মিয়ানমারে ইন্টারনেটের স্বাধীনতা বরাবরই সীমাবদ্ধ হলেও এটি বিশেষ করে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে সামরিক জান্তার অং সান সু কি এবং গণতন্ত্রের জন্যে জাতীয় লীগ (এনএলডি) পার্টির নেতৃত্বে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারকে জোর করে ক্ষমতাচ্যুত করা অভ্যুত্থানের পরে আরো খারাপ হয়েছে।
প্রতিবাদকারীদের উপর একটি নৃশংস দমন-পীড়ন এবং স্বৈরাচারী শাসন প্রতিরোধকারী আইন প্রণেতা, রাজনীতিবিদ, কর্মী, সাংবাদিক এবং বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়। উপরন্তু, সামরিক জান্তা সামরিক নিরাপত্তা বাহিনী সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলিকে ঢাকতে, অভ্যুত্থান বিরোধী প্রতিরোধকে দমন করতে এবং সামরিক শাসনকে বহাল রাখাতে গণমাধ্যম এবং ইন্টারনেট স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন ও সীমাবদ্ধ করতে নানা ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করে। ফলে প্রতিবাদ সংগঠিত করার আরো নিরাপদ উপায় হিসেবে বেশিরভাগ সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারী টেলিগ্রাম, সিগন্যাল এবং ভাইবারের মতো সংকেতায়িত বার্তা অ্যাপের দিকে ঝুঁকছে; বিশেষ করে সামরিক বাহিনী বেশিরভাগ সংবাদ ওয়েবসাইট অবরুদ্ধ করা এবং জান্তা-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সামরিকপন্থী প্রচার, বানোয়াট খবর এবং ভুল তথ্যে ভরে ওঠার পরে মঞ্চগুলি বিপ্লব সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য সংবাদ ও তথ্যের উৎস হিসেবে কাজ করতে শুরু করে।
সামাজিক গণমাধ্যমের ভূমিকা
২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচ্নের ফলাফল প্রভাবিত করার জন্যে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের আগে থেকেই সামরিক সমর্থক দেন-দরবারকারী ও বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীরা সামাজিক গণমাধ্যম নেটওয়ার্ক, বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে সামরিক সমর্থক প্রচারণা, বিভ্রান্তি, অং সান সু চি এবং এনএলডি প্রশাসনের বিরুদ্ধে গুজব ছড়াতে এবং মুসলমান ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়াচ্ছিল। ফলে সম্প্রদায়ের মান লঙ্ঘনের জন্যে সহিংসতা উস্কে দেওয়া এবং গুজব ছড়ানো ফেসবুক পোস্ট এবং অ্যাকাউন্টগুলিকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সরিয়ে দেয়৷ সক্রিয়ভাবে সামরিকপন্থী প্রচারণা এবং নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কিত বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং এমনকি একটি ভূমিধ্বস নির্বাচনে .অং সান সুচির এনএলডি পার্টি দ্বিতীয়বার জয়ী হওয়ার পর ক্ষমতা দখল করার জন্যে সামরিক বাহিনীকে অনুরোধ করা কুখ্যাত সামাজিক গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের মধ্যে হান নিয়েন ওও, কিয়াও সোয়ার, এবং থাজিন ওও রয়েছে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে এই বিশিষ্ট সামরিক সমর্থক সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীরা সামরিক জান্তাকে সামরিক শাসনকে অস্বীকার করে নীরব প্রতিবাদসহ বিভিন্ন ধরনের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সক্রিয় কর্মী, রাজনীতিবিদ, প্রতিবাদকারী, প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্য, পরিচিত মুখ ও ব্যবসায়ী এবং সামরিকদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি), পিদাউংসু হ্লুত্তাও প্রতিধিত্বকারী কমিটি (সিআরপিএইচ) এবং জনসুরক্ষা বাহিনী (পিডিএফ) সমর্থকদের শিকার করতে সাহায্য করে যাচ্ছে। ফেসবুকে নিষিদ্ধ হওয়ার পর এই সামাজিক গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বরা ডিজিটাল পরিমণ্ডলে লোকেদের নজরদারি করতে এবং সামরিক বাহিনীকে সরেজমিন প্রতিরোধের নৃশংস দমনে সহায়তা করতে অন্যান্য সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ এবং টেলিগ্রাম, ভাইবার ও ভিকে এর মতো বার্তা গ্রুপগুলিতে স্থানান্তরিত হয়।
টেলিগ্রামে ফিরে যাওয়া
২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত টেলিগ্রাম চ্যানেল হান নাইয়েন ওও এর ৭৩,২৩৮ জন গ্রাহক, কিয়াও সোয়ার চ্যানেলের ৬৮,৬৬৮ জন সদস্য এবং থাজিন ওও চ্যানেলের ২৩,১৭৪ জন গ্রাহক রয়েছে। কিয়াও সোয়ার এবং থাজিন ওও চ্যানেল সামরিকপন্থী প্রচারের খবর এবং এনইউজি/পিডিএফ-বিরোধী আখ্যানে মনোযোগ দিলেও নিয়মিতভাবে হান নাইয়েন ওও চ্যানেল অবস্থানসহ সামরিকবিরোধী বার্তা ভাগাভাগি করা বা প্রতিরোধ বাহিনী সমর্থকদের নাম, ঠিকানা এবং ফেসবুক প্রোফাইল ও ব্যক্তিগত বিবরণ পোস্ট করে। এই টেলিগ্রাম বার্তা গ্রুপগুলিতে সামরিকপন্থী লোকেরা সামরিক কর্তৃপক্ষকে আটক ও কারারুদ্ধ, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং নাগরিকত্ব ও ভ্রমণের নথি বাতিল করা, এমনকি বন্দী এবং বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছে। অনেক লোকের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া সত্ত্বেও চ্যানেলে এই লোকেদের নেতৃত্বে প্রচারণা বন্ধ করতে না পারা এবং তাদের অ্যাপে নিরবচ্ছিন্ন অ্যাক্সেস দেওয়ার জন্যে রাজনৈতিক কর্মীরা টেলিগ্রামের সমালোচনা করছে।
ভাইবার গ্রুপে হান নাইয়েন ওও পোস্ট করেছে, “সময়মত রিপোর্ট করা আমাদের কর্তব্য এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ‘শ্বে বা’ [সামরিক বাহিনীর] কর্তব্য।” এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে যেখানে রাজনৈতিক কর্মী, সেলিব্রেটি এবং এমনকি সাধারণ লোকজনকে সামরিক নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেপ্তার এবং এই বার্তা গ্রুপগুলিতে তাদের তথ্য ও অবস্থান ভাগাভাগি করার পরেই কর্তৃপক্ষ তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে।
ভিন্নমতাবলম্বীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া
বর্মী আন্তর্জাতিক সংবাদ জানিয়েছে ২০২২ সালের ২৫ মার্চ রাতে মিয়ানমারের প্রায় ৫০ জন সেনা সদস্য ও পুলিশ শান রাজ্যের তাউংগি শহরে ডিএনএনএ নামে একটি বেসরকারি স্কুলে অভিযান চালিয়ে জান্তাবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ গ্রুপ (পিডিএফ) সমর্থন করার অভিযোগে প্রধান শিক্ষক এবং অন্য সাতজন নারীকে গ্রেপ্তার করে। হান নাইয়েন ওও চ্যানেল ডিএনএনএ স্কুলের প্রধান শিক্ষক অনুদান সংগ্রহ করে প্রতিরোধ বাহিনীকে সমর্থন করছে বলে অনুমানে পরে ঘটনাটি ঘটে। চ্যানেলটিতে বিবরণ পোস্ট করার পরপরই স্কুলের শিক্ষকরা আত্মগোপনে চলে গেলেও পরে একজন সামরিক চর সামরিক বাহিনীর কাছে তাদের অবস্থান প্রকাশ করে দিলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। একইভাবে ২০২২ সালের মে মাসে বিপ্লব সম্পর্কিত পরিস্থিতি হালনাগাদ এবং অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর ছবি তুলে ভাগাভাগি করার জন্যে ইয়াঙ্গুনের একজন পুলিশ সেকেন্ড লেফটেন্যান্টকে গ্রেপ্তারের রিপোর্ট করা হয়। তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির দমনমূলক ধারা ৫০৫(ক) এর আওতায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে এবং দোষী প্রমাণিত হলে তিন বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। হান নাইয়েন ওও টেলিগ্রাম চ্যানেলে তার বিশদ বিবরণ এবং জান্তা বিরোধী ফেসবুক পোস্টগুলি উন্মোচিত হওয়ার পরে এই গ্রেপ্তারটি চালানো হয়।
২০২২ সালের ২৫ জুলাই তারিখে এনএলডি প্রশাসনের প্রাক্তন সংসদ সদস্য ফিও জায়ার থাও এবং বিশিষ্ট গণতন্ত্র কর্মী কিয়াও মিন থুসহ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চারজন রাজনৈতিক বন্দীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। জান্তার চার গণতন্ত্রপন্থী সমর্থকের মৃত্যুদণ্ডের খবরে ক্ষুব্ধ ও বিধ্বস্ত, মিয়ানমারের সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারকারীরা শোক এবং সেনাবাহিনীর নৃশংস শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সাহসী প্রতিরোধের প্রকাশ হিসেবে তাদের ফেসবুক প্রোফাইল ছবিগুলিকে কালো বা লালে পরিবর্তন করে। এই প্রেক্ষাপটে হান নাইয়েন ওও এবং অন্যান্য সামরিকপন্থী টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলি কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করতে ফেসবুক প্রোফাইল ছবিগুলিকে কালো বা লালে পরিণত করা সেলিব্রিটি ও সাধারণ নাগরিকদের ফেসবুক প্রোফাইল, অবস্থান এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্যের পর্দাছবি পোস্ট করে তাদের গ্রেপ্তারের প্রচারণা শুরু করে। জনসমালোচনার পরে ক্ষতিকারক এই টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলি সরানোর কিছুক্ষণ পরেই সামরিক সমর্থক গোষ্ঠীগুলির একই নামে নতুন টেলিগ্রাম চ্যানেল পুনরায় তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ফেসবুকের কঠোর বিধিনিষেধ সত্ত্বেও সামরিকপন্থী দেন-দরবারকারী অন্তর্গত বলে মনে হওয়া হান নাইন ওও এবং কিয়াও সোয়ার নামে সেই ফেসবুক প্রোফাইলগুলিই আবার পুনরুত্থিত হচ্ছে।
ডিজিটাল পরিমণ্ডলে পুলিশের সাইবার নিরাপত্তা ইউনিট, তথ্যদাতা এবং অন্যান্য সামরিক সমর্থকদের সামরিকবিরোধী ভিন্নমতাবলম্বীদের নজরদারির পাশাপাশি সাম্প্রতিক মাসগুলিতে সামাজিক গণমাধ্যমের বিষয়বস্তু অথবা কখনো কখনো শুধু কর্তৃপক্ষ নিষিদ্ধ সামাজিক গণমাধ্যম অ্যাপ এবং ভিপিএন ইনস্টল করার জন্যে জন্যে হয়রানি, চাঁদাবাজি বা গ্রেপ্তারের শিকার হওয়া চেকপয়েন্টগুলিতে নিরাপত্তা বাহিনী মুঠোফোনের তল্লাশি এবং নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারে ইন্টারনেট স্বাধীনতার অবনতি অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সালের ৭ জুন তারিখে সামরিক জান্তার একটি অপেক্ষাকৃত কঠোর এবং অস্পষ্ট সাইবার অপরাধ আইন, ইন্টারনেটে প্রবেশে আরো নিষেধাজ্ঞা, ইন্টারনেট বন্ধ, অনলাইন সেন্সর এবং ডিজিটাল নজরদারির মাধ্যমে মিয়ানমারে “ডিজিটাল একনায়কতন্ত্র” প্রতিষ্ঠার চেষ্টার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এছাড়াও বিশেষজ্ঞরা জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে অনলাইন এবং অফলাইনে মৌলিক স্বাধীনতা খর্ব করার জন্যে জান্তার নীতির নিন্দা করার এবং সামরিক জান্তার কাছে দ্বৈত-ব্যবহারের নজরদারি প্রযুক্তি বিক্রি বা সরবরাহকে সীমাবদ্ধ করার নিষেধাজ্ঞা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৪৮ সালের পরে মিয়ানমার বিষয়ে প্রথম প্রস্তাব পাস করেছে।
পরাধীনতা পর্যবেক্ষক থেকে আরো কিছুর জন্যে অনুগ্রহ করে প্রকল্প পৃষ্ঠা দেখুন।