“ইভ টিজিং” বাংলাদেশে অন্যতম এক সমস্যা, যা প্রায় প্রতিদিনের জীবনে মোকাবেলা করতে হয় অনেক নারীকে। সামাজিক এই সমস্যা গ্রাম কিংবা শহর সবখানে প্রকট ভাবে দৃশ্যমান। বলা যায় বাংলাদেশের অনেক কিশোরীর স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে ‘ইভ-টিজিং’। কখনো কখনো এই ধরনের ঘটনা শেষে হানাহানি এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে খুনোখুনির ঘটনায় পর্যবসিত হয়। বাংলাদেশে “ইভ-টিজিং” ঠেকাতে গিয়ে ভাই, বাবা কিংবা মা-এর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে।
সরকারী কঠোর আইন সত্ত্বেও ইভ-টিজিং এর ঘটনা ঘটছে এবং অনেক সময় সামাজিক নিরবতার কারণে অপরাধীরা ইভ-টিজিং করেও পার পেয়ে যায়। তবে সম্প্রতি ঢাকা শহরের এক ইভ-টিজিং-এর ঘটনায় একজন ব্লগার এই রকম টিজিংকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে এবং পরবর্তীতে সে ইভ-টিজারদের পরিচয় অনুসন্ধানে ব্লগের সাহায্য প্রার্থনা করে।
১১ মে ২০১২ তারিখে সামহয়ারইন ব্লগে সর্বনাশা ছদ্মনামের এক ব্লগার একটি পোস্ট লিখেন, যার শিরোনাম, “ঠিক এই মূহুর্তে আমি সামুর লক্ষাধিক ব্লগারের সাহায্য চাইছি, এখনই …”।
এখানে তিনি একটি ইভ-টিজিং এর ঘটনা তুলে ধরেন:
দাঁড়িয়ে ছিলাম ধানমন্ডি এলাকার রোড ৫/এ, মেডিনোভার উল্টা দিকের মেইন রোডে। রাত তখন প্রায় ৯:৫০ এর মত বাজে। হঠাৎ দেখলাম, ইউ ল্যাব ইউনিভার্সিটির দিক থেকে কিছু উঠতি বয়সী ছেলে হেঁটে হেঁটে স্টার কাবাব যেদিকে, সেদিকে যাচ্ছে । একজন তরুণী দাঁড়িয়ে একটি সিএনজি অটোরিক্সার সঙ্গে কথা বলছিলেন। ছেলেগুলো তাঁর থেকে অনেক কম বয়সী হওয়া সত্ত্বেও হঠাৎ তারা মেয়েটির জামার নিচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে পাজামার পেছন ধরে টান দিল .. দিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে চলল .. ঘটনার আকস্মিকতায়, অপমানে তরুণীটি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, লজ্জায় মুখে কিছু বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে।
এবং এই বিষয়ে তার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন:
আর সহ্য করতে পারলাম না, দৌড়ে যেয়ে ছেলেটিকে পাকড়াও করে প্রতিবাদ করলাম। নিমিষেই ছেলেটির সঙ্গী-সাথীরা আমার উপর চড়াও হল। উপর্যুপরি কিল-ঘুষি-লাথি-চড় !! আমি চিৎকার করে এর প্রতিরোধ করতে চাইলে ছেলেগুলো তাদের ইউ ল্যাবের ছাত্র বলে পরিচয় দেয়। আমাকে টেনে সেদিকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে। মেয়েটি আমার সাহায্যে এগিয়ে এসে হাও-মাও করে কাঁদতে থাকে। আশ-পাশে এরই ভেতর অনেক লোক জমে গেছে। তারা জানতে চাইলে আমি তরুণীটিকে দেখিয়ে ঘটনা বর্ণনা করি।
কিন্তু ব্লগার অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন যে আশেপাশের অনেক অপরাধীর হয়ে সাফাই গাইছে:
লক্ষ্য করি যে, ইউ ল্যাবের ছাত্র, পাশের সিগারেটের দোকানদার, ছাত্রদের গাড়ী চালক সবাই ঐ বদমাস ছেলেগুলোর পক্ষে সাফাই গাচ্ছে, কেউ কেউ ওদের সমর্থনও করছে। বলার চেষ্টা করছে, রাস্তা-ঘাটে এরকম হতেই পারে, ওরা হয়তো একটা ভুল করেই ফেলেছে, কিন্তু তা বলে আমার এত বাড়াবাড়ি করা উচিৎ হচ্ছে না, ঝামেলা না বাড়িয়ে আমি যেন তাড়া তাড়ি সেখান থেকে চলে যাই .. আর আমজনতার বিশাল এক অংশ নীরব, নিশ্চুপ। প্রতিরোধ দূরে থাক, অন্যায়ের প্রতিবাদটি পর্যন্ত কেউ করছে না।
তবে ব্লগার নিজে থেমে থাকেননি। তিনি অপরাধীদের পরিচয় উদঘাটনের জন্য উপরোক্ত পোস্টটি লিখেন এবং সেখান উক্ত অপরাধীদের পরিচয় সনাক্ত করার জন্য ব্লগারস মিটিং সহ কতিপয় পদক্ষেপে গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন। ব্লগার তাঁর এই পোস্টে অনলাইন সম্প্রদায়ের কাছে এদের পরিচয় উন্মোচনের সাহায্য কামনা করেন।
অজস্রবার পঠিত এই পোস্টে (এই লেখা শেষ করা পর্যন্ত ৪৩৮৩৯ বার) প্রচুর মন্তব্য এসেছে(১০৬২টি)।
শফিউল আলম মন্তব্য করেছেন তিনি তাদের পরিচয় বের করতে সাহায্য করতে পারবেন:
অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু কিছু প্রবলেমের কারণে বলতে পারছি না। যাই হোক। আমি ঐ এলাকার এবং ইউল্যাবের অনেকের সাথেই পরিচয় আছে। যদি ওরা ইউল্যাবের কেউ হয়, তাহলে মনে হয় বের করতে পারব।
নষ্টালজিক ইভ টিজিং-এর ঘটনায় ক্ষুদ্ধ, কিন্তু লেখকের ভূমিকায় আশাবাদী:
জঘন্য অনুভূতি হলো পড়ে!
আপনার সাহসকে সম্মান জানাই! আমরা সবাই ভিড়ের মানুষ হয়ে যাই নাই। আপনার মত মানুষ আছেন, যারা ভিড় ঠেলে সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে ভোলেন না এখনও।
বীরেন্দ্র মন্তব্য করেছে কেন অপরাধীদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন:
সামগ্রিকভাবে সমাজের নৈতিক অবক্ষয়। আপনি যে প্রতিবাদ করেছেন এ জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এদের যদি শাস্তি হয় তাহলে ভবিষ্যতে অপরাধ কমবে।
সাজিদ মন্তব্য করেছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই ধরনের সমস্যার সমাধান সম্ভব:
আপনাকে স্যালুট, কারো পক্ষে সম্ভব না এর সমাধান করা, যদি না আমজনতা জেগে উঠে
আশিকুর রহমান অমিত তার মন্তব্যে মানুষের নীরবতার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে:
কোথায় চলে গেছে আমাদের নৈতিকতা, ঘৃণা প্রকাশ করতেও লজ্জা লাগছে ইউল্যাবের ঐ সকল জানোয়ারদের প্রতি। সেই সাথে ধিক্কার তাদের প্রতি যারা প্রতিবাদ করতে দেখেও এগিয়ে আসেনি।
নোমান মীর ব্লগারের সাহসিকতার প্রশংসা করেছে:
আপনার মানবতা এবং সাহসিকতার জন্য স্যালিউট।
তবে থেমে না থেকে এগিয়ে যান, আমরা আছি।
দুর থেকে কাঙ্গাল মুরশিদ এই লড়াইয়ে সমর্থন জানিয়েছে, তবে সাথে সে সতর্ক:
আপনাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না – আপনি যা করছেন তার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন রইল। আমি থাকি চট্টগ্রামে, তাই ব্যাক্তিগত ভাবে অংশ নিতে পারছি না। আপনারা এগিয়ে যান – বিবেকবান মানুষেরা নিশ্চয়ই আপনাদের সাথে থাকবেন। শুধু একটাই অনুরোধ – বিষয়টি কিছুতেই যেন রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে না ওঠে।
ব্লগার কেবল বিষয়টিকে অনলাইনে সীমাবদ্ধ রাখেনি, তিনি অফলাইনে সাহায্যের আবেদন করেন একটি মিটিং-এর আহ্বান জানান, প্রথমেই সকল ব্লগার, অনলাইন একটিভিস্ট এবং আগ্রহী যে কাউকে ব্লগার্স মিটিং প্রসঙ্গে।
প্রস্তাবিত তারিখ : ১৩ মে ২০১২
প্রস্তাবিত সময় : রাত ০৮:১৫
প্রস্তাবিত স্থান : টি.এস.সি. চত্বর, ঢা.বি.আগ্রহী সবাই দয়া করে মন্তব্যের স্থানে উপস্থিতির ব্যাপারটি নিশ্চিত করুন।
অনেকে এই মিটিং-এর ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে জানিয়েছে যে তারা মিটিং-এ উপস্থিত থাকবে।
এদিকে ঘটনার তাৎপর্য অনুধাবন করে ইউল্যাব কর্তৃপক্ষ ব্লগে একটি বিবৃতি প্রদান করে, এতে উল্লেখ করা হয় [ বাংলা ভাষায়]:
আপনার ব্লগে প্রচারিত ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এর শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে একটি বক্তব্য ইউল্যাব কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি গোচর হয়েছে। এ ধরনের একটি ঘটনা যা ইউল্যাব ক্যাম্পাস এর অদূরে ঘটেছে তা অনাকাঙ্খিত ও অত্যন্ত নিন্দনীয়। আমরা এই ঘটনার শিকার সকলের প্রতি গভীর সহমর্মিতা ও সমবেদনা প্রকাশ করছি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আজকের সমাজে জনারণ্যে আমাদের মা বোনেরা নিরাপদ নয়। এই ধরনের একটি বিষয়ের বিরুদ্ধে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউল্যাব সবসময় বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহন করে।
বিবৃতিতে এই ঘটনা তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করা হয়
বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে ইউল্যাব তার নিজস্ব পদ্ধতিতে তদন্ত শুরু করেছে। আমরা ইতিমধ্যে SOMEWHEREINBLOG এর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্লগার এর সাথে যোগাযোগ এর চেষ্টা করেছি। তদন্ত প্রক্রিয়াটি দ্রুত ও সঠিক করার লক্ষে আমরা পুনরায় তাকে আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের জন্য আহবান জানাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে ব্লগার ও ভিকিটিম কে আমরা পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছি।
এই বিবৃতিওর নীচে অনেকে মন্তব্য করেছে, তবে অনেকে মন্তব্যে এই ধরনের তদন্তের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে।
হেডস্যার বলেছে:
সব ঠিক আছে। তাদের তদন্ত কমিটি যা আসল সত্য প্রকাশ করবে তার কি নিশ্চয়তা? যেহেতু এইটার সাথে ইউল্যাব এর সুনাম বা অন্য স্বার্থ জড়িত তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে এটাকে ধামাচাপা দিতে।
কণাদ বলেছে :
এই ঘটনার তদন্তের ভার কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিলে আসল অপরাধীরা কখনোই বের হয়ে আসবে না। তাছাড়া অপরাধীদের সবাই ইউল্যাবের নাও হতে পারে। তাই আমাদের, ব্লগারদের অনুসন্ধান অব্যাহত রাখতে হবে।
তবে এই ধরনের উদ্যোগের জন্য অনেকে ইউল্যাব কর্তৃপক্ষের প্রশংসা করেছেঃ
জিয়া চৌধুরী বলেছে:
ইউল্যাব কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। এবার ইউল্যাবের ছাত্রদের এগিয়ে আসা উচিত অপরাধীদের ধরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে।
প্রথম বিবৃতির পর এই ঘটনায় নেওয়া পদক্ষেপের বিবরণ জানিয়ে ইউল্যাব দ্বিতীয় আরেকটি বিবৃতি প্রদান করে।
এই ঘটনায় অল্প কয়েকজন ব্লগারের নাটকীয়তার সমালোচনা করলেও, এই ঘটনা অবিশ্বাস করেনি কেউ। কারণ বাংলাদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে অহরহ।
ইউল্যাবের বিবৃতি, ব্লগারদের মিটিং, এবং ইউল্যাব কর্তৃপক্ষের সাথে ব্লগারের আলোচনায়, কিভাবে অপরাধীদের জন্য অনুসন্ধান চালানো হবে সে বিষয়ে অভিন্ন মত প্রকাশ পেয়েছে। তবে নানা মতামত এবং পরামর্শ সত্ত্বেও অপরাধী এখনো সনাক্ত হয়নি। অপরাধীরা সনাক্ত না হলেও, ব্লগার একটি অপরাধের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, যে আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হয়েছে হাজার কণ্ঠে।
3 টি মন্তব্য
আমার পূর্ণ সমর্থনা ব্লগারদের সন্মিলিত উদ্যোগ-এর প্রতি, এবঙ চাই সবার সন্মিলিত আওয়াজ উঠুক এইসব হীনমন্য-অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে। যাতে স্থবির প্রশাসনও গা-ঝাড়া দিয়ে এদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে। কৃতকর্মের জন্য অপরাধীরা যেন প্রকাশ্য নির্লিপ্ততা সত্বেও প্রকাশ্যেই শাস্তির মুখোমুখি হতে বাধ্য হয় / তাদের বাধ্য করা হউক। হার্দিক অভিনন্দন সাহসী ব্লগার-এর জন্য।