বুল্লি বাঈ এবং সুল্লি লেনদেন কাণ্ড ভারতে ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক নারীবিদ্বেষকে প্রতিফলিত করে

Image via Pxhere. CC0 - Public domain.

পিএক্সহেয়ার. সিসি ০ – প্রকাশ্য ডোমেইনের মাধ্যমে পাওয়া চিত্র।

ভারতের শতাধিক মুসলমান নারী ১ জানুয়ারি, ২০২২ তারিখ সকালে উঠে দেখে একটি অ্যাপে তাদের নিলামে তোলা হয়েছে। নারীদের মধ্যে সামাজিক গণমাধ্যমে সুপরিচিত আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক, কর্মী এবং সামাজিক কর্মীরা রয়েছেন ৷ তাদের ছবি ও ভাবমূর্তি অশ্লীলভাবে সম্পাদনা করে নারীদের বিক্রি করা হয় বলে দাবি করা একটি ওয়েবসাইটে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

দ্য ওয়্যারের সাংবাদিক ইসমত আরা ১ জানুয়ারি টুইট করেন:

একজন মুসলমান নারী হিসেবে ভয় ও বিরক্তির অনুভূতি নিয়ে আপনার নতুন বছর শুরু করাটা খুবই দুঃখজনক। অবশ্যই এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে #সুল্লি_লেনদেনের এই নতুন সংস্করণে শুধু আমিই লক্ষ্যবস্তু নই। আজ সকালে বন্ধুর পাঠানো পর্দাছবি।

শুভ নব বর্ষ।

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বুল্লি বাঈ অ্যাপ মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নীরজ বিষ্ণয়, শ্বেতা সিং, বিশাল কুমার ঝা এবং মায়াঙ্ক রাওয়ালকে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের চারজনই ছাত্র। পুলিশের সূত্র আরো উল্লেখ করেছে যে চারজন অপরাধী ইচ্ছাকৃতভাবে অ্যাপ নির্মাতাদের পরিচয় সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্ত এবং সম্ভবত শিখ সম্প্রদায়কে কালিমালিপ্ত করার জন্যে অনলাইন মঞ্চে অ্যাপটি ভাগাভাগি করার সময় শিখ ছদ্মনাম ব্যবহার করে।

ভারতে মুসলমান নারীদের অনলাইনে নিলামে তোলার এমন ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০২১ সালের জুলাই মাসে “সুল্লি লেনদেন” নামে একটি অ্যাপ ৮০ জনেরও বেশি ভারতীয় মুসলমান নারীর ছবি ও সামাজিক গণমাধ্যমের প্রোফাইল ভাগাভাগি করে জাতীয় শিরোনাম তৈরি করে। গিটহাব মঞ্চে হোস্ট করা মুক্ত-উৎস অ্যাপটি “দৈনিক লেনদেন” অভিহিত করে মুসলমান নারীদের প্রোফাইলগুলিকে “বিক্রির জন্যে” হিসেবে প্রদর্শন করে। অ্যাপের তথ্যে বলা হয়েছিল ব্যবহারকারীরা মঞ্চটির মাধ্যমে “একজন শ্যালিকা দাবি” করতে পারে। অভিযোগের পর গিটহাব অ্যাপটি নামিয়ে ফেলে

বুল্লি বাঈ অ্যাপ ব্যপারটি কী?

বুল্লি বাঈ অ্যাপটি তার পূর্বসূরীর মতো একই রকম ডিজাইন ও প্যাটার্ন এবং একই ধরনের প্রোফাইলের নারীদের অর্থাৎ সুপরিচিত নারী মুসলমান সাংবাদিক, লেখক, সক্রিয় কর্মী এদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এটাও গিটহাবে হোস্ট করা এবং এতে ১০০ জনেরও বেশি ভারতীয় মুসলমান নারীর ছবি ও প্রোফাইল রয়েছে। “সুল্লি” এবং “বুল্লি” উভয়ই ইচ্ছাকৃতভাবে অপদস্থ করার সময় মুসলমান নারীদের বোঝাতে ভারতের ডানপন্থীদের ব্যবহার করা কলঙ্কজনক ও অবমাননাকর শব্দ। উভয় শব্দটিই মুসলমান নারীদের বোঝাতে ব্যবহৃত একটি হিন্দি গালি “মুল্লি” শব্দের বিকৃতরূপ। পরবর্তী অ্যাপটির একমাত্র পার্থক্য হল এটিতে মুসলমান নারীদের দাসী (হিন্দিতে “বাঈ” শব্দের অর্থ দাসী) হিসেবে নিলাম করা হয়েছে। বিক্রির কোনো প্রকৃত উদ্দেশ্য ছাড়াই অ্যাপটি শুধুমাত্র মুসলমান নারীদের হেয়, অপমান ও হয়রানি করার জন্যে তৈরি করা হয়।

ধর্ম এবং লিঙ্গ ছাড়াও বেশিরভাগ ভুক্তভোগীকে একটি সাধারণ সূত্র একসাথে যুক্ত করেছে তা হলো তাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এর নেতৃত্ব প্রদানকারী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্দেশনায় বেড়ে ওঠা ভারতের অসহিষ্ণুতা, ইসলাম আতঙ্ক এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের উচ্চকিত সমালোচক ছিলেন। হিন্দুত্ব বা হিন্দু জাতীয়তাবাদ হলো এমন একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ যা ভারতীয় শাসন, সংস্কৃতি এবং আইনকে হিন্দু ধর্মীয় মূল্যবোধভিত্তিক আকৃতি প্রদান নিশ্চিত করতে চায়।

অ্যাপটির সাথে যুক্ত গ্রেপ্তারকৃত চারজন ব্যক্তিই ছাত্র যা থেকে বোঝা যায় সাম্প্রদায়িকতা এবং দুর্বৃত্তায়নের ধারণাগুলি ভারতীয় সমাজে কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে।

গোষ্ঠীটির “হোতা, নীরজ বিষ্ণোই, ২১, ভেলোর প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এবং একজন পুনরাবৃত্ত অপরাধী যার বিরুদ্ধে লোকেদের হয়রানি করা, ছবিতে বিরূপ মন্তব্য করা এবং অনলাইনে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে৷ অপর এক সহ-ষড়যন্ত্রকারী শ্বেতা সিং, ১৯, জঘন্য টুইট ভাগাভাগি এবং অনলাইনে আপত্তিকর ছবি ও মন্তব্য পোস্ট করার জন্যে ভুয়া টুইটার হ্যান্ডেল ব্যবহার করতো। অন্য দুই ২১ বছর বয়সী প্রকৌশল ছাত্র বিশাল কুমার ঝা এবং স্নাতক ছাত্র মায়াঙ্ক রাওয়াত এর প্রত্যেকেই অ্যাপ থেকে সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চে স্ক্রিনশট ভাগাভাগি করতো।

বুল্লি অ্যাপ মামলার সময় প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে ঘটনাটি প্রকাশের ছয় মাস পরে পুলিশ শ্যালিকা চুক্তি (Sulli Deals) অ্যাপের নির্মাতাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। ৯ জানুয়ারি দিল্লি পুলিশ ইন্দোর থেকে অমকারেশ্বর ঠাকুর (২৬)-কে গ্রেপ্তার করে।

কেন এই ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ?

শূন্য থেকে বুল্লি বাঈ অ্যাপ মামলাটির উদ্ভব ঘটেনি। ভারতে মুসলমানদের উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের পটভূমিতে এটি তৈরি হয়েছে। ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার মধ্যে হত্যা; মসজিদ এবং ঘরবাড়ি ধ্বংস; মুসলমান কৌতুকাভিনেতা, অভিনেতা ও পরিচালকদের উপর আক্রমণ; এবং মুসলমান সক্রীয় কর্মী, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার রক্ষকদের কারাবাসও রয়েছে। আক্রমণ পরিচালনাকারী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী ও সংগঠনগুলি সম্পূর্ণ দায়মুক্তি এবং নেতৃস্থানীয় ডানপন্থী বিজেপির সদস্যদের কাছ থেকে সমর্থন পাচ্ছে।

তবে বুল্লি বাঈ ঘটনাটি ঘৃণার দুটি ধারা: সাম্প্রদায়িকতা এবং বিদ্বেষকে একত্রিত করেছে। অ্যাপটি মুসলমান নারীদের অবমাননা করতে এবং তাদের কন্ঠস্বর স্তব্ধ করার জন্যে তৈরি করা হয়েছে। সামাজিক গণমাধ্যম মঞ্চ থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে এটা করা হয়েছে। শ্যালিকা চুক্তি এবং বুল্লি বাঈ মামলাগুলি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয় বরং মতামত প্রকাশের জন্যে মুসলমান নারীদের অনলাইন হয়রানির একটি বৃহত্তর প্যাটার্নের অংশ যেখানে বিভিন্ন অপদস্থকারী গোষ্ঠী এবং মেমে পাতা তাদের নিয়মিত উপহাস, হয়রানি এবং হুমকি প্রদান করে থাকে।

অতিমারী কোভিড-১৯ এবং লকডাউনগুলি ব্যক্তিগত জমায়েত বন্ধ করে দেওয়ায় আজকাল সামাজিক গণমাধ্যমই আলোচনা, ভিন্নমত এবং সামাজিক-রাজনৈতিক সমাবেশের অনেকটা একমাত্র স্থানে পরিণত হয়েছে। এসবের পরও বিশেষ করে প্রান্তিক পরিচয়ের নারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনলাইন ট্রোলিং, হয়রানি, ভিন্নমতের কণ্ঠের বিরুদ্ধে আক্রমণের উপস্থিতি এটা নিশ্চিত করে যে এই ডিজিটাল স্থানগুলি অনেকের কাছেই অনিরাপদ এবং প্রবেশযোগ্য নয়৷

ভারতের গণমাধ্যম প্রতিবেশের প্রতিক্রিয়া

এই মামলার খবরে ভারতের গণমাধ্যম পরিমণ্ডল আলোড়িত হয়েছে। মাক্তুব মিডিয়ার মতো অনেক সম্পাদকীয় গণমাধ্যম চ্যানেল পূর্বের সুল্লি লেনদেন ঘটনায় পুলিশ ও সরকারের নিষ্ক্রিয়তার এবং দেশে মুসলমান সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অপরাধের বিষয়ে তাদের বৃহত্তর নীরবতার সমালোচনা করে ঘটনাটির নিন্দা করলেও, অন্যেরা ইচ্ছাকৃতভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। ডানপন্থী সংবাদ সংস্থা ওপইন্ডিয়া বুল্লি বাঈ অ্যাপের পিছনে “খালিস্তানি সমর্থকরা” রয়েছে এমন দাবি করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। খালিস্তান আন্দোলন শিখদের জন্যে একটি পৃথক আবাসভূমি তৈরির দাবি করা একটি রাজনৈতিক আন্দোলন।

ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী পাতা এবং তাদের সমর্থকরা দাবি করেছে যে অপরাধীরা খালিস্তানি শিখ অথবা মুসলমান জনগণ। তদন্তের মাধ্যমে সেই দাবিটি ভুল প্রমাণিত হওয়ার পর থেকে উভয় ঘটনার ক্ষেত্রেই অভিযুক্তদের রক্ষাকারী এবং ঘটনার তীব্রতা কমিয়ে আনা পোস্টের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

এরকম একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো একজন ব্যবহারকারীর এই টুইটটি , যার অনুসরণকারীর সংখ্যা ১৩ লক্ষ। পরে টুইটটি মুছে ফেলা হয়।

Gabbar SIngh Tweet

মজার বিষয় হলো ইন্টারনেটে ১৯-২১ বছর বয়সী মূর্খ ছাত্রদের সংঘটিত অপরাধ সরেজমিন কোন সাংগঠনিক সমর্থন ছাড়াই জাতীয় সঙ্কট হিসাবে বিবেচিত হয় এবং নিউইয়র্ক টাইমসের মতো বিদেশী প্রকাশনা সংস্থা তা নজরে নিয়ে সতর্ক সংকেত বাজায়।

হিন্দু অপরাধীদের গণপ্রতিরক্ষা এবং অপরাধী যুবকদের প্রতি বৃহত্তর সহানুভূতির চিত্রটি ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের সক্রিয় অপমান করার সম্পূর্ণ বিপরীত – যেখানে তাদের মতামত প্রকাশের জন্যে আক্রমণ এবং হুমকির সম্মুখীন হতে হয়।

সামাজিক গণমাধ্যমের পোস্টগুলিও পাল্টা অভিযোগে জড়িত হয়ে মামলা থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করে।

ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও অর্থ কমিটির সভাপতি রইস পাঠান হিন্দু নারীদের বিরুদ্ধে হয়রানির উদাহরণের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বুল্লি বাঈ অপরাধ থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা করেছেন৷ তিনি টুইট করেন:

আমি পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলমান বেশ কয়েকটি ইনস্টাগ্রাম এবং ফেবু পাতা দেখেছি যেখানে তারা অবমাননা করার জন্যে হিন্দু মেয়েদের এবং দেবদেবীর ছবি রূপান্তর করে থাকে।

এধরনের অধঃপতন এবং #BulliDeals উভয়ই ঘৃণ্য। আমি দু’টোর বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ করি। কিন্তু প্রগতিশীলরা শুধু শেষোক্ত বিষয়টি কথা বলে, কারণ তারা কারো প্রতিই যত্নশীল নয়।

ভারতের গণমাধ্যম প্রতিবেশের বৃহত্তর আখ্যানটি শিকার এবং অপরাধীর পরিচয় কীভাবে অপরাধের তীব্রতা নির্ণয় করে শুধুমাত্র সেটাই তুলে ধরে।

এই গল্পটি ভারতের গণমাধ্যম প্রতিবেশের উপর নাগরিক গণমাধ্যম মানমন্দিরের গবেষণার অংশ। এই প্রকল্প এবং এর পদ্ধতি সম্পর্কে আরো জানতে এখানে ক্লিক করুন

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .