লাল-চিহ্নিতকরণ কি এবং কেন এটি ফিলিপাইনে বিপজ্জনক?

নতুন বাতানে চাদ বুকের জন্যে ন্যায়বিচারের আহ্বান জানানো প্ল্যাকার্ড। উইকিমিডিয়া সাধারণ থেকে র‍্যোমান্ড্রেসেছবিসৃজনী সাধারণ একইরকম ব্যবহার ৪.০ লাইসেন্সের অধীনে ব্যবহৃত।

ফিলিপাইনের মানবাধিকার সুরক্ষকরা লাল-চিহ্ন কর্মী ও সুশীল সমাজ সংস্থগুলি দমনের একটি সরকারি টাস্ক ফোর্সের জন্যে ১,০০০ কোটি ফিলিপিনো পেসো (প্রায় ১,৯০৮ কোটি টাকা) বাজেট পুনরুদ্ধারে আন্দোলন করেছে ৷ বাতিল করে অর্থ প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো সত্ত্বেও দ্বিকক্ষীয় কমিটি ২০২৩ সালে স্থানীয় কমিউনিস্ট সশস্ত্র সংঘর্ষের (এনটিএফ-ইএলসিএসি) অবসানের জন্যে জাতীয় টাস্ক ফোর্সের জন্যে অর্থ বরাদ্দ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

মানবাধিকার জোট কারাপাতান একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, “এনটিএফ-ইএলসিএসি লাল-চিহ্ন, রাজনৈতিক কর্মী ও অন্যান্য সরকারি সমালোচকদের হয়রানি ও ভয় দেখানো এবং বিপ্লবী আন্দোলনের সমর্থক বলে অভিযুক্ত বেসামরিক ব্যক্তিদের জোরপূর্বক আত্মসমর্পণে প্ররোচিত করার জন্যে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। এনটিএফ-ইএলসিএসি-এর লাল-চিহ্ন প্রচারাভিযানের শিকার অনেকে গ্রেপ্তার ও বানোয়াট অভিযোগে আটক হয়েছে, অন্যান্যরা সতর্কীকরণ গোষ্ঠী অথবা সামরিক বাহিনী পরিচালিত সশস্ত্র সংঘর্ষে নিহত হয়েছে।”

লাল-চিহ্নিতকরণ বা লাল-নির্যাতন হলো সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ব্যাপকভাবে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে “কমিউনিস্ট ফ্রন্ট”, “কমিউনিস্ট-সন্ত্রাসী” বা “কমিউনিস্ট সহানুভূতিশীল” হিসেবে চিহ্নিত করা। অনেকটা ১৯৫০-এর দশকের (মার্কিন) ম্যাককার্থিবাদের মতো ফিলিপাইনে লাল-চিহ্নিত প্রায়ই কোন প্রমাণ ছাড়াই করা হয়।

সুরক্ষার জন্যে মানবাধিকার আইনজীবীদের দায়ের করা ২০১৫ সালের একটি আবেদনের ভিন্নমতে সর্বোচ্চ আদালতের সহযোগী বিচারপতি মারভিক লিওনেন লাল-চিহ্নিতকরণ সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জাতিসংঘের প্রাক্তন বিশেষ দূতকে উদ্ধৃত করেছেন। “যেমন (জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক ফিলিপ) অ্যালস্টন বলেছেন, এটি বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংস্থার ‘গালমন্দ,’ ‘ অপবাদ’ বা ‘অনুষঙ্গের কারণে অপরাধী’ করা। সামরিক বাহিনী তাদের সরকারি সামরিক বা আধাসামরিক ইউনিটগুলির সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার জন্যে এই গোষ্ঠীগুলিকে কমিউনিস্ট গোষ্ঠী হিসেবে ছকে-বেঁধেছে অথবা ব্যঙ্গ করেছে, “লিওনেন বলেছেন।

২০০৭ সালে ফিলিপাইনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উপর একটি তদন্ত পরিচালনাকারী অ্যালস্টন পর্যবেক্ষণ করেছেন কীভাবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী একটি “যুদ্ধাবস্থা” বা ফিলিপাইনের কমিউনিস্ট পার্টি ও নিউ পিপলস পার্টির সাথে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের তালিকা বজায় রেখেছে। অ্যালস্টন তার ২০০৭ সালের প্রতিবেদনে ফিলিপাইন সরকারের জন্যে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেন যার মধ্যে “সশস্ত্র বিদ্রোহে জড়িতদের সাথে রাজনৈতিক বা অন্যান্য সুশীল সমাজের গোষ্ঠীগুলিকে যুক্ত করে প্রকাশ্য বিবৃতি দেওয়া বন্ধ করার জন্যে অবিলম্বে সমস্ত সামরিক কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া” অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, “এই ধরনের যেকোনো বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার মধ্যে থাকে। তাদের অবশ্যই স্বচ্ছ মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে, সংবিধানের মানবাধিকার বিধান এবং প্রাসঙ্গিক চুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হয়।”

অ্যালস্টনের সফরের পনেরো বছর পরেও লাল-টোপ দেওয়ার চর্চা বন্ধ হয়নি। সামাজিক গণমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। লাল-চিহ্নিতকারীদের বেশিরভাগই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সরকারি কর্মকর্তা এবং সামাজিক গণমাধ্যমের মঞ্চ বিশেষ করে ফিলিপাইনে বেশ জনপ্রিয় ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে তাদের ট্রল তাদের বর্ণনাকে বিস্তৃত করে।

ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার অধ্যাপক ডিওসা ল্যাবিস্টে লাল-চিহ্নিতকরণকে বিভ্রান্তির সাথে তুলনা করে বলেছেন: “অনলাইনে ট্রল প্রচারিত মিথ্যা বা বানোয়াট অভিযোগ দিয়ে গঠিত।” তিনি যোগ করেছেন, “এটির কোনো ভিত্তি নেই বললেই চলে। এটি সক্রিয় কর্মী, প্রশাসনের সমালোচক এবং সাংবাদিকদেরও হেয় প্রতিপন্ন করে। এবং ঘৃণাত্মক বক্তৃতার মতো এটি হুমকি, হয়রানি কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি গ্রেপ্তার ও মৃত্যু পর্যন্ত ব্যবহার করে।”

কারাপাতান অনুসারে কমপক্ষে ৪২৭ জন সক্রিয় কর্মীকে নিহত হওয়ার আগে লাল চিহ্নিত করা হয়েছিল। শান্তি পরামর্শদাতা র‌্যান্ডাল একানিস এবং মানবাধিকার কর্মী জারা আলভারেজের কথাই ধরুন। তাদের দুজনই অন্তত ৬০০ জনের একটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল যাদের বিচার বিভাগ (ডিওজে) একটি আদালতকে ২০১৮ সালে “সন্ত্রাসী” ঘোষণা করতে বলেছিল। ডিওজে আবেদনটি শেষ পর্যন্ত বাতিল করা হলেও কারাপাতানের মতে ইকানিস, আলভারেজ এবং সেই তালিকার আরো পাঁচজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে একটি “সংঘর্ষে” নিহত হওয়ার আগে মিন্দানাওয়ের চাদ বুকের আদিবাসীদের শিক্ষককে লাল চিহ্নিত করা হয়েছিল।

লাল-চিহ্নিতকরণ নাগরিক সমাজের উপর একটি শীতল প্রভাব প্রয়োগ করে নাগরিক স্থান সঙ্কুচিত করছে। সশস্ত্র সংঘাতের প্রতিবেদন করায় এমনকি সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সংস্থাগুলোও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়ার অভিযোগ থেকে রেহাই পায়নি। এনটিএফ-ইএলসিএসি এবং এর প্রাক্তন কর্মকর্তারা এসএমএনআই টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ফিলিপাইনের জাতীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন (এনইউজেপি), ফিলিপাইনের বৈদেশিক সংবাদদাতা সমিতি (ফোক্যাপ) এবং অল্টারমিডিয়া জন গণমাধ্যম নেটওয়ার্কের সদস্যদের বারবার লাল-চিহ্নিত করেছে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়িত্ব কেন্দ্র (সিএমএফআর) এর যুক্তিতে লাল টোপ আরো বিপদ যুক্ত করেছে যা নিয়ে ফিলিপিনো সাংবাদিকরা হিমশিম খাচ্ছে। গোষ্ঠীটি আরো বলেছে “সত্য কথন এবং গণতান্ত্রিক আলোচনার জন্যে অত্যাবশ্যক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চর্চার উপর লাল-চিহ্নিতকরণ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে।”

লাল-চিহ্নিত সাংবাদিক ফ্রেঞ্চি মে কাম্পিওকে ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ তারিখে অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক রাখার মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি টাক্লোবান নগর কারাগারে আটক রয়েছেন এবং পরবর্তীকালে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের আর অভিযোগ আনা হয়। আরেক সাংবাদিক নর্দার্ন ডিসপ্যাচের কিম্বার্লি এনগাবিট-কুইটাসোলকেও লাল-চিহ্নিত করে সাইবার মানহানির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। ভাগ্যবশত দুই বছর পর তার ও অন্য এক সহকর্মীর বিরুদ্ধে প্রাক্তন আঞ্চলিক পুলিশ প্রধানের করা মামলাটি প্রমাণের অভাবে খারিজ হয়ে যায়।

লাল-চিহ্নিত অনেক সাংবাদিককে নিরাপত্তা্র জন্যে স্থানান্তরিত হতে হয়েছে, যা তাদের মূল্যবান কাজকে প্রভাবিত করেছে।

বুলাতলাত ও পিনয় সাপ্তাহিকের মতো লাল-চিহ্নিত গণমাধ্যম সংস্থাসহ ২০টিরও বেশি ওয়েবসাইটকে “সন্ত্রাস-বান্ধব” হওয়ার অভিযোগে জাতীয় টেলিযোগযোগ কমিশন (এনটিসি) অবরোধের নির্দেশ দিয়েছে। তারপর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হারমোজেনেস এসপেরন জুনিয়র সিপিপি, এনপিএ, এনডিএফপি এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের কথিত নেতাদের অবরোধকে ন্যায্যতা দিতে মনোনীত সন্ত্রাসবিরোধী পর্ষদের (এটিসি) প্রস্তাবগুলিকে উদ্ধৃত করেছেন। সিপিপি অবশ্য বলেছে সেন্সর করা ওয়েবসাইটের তালিকায় মাত্র সাতটি সিপিপির সাথে যুক্ত

সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি ২০২০ সালে কার্যকর হওয়ার পর থেকে অন্যান্যদের মধ্যে লাল-চিহ্নযুক্ত ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলি নজরদারি, সম্পদ ক্রোক ও চলাচলে বিধিনিষেধের ঝুঁকির সম্মুখীন। আইনটিতে নিবর্তনমূলক বিধান রয়েছে যাকে মানবাধিকার রক্ষাকারীরা ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

ফিলিপাইনের উপর সার্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনার সম্প্রতি সমাপ্ত চতুর্থ চক্রে বিচার সচিব জেসাস ক্রিস্পিন রেমুলা লাল-চিহ্নিতকরণকে ন্যায্যতা দিয়েছেন “গণতন্ত্রের অংশ” হিসেবে। জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সদস্য রাষ্ট্র এতে আশ্বস্ত না হয়ে এই চর্চা বন্ধের জন্যে ফিলিপাইন সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি পর্যালোচনা করতে বলেছে। রেমুল্লা “পরিবেশগত অধিকার রক্ষাকারী, আইনজীবী ও আইনী পেশার অন্যান্য চর্চাকারী এবং গণমাধ্যমসহ মানবাধিকার রক্ষাকারীদের আক্রমণ, হয়রানি বা ভয় দেখানোর জন্যে কোনো রাষ্ট্রীয় নীতি নেই” বলে দাবি করলেও বিতর্কিত টাস্ক ফোর্সের ক্রমাগত অর্থায়ন স্পষ্টভাবে বিপরীত কথাই বলছে।

পরাধীনতা পর্যবেক্ষক থেকে আরো কিছুর জন্যে অনুগ্রহ করে প্রকল্প পৃষ্ঠা দেখুন।

 

 

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .