ব্লগারদের সীমা লংঘন না করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান

Activists march in a torch-light vigil demanding immediate arrest and exemplary punishment to the killers of secular blogger Niloy Neel.  Dhaka, Bangladesh. Image by Khurshed Alam Rinku. Copyright Demotix (8/8/2015)

ব্লগার নিলয় নীলের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে মশাল মিছিল। ঢাকা, বাংলাদেশ। ছবি তুলেছেন খোরশেদ আহমেদ রিঙ্কু। স্বত্ত্ব: ডেমোটিক্স (৮/৮/২০১৫)।

ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার নিলয় নীল হত্যার পাঁচদিন পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পুলিশ হত্যাকারীদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। মামলার অগ্রগতিও তেমন একটা নেই। গত ৭ আগস্ট ২০১৫-এ রাজধানী ঢাকায় নিজ বাড়িতে খুন হন ব্লগার নিলয় নীল। হত্যাকাণ্ডে পাঁচজন আততায়ী অংশ নিয়েছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, গত ছয়মাসে বাংলাদেশে ৪ জন ব্লগার খুন হয়েছেন। নিলয় নীল এ তালিকায় চতুর্থজন। এর ফলে বাংলাদেশের ব্লগারদের মাঝে আতংক আরো বেড়ে গেছে। অনেকে লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ নিরাপত্তাজনিত কারণে আত্মগোপন করেছেন। মৌলবাদীদের হত্যার হুমকির পাশাপাশি সক্রিয় ব্লগাররা এখন জেল-জুলুমের ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

রক্ষণশীল মৌলবাদীদের একটি দল এর আগে সরকারের বিশেষ কমিটির কাছে ৮৪ জন ব্লগারের একটি তালিকা হস্তান্তর করে। তালিকায় উল্লেখিত ব্লগারদের তারা “নাস্তিক” এবং ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লিখছেন বলে অভিযোগ করে। ইতোমধ্যে এই তালিকার ১১ জন হত্যা শিকার হয়েছেন।

নিলয় নীল হত্যার পরে ব্লগারদের মাঝে আতংক আরো বেড়ে গেছে। শুধু ব্লগাররাই নন, তাদের বইয়ের প্রকাশকরাও মৌলবাদীদের হুমকির মুখে রয়েছেন। মৌলবাদীরা ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বেশ কয়েকটি বইয়ের প্রকাশককে নাস্তিকতাবাদ প্রচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।

নিলয় নীল খুনের পরদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীলের খুনীদের ইসলামের কলঙ্ক বলে অভিহিত করেছেন। আগস্টের ৮ তারিখে এক মিটিংয়ে অংশ নিয়ে তিনি বলেন:

Islam is a religion of peace. Those who want to taint it cannot have true faith in it. How dare they call themselves Muslims? [..]

And now they are murdering bloggers for writing against the religion. Who benefits from this gory mayhem? Which religion they claim to have been protecting?

ইসলাম শান্তির ধর্ম। তাই যারা ধর্মকেও কলুষিত করছে, তারা ধর্মবিশ্বাসী হতে পারে না। তারা নিজেদের মুসলমান হিসেবে কীভাবে ঘোষণা দেবে? […]

আবার ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার অভিযোগে এখন তারা ব্লগারদের হত্যা করছে। এই হানাহানি রক্তারক্তি কার জন্য, কিসের জন্য, কার স্বার্থে? এটা কোন ধর্মের মর্যাদা রক্ষার জন্য?

তিনি বলেন:

We cannot let this happen in Bangladesh. The people of this country are peace-loving.

বাংলাদেশে এটা আমরা চলতে দেব না। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ব্লগার হাসিব সচলায়তনে প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট করছেন না বলে অভিযোগ করেন:

সরকার ব্লগারদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে যতোটা না চিন্তিত, তার থেকে চিন্তিত তাদের ধার্মিক ইমেজ যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সেটা নিয়ে। সরকার ধর্মীয় রাজনীতি তো বটেই, সেই ধর্মীয় রাজনীতি যারা করে তাদের আদর আপ‍্যায়নেই আন্তরিকতা দেখিয়েছে। আর ব্লগারদের মুখ বন্ধ করতে চালু করেছে ৫৭ধারার মতো কালো আইন।

বাংলাদেশের আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় অনলাইনে ভুয়া, অশ্লীল কিংবা অবমাননাকর তথ্য প্রকাশ করাকে অপরাধমূলক কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

সম্প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে পরিচয় দেয়া আওয়ামী ওলামা লিগের তরফ থেকে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে, তার সমালোচনা করে হাসিব আরো লিখেছেন:

নাস্তিক হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া মানে এই নয় যে, মিডিয়া ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকদের হাইলাইট করবে। সুতরাং এসব নাস্তিক ব্লগার কর্তৃক বিভিন্ন ব্লগ, ওয়েবসাইট, স্যোসাল মিডিয়ায় কুরুচিপূর্ণ নাস্তিক্যবাদী লেখা বন্ধে ধর্ম অবমাননার জন্য মৃত্যুদন্ডের আইন প্রণয়ন করতে হবে। [..]

এদেশকে নাস্তিক্যবাদী দেশ বানাতে ইসলাম বিরোধী শিক্ষনীতি তৈরী করা হয়েছে। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী বক্তব্য যুক্ত ও ষড়যন্ত্রমূলক পাঠ্যপুস্তক অবিলম্বে বাজেয়াপ্ত করতে হবে। সাথে সাথে ইসলাম বিরোধী প্রচলিত শিক্ষানীতি বাতিল করতে হবে। ৯৮ ভাগ মুসলমানের এদেশের শিক্ষানীতি সম্পূর্ণ ইসলামিক করতে হবে।

হাসিব আরো লিখেন:

যে মুহুর্তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগি একটি দল এই সমস্ত অশ্লীল দাবিনামা ঢাকা শহরের রাস্তায় মাইকে উগরাচ্ছে তখন শেখ হাসিনা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কনফারেন্স রুমে দাবি করছেন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করতে দেয়া হবে না। দুঃখিত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এভাবে হবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের এধরণের অবস্থান সাংঘর্ষিক।

একাত্তর চ্যানেলের নিউজ ডিরেক্টর সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা প্রশ্ন তোলেন:

ধর্মান্ধতা আজ আমাদের দেশের শান্তি বিঘ্নিত করছে। সেখানে ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পর্কযুক্ত কোনও সংগঠন এমন বক্তব্য দিলেতো বলতে হবে, বিপদ দরজায়।

তবে আওয়ামী লিগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ এক সাক্ষাৎকারে বলেন:

Awami League does not have any wing or associate group by the name of Ulema League. They have no political link with the party.

ওলামা লিগ নামে আওয়ামী লিগের কোনো সহযোগী সংগঠন নেই। ওদের সঙ্গে দলের কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক নেই।

তাই হানিফ আওয়ামী লিগের সাথে আওয়ামী ওলামা লিগকে মিলিয়ে না ফেলার জন্য সবার কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। সংবাদপত্রের তথ্যমতে, আওয়ামী ওলামা লিগের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারা শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের থেকে তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও নীতি আলাদা। আওয়ামী লিগের সাথে তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা তাদের বক্তব্যের কোনো নিন্দা জানাননি।

গত রবিবার পুলিশ প্রধান একেএম শহিদুল হকের বক্তব্য আগুনে ঘি ঢেলে দেয়:

Free-thinkers and bloggers should not cross the limit of tolerance while expressing their views on religion. If any person is hurt by any writing, s/he may take legal action. They can file a case with the police. Everyone should obey the law.

ব্লগারদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আপনারা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করবেন না। লিখতে গিয়ে সীমা লঙ্ঘন করবেন না। তবে কোনো লেখার দ্বারা কারো যদি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তাহলে তিনি যেন মামলা করেন। সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে।

তিনি জানান, এ ধরনের ঘটনায় আইনে ১৪ বছর পর্যন্ত দণ্ড হওয়ার বিধান রয়েছে।

অন্য একজন পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন:

যারা ব্লগারদের হত্যার সঙ্গে জড়িত এবং যারা হযরত মুহাম্মদ (সা.), ধর্ম ও কোরআন নিয়ে যুক্তিহীনভাবে আঘাত করে ব্লগে লেখে তাদের সকলকে আইনের আওতায় আনা হবে। কারণ যারা যুক্তিহীনভাবে ধর্ম নিয়ে ব্লগে লেখে তারাও উগ্রবাদী।

দুই পুলিশ কর্মকর্তার মন্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। প্রবাসী অ্যাক্টিভিস্ট রায়হান রশীদ টুইট করেন:

আমাদের পুলিশ প্রধানের সাথে পরিচিত হোন। ‘বেঁচে থাকা’ ব্লগারদের প্রতি তার বার্তা: ‘সীমা লংঘন করবেন না’।

সাংবাদিক তৌফিক আই. খালিদি টুইট করেছেন:

এইসব ক্ষেত্রে একজন পুলিশ অফিসার কি কোথায় সীমা টানতে হবে তা বলে দিতে পারেন?

এদিকে অজ্ঞাতনামা একটি গোষ্ঠী পুলিশ প্রধানের পদত্যাগ চেয়ে অনলাইন পিটিশন ক্যাম্পেইন শুরু করেছে।

পুলিশ প্রধানের বক্তব্যের সমালোচনা করে মুক্তাঙ্গন ব্লগ একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে ব্লগটি উল্লেখ করে, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পুলিশের। তারা সেটা করতে পারেনি। এখন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ব্লগারদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া নিয়ে কথা বলছে, যাতে জনগণ বিভ্রান্ত হয়। মুক্তাঙ্গন একই সঙ্গে এও উল্লেখ করেছে যে, ব্লগাররা দেশে মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট অবগত রয়েছেন:

এ কথা সঠিক নয় যে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে ব্লগাররা ঢালাওভাবে আঘাত করে যাচ্ছেন। কোনো কোনো ব্লগার তাঁদের মুক্তচিন্তা চর্চার অংশ হিসেবে কখনো কখনো হয়তো ধর্মের (সেটা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য) কোনো কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলে থাকেন, কিন্তু তা তাঁরা নির্দিষ্ট স্থানে এবং সামগ্রিক আলোচনার ধারাবাহিক অংশ হিসেবেই করে থাকেন। প্রকাশ্যে জনসমক্ষে হট্টগোল তুলে তাঁরা কিছুই করেন না, যার ফলে মানুষ উত্ত্যক্ত বোধ করবে কিংবা আহত ও ক্রুদ্ধ হবে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মূল কথাই হল অপ্রিয় মতামত অপ্রিয় ভঙ্গিতে প্রকাশেরও পূর্ণ স্বাধীনতা, যতক্ষণ না তা কোনো সুষ্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত নিরপেক্ষভাবে বিচারযোগ্য প্রচলিত আইনের কোনো বিধানের নিষেধের মধ্যে না পড়ে। তাই, যারা তাদের রাজনৈতিক বা অন্য কোনো হীন উদ্দেশ্যে ব্লগারদের উম্মুক্ত আলোচনা ও বক্তব্যকে খণ্ডিতভাবে যেখানে-সেখানে উপস্থাপনের মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে – সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বরং উচিত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .