে আমার বন্ধুদের কথা, বিশেষ করে গ্লোবাল ভয়েসেস সহকর্মী আব্দুলায়ের কথা, যিনি সব কিছু নরকে পরিণত হবার কয়েক মিনিট আগে তার নিকটবর্তী ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়েছিলেন। হয়তো শুধুমাত্র হাস্যরসাত্মক ম্যাগাজিন দ্য অনিওন এর ফরাসি সংস্করণ লো গ্রাফি সঠিকভাবে ধরতে পেরেছে যে সবার কিরকম লাগছে এই হামলার পর। ম্যাগাজিনের সামনের পাতায় শুধু একটা শব্দ ছাপানো হয়েছে: ন (না)।

নিসের গতানুগতিক সামাজিকতা হৃদয়ঙ্গম করা সবসময় একটু জটিল এবং কঠিন। যদিও ফরাসি সৈকত তীরবর্তী এই শহরটি বিশ্বব্যাপী একটি পর্যটন স্থান হিসেবে পরিচিত, এই শহরটি কখনোই বিদেশী বা বিশেষ করে সংখ্যালঘু বান্ধব ছিলনা। আমরা বলতে পারিনা এই আক্রমণের পরমুহুর্তে বিভিন্ন মহলে কি কি প্রতিক্রিয়া হবে, তবে এই ধাক্কা সামলে ওঠার সময় ঐক্যের আশা করতে পারি। আমি ভালভাবেই সচেতন যে সম্প্রতি বাগদাদ থেকে ব্যাটন রুজ পর্যন্ত বেশ কটি সন্ত্রাসী হামলা বিশ্বের বহু অংশে ধ্বংস ও বেদনার কারণ হয়েছে। আমাদের মধ্যে অধিকাংশই এই অভিজ্ঞটার সাথে পরিচিত যে প্রিয় কিছু মানুষদের/বা কোন সম্পদ হারিয়েছি যার কারণ আমরা এখনো বুঝতে পারিনি। এই বিষয়ে আমাদের অনুভূতি তাই তেমন ভিন্ন নয়।

কিন্তু অনুগ্রহ করে, আজ, আমাদের বর্তমানে থাকতে দিন। নিহতদের পরিবার ও বন্ধুদের শোককে সম্মান করুন এবং তা করার মাধ্যমে, সমসাময়িক অন্যান্য হামলার জন্য শোককেও সম্মান করুন। এভাবেই আমাদের নিরাময় প্রক্রিয়া শুরু হোক, একসাথে ।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .