নিহত হলেন এই বছরের তৃতীয় বাংলাদেশী মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ

অনন্ত বিজয় দাশ। তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে ছবি

অনন্ত বিজয় দাশ। তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে ছবি

বাংলাদেশের অনলাইন প্রগতিবাদীদের জন্য এটা একটা বিষণ্ণ দিন। মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশের পঞ্চম বৃহত্তম শহর, সিলেটে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে তিন-চার জন মুখোস পরা, চাপাতিধারী আততায়ী কুপিয়ে হত্যা করে।

এই নিয়ে এবছরে বাংলাদেশের এটি তৃতীয় ঘটনা যাতে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রবক্তা একজন লেখককে ধর্মীয় চরমপন্থীদের হাতে নিহত হতে হল।

৩৩ বছরের দাশ একটি ব্যাঙ্কে কাজ করতেন। সেই সঙ্গে তিনি যুক্তি নামক একটি পাক্ষিক পত্রিকার সম্পাদক এবং সিলেটের বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী সমিতির সংগঠক ছিলেন। তিনি বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী চিন্তাভাবনার উপর চারটি বই লিখেছিলেন এবং গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম হয়েছিল ইসলামি দল এবং দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করার দাবিতে করা শাহবাগ আন্দোলন থেকে।

দাশ মুক্ত মনা নামক একটি বাংলা ব্লগের একজন প্রশাসক ছিলেন যে ব্লগটি সামাজিক পরিবর্তনের জন্য এপ্রিল ২০১৫ তে ডয়েচে ওয়েলের প্রখ্যাত ববস পুরষ্কার অর্জন করেছিল।

দোহা সেন্টার অফ ইন্টারনেট ফ্রিডম অনুযায়ী:

While most of Das's output for Mukto-Mona focused on science and evolution, he wrote a number of blogs that criticised some aspects of Islam and also of Hinduism.
In comments on Facebook posted early Tuesday, Das slammed the local member of parliament from the ruling Awami League party for criticising one of the country's top secular and science fiction writers.

যদিও দাশ মুক্তমনায় প্রধানত বিজ্ঞান এবং বিবর্তন নিয়েই লিখতেন কিন্তু ইসলাম এবং হিন্দুত্বের কিছু বিষয়ের সমালোচনা করে তিনি একাধিক ব্লগ লিখেছিলেন।

মঙ্গলবার ভোরে তিনি ফেসবুকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পার্টির স্থানীয় সাংসদকে দেশের বিশিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ কল্পবিজ্ঞানের লেখকের সমালোচনা করার জন্য তুলোধোনা করেছিলেন।

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্র হলেও খাতায় কলমে ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু গত এক দশকে যারাই ধর্মকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে তাদের বার বার ইসলামি চরমপন্থিদের নিশানা হতে হয়েছে।.

এই হুমকির প্রকৃতিও স্থানীয় থেকে ক্রমে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে। মাত্র এক সপ্তাহ আগে ভারতীয় উপমহাদেশের আল কায়েদা (একিউআইএস) দাবী জানিয়েছিল যে তারাই গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশি-মার্কিনী ব্লগার অভিজিত রায়কে (মুক্ত মনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা) হত্যা করেছে, যে হামলায় তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর জখম হয়েছিলেন। সম্প্রতি একটি সাক্ষাতকারে তিনি বাংলাদেশ সরকারের নিষ্ক্রিয় ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন যে
তার স্বামীর ওপর হামলা “একটি সুপরিকল্পিত, পূর্বনির্ধারিত অন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী হামলা।”

৩০শে মার্চ আরেকজন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান যিনি অযৌক্তিক ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধিতা করতেন তাকে ঢাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। দুইজন মাদ্রাসা (ইসলামি ধর্মীয় স্কুল) ছাত্রকে আটক করা হয় এবং তৃতীয় আততায়ী পালায়। রায় এবং রহমান উভয় মামলাই এখনো বিচারাধীন।

বেশকিছু দিন ধরেই দাশ চরমপন্থীদের হিট লিস্টে ছিলেন এবং প্রথম বার ২০১৩ সালে সরকারের কাছে ইসলামি মৌলবাদীরা যে ৮৪ জন ব্লগারের তালিকা নাস্তিক এবং ধর্মের প্রতি অবমাননাকর বলে জমা করেছিল তাতে তার নাম ছিল।

চরমপন্থি দল আনসার বাংলার টুইট অনুযায়ী একিউআইএস দাশকে হত্যা করেছে বলে দাবী জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে “আরেকটা ফাইল বন্ধ হল! পরের নিশানার জন্য তৈরি থাকুন”।

একিউআইএস-এর বিবৃতির স্ক্রিনশট

একিউআইএস-এর বিবৃতির স্ক্রিনশট

দাশের মৃত্যু নিয়ে দ্রুত ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিশিষ্ট ব্লগার আরিক জেবতিক ফেসবুকে লিখেছেন:

লিখতে, বলতে, ভাবতে কোনো কিছুতেই আগ্রহ পাই না। ৮৪ জনের একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছিল দুইবছর আগে, তালিকা থেকে নবম হত্যা হয়েছে আজকে সিলেটে। তালিকা নিশ্চয়ই চূড়ান্ত নয়, গত ২ বছরে আরো নাম সেই তালিকায় নির্ঘাত যুক্ত হয়েছে। কিন্তু অন্তত এই ৮৪ জনের ব্যাপারে গত ২ বছরে কোনো খোঁজখবর হয়নি, তাঁরা নিয়মিত বিরতিতে খুন হওয়া শুরু করেছেন।
মাসিক কোটায় হত্যা শুরু হয়েছে হয়তো এটি সপ্তাহান্তের কোটায় উন্নীত হবে। ৮৪ জন যাবে, আরো হাজার চুরাশির নাম তালিকায় আসবে। খানিক আহাজারি হবে, সবখানেই একটা ফিসফিস-চুপচুপ ভাব, কিছু বিকৃত মানুষের উল্লাস-তারপর পরের হত্যার জন্য অপেক্ষা।
এই দেশে আইনবহির্ভূত সব হত্যাই জায়েজ হিসেবে মেনে নিয়েছে বৃহত্তর জনগোষ্ঠি, এখানে সবগুলো খুনই ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা'।

ব্লগার এবং প্রগতিবাদী রায়হান রশিদ সেইসব মুক্ত মনাদের স্মরণ করেছেন যাদের মুক্ত চিন্তার জন্য তাদের বাংলাদেশে আক্রান্ত বা নিহত হতে হয়েছে:

বাক-স্বাধীনতার নিহত সৈনিকরা: #Hহুমায়ুনআজাদ #রাজিবহায়দার #অভিজিৎরায় #ওয়াশিকুর #অনন্তবিজয় ফটো সৌজন্য: মধুমণ্ডল pic.twitter.com/TC1wgjyCAw

— রায়হান রশিদ (@rayhanrashid) May 12, 2015

@rayhanrashid ৯০ দিনের মধ্যে ৩ জনকে হত্যা করা হল। বাংলাদেশের মুক্তমনারা জিহাদিদের সবচেয়ে সহজ নিশানা। @RichardDawkins @NickCohen4 @TarekFatah

— বিদিত (@bidit76) May 12, 2015

#Rajibhaidar #AvijitRoy #Wasiqurbabu #AnantaBijoy তালিকাটা ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। যতদিন আমাদের মধ্যে একজনও বেঁচে থাকবে, আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।

— রানা মেহের (@Rana_Meher) May 12, 2015

অনন্ত বিজয় দাশের শেষ পোস্টটি বাংলা থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করেছেন অরুণাভ সিনহা:

নিহত বাংলাদেশী ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের শেষ পোস্ট, তাকে হত্যা করার কয়েক ঘণ্টা আগে লেখা http://t.co/YRuVn5yRkF @scroll_in

— অরুণাভ সিনহা (@arunava) May 12, 2015

আন্তর্জাতিক মানবতা ও নৈতিকতা সমিতি (আইএইচইইউ) একটি ব্লগে লিখেছে যে সম্প্রতি সুইডিশ পিইএন এর আমন্ত্রণে একটি সম্মেলনে বক্তব্য রাখার জন্য অনন্ত বিজয় দাশ ভিসার জন্য যে আবেদন করেছিলেন সেটা ঢাকার সুইডিশ দূতাবাস এই বলে নাকচ করে দিয়েছিল যে তিনি সেখানে পাকাপাকি ভাবে থেকে যেতে পারেন।

নির্বাসিত লেখিকা ও কলামনিস্ট তসলিমা নাসরিন সরকারকে দোষারোপ করেছেন:

Bangladesh government is not taking any action against the Islamist-killers for being afraid to be labelled as anti-Islam. Islamists are allowed to do whatever they like in Bangladesh. It seems killing free-thinker atheists who criticize Islam is their main agenda.

Rajib Haider
A.K.M Shafiur Rahman
Avijit Roy
Washikur Rahman Babu
Ananta Bijoy Das.
Who is next?

Tomorrow maybe you. Or maybe me.

বাংলাদেশ সরকার ইসলাম-বিরোধী তকমা লাগার ভয় ইসলামবাদী-ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। ইসলামবাদীরা বাংলাদেশে যা খুশি তাই করতে পারে। মনে হচ্ছে মুক্তমনা নাস্তিক যারা ইসলামের সমালোচনা করেন তাদের হত্যা করাই ওদের মূল কর্মসূচী।

রাজীব হায়দর
এ.কে.এম. শাফিয়ুর রহমান
অভিজিত রায়
ওয়াশিকুর রহমান বাবু
অনন্ত বিজয় দাশ
এরপর কে?

আগামীকাল হয়ত আপনি। বা আমি।

ব্লগার হাসিব মাহমুদ লিখেছেন:

পুলিশের দায়িত্ব কি সেটা এই মুহুর্তে একটা প্রশ্ন। অভিজিৎ হত্যার কোন সুরাহা হয়নি। ব্লগার রাজিব হত্যার মামলায় গ্রেফতার ও সেটার বিচার শুরু হলেও সেই হত্যাকান্ডের নাটের গুরু এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অনন্ত বিজয়ের হত্যাকারিদের গ্রেফতার ও তাদের রাতারাতি বিচার শুরু হবে এটাও আশা করা কঠিন। আমাদের করণীয় চাপাতির মুখে লেখা না থামানো। লেখা থামালে জিতে যাবে আনসারুল্লাহ।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .