মিয়ানমারের বিপ্লবী কবিদের দীর্ঘ ইতিহাস

মিয়ানমারে ১ ফেব্রুয়ারির অভ্যুত্থানের পর থেকে সামরিক শাসনে নিহত কবিরা হলেন – বাম থেকে ডানে: কে জা উইন, কি লিন আই, খেত থি। ইরাবতী ওয়েবসাইটের ছবি, অনুমতিসহ ব্যবহৃত।

এই নিবন্ধটি প্রথমে মিয়ানমারের একটি স্বাধীন সংবাদ ওয়েবসাইট দ্য ইরাবতীতে প্রকাশিত হয়। পরে একটি বিষয়বস্তু ভাগ করে নেওয়ার চুক্তির অংশ হিসাবে এটি গ্লোবাল ভয়েসেসে সম্পাদিত ও পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

৮ মে সন্ধ্যায় সামরিক জান্তার প্রায় ১০০ জনের বাহিনী কবি খেত থিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পরের দিন তিনি মারা যান। তার স্ত্রী মনিওয়া হাসপাতাল থেকে তার দেহ সংগ্রহের জন্যে কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন বলে জানা গেছে; তার শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ময়নাতদন্তের জন্যে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।

৪৫ বছর বয়সী এই কবিকে বিস্ফোরক রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলেও তার বাড়িতে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি মাত্র দু'মাসের মধ্যে সাগাইং অঞ্চলের মনিওয়াতে জান্তা বাহিনীর হাতে নিহত তৃতীয় কবি। মার্চ মাসে দমনাভিযানের সময় কবি কে জা উইন, ৩৯, এবং কি লি লিন আইকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।

সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যে গঠিত জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) কবি থেকে পরিবর্তিত প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউ ইয়ে সোম তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন:

মনিওয়ার দুই কবি খেত থি এবং কে জে উইন মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি দুঃখিত। আমরা জেতা না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করতে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সামরিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশকারী আইয়াওয়াদির পাথেইন এবং তানিনথায়ির মাইয়িসহ এক ডজনেরও বেশি কবিকে ইয়াঙ্গুনে আটক করা হয়েছে।

মায়ানমারের বিপ্লবের দীর্ঘ ইতিহাসে কবিরা তাদের শিল্পের শক্তি দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

মায়ানমারের সর্বশেষ সম্রাট রাজা থিব্বকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানোর পরে সায়া পে, সেবুনি সায়াডাও, ইউ কিওয়াত এবং মুনঘাটং ইউ কিউ হ্লাসহ রাজকীয় রাজধানী মান্দালয় থেকে প্রখ্যাত কবিরা জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের প্রচারণার জন্যে কবিতা লিখেছেন। কলম দিয়ে লড়াই যথেষ্ট মনে না করা কবি সায়া পে তরবারি হাতে নিতে শান প্রদেশে গিয়ে তিনি সেখানে মারা যান। উপনিবেশবাদবিরোধী কবিতাগুলির জন্যে ঔপনিবেশিক শাসনে গ্রেপ্তারকৃত প্রথম কবিও ছিলেন মুনঘাটং ইউ কিউ হ্লা।

মং লুন নামেও পরিচিত ঔপনিবেশিক আমলের সর্বাধিক বিখ্যাত জাতীয় কবি ছিলেন থাখিন কোডাও হ্মাইং বলেছেন তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্যে কবিতা দিয়ে লড়াই করবেন। তার কলম মিয়ানমারের জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম জাগাতে শক্ত ভূমিকা রাখবে।

১৯৪১ সালে উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী এবং দোহ বামার আসিয়ায়ন (আমরা বর্মী সমিতি) এর পৃষ্ঠপোষক হিসাবে তার খ্যাতি তাকে “রাষ্ট্রের শত্রু” হিসেবে শাসক ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের “বার্মা তালিকায়” স্থান করে দিয়েছিল। গোষ্ঠীটি রাজনৈতিক সচেতনতা জাগ্রত করার সময়  জাতীয়তাবাদী উপাদান এবং সদ্য রাজনৈতিক আদর্শকে একত্রিত করে মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

স্বাধীনতার পরে ফ্যাসিবাদবিরোধী গণমুক্তি লীগ সরকারের সময়ে দাউং ন্বে সুই, নে থ্বায় নি, ময়ং ইয়িন মোনসহ আরো অনেক কবি ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকদের আন্দোলনকে সমর্থন করার পাশাপাশি তাদের যুদ্ধবিরোধী কবিতা ও আমলাদের সমালোচনামূলক ব্যঙ্গাত্মক সাহিত্যকর্মের জন্যে পরিচিত ছিলেন।

তবে ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখলের পরে নিবর্তনমূলক সেন্সর আরোপ করা হয়েছিল। স্বৈরশাসকের সমালোচনা করে লেখা মনে করা একটি কবিতা লেখার পরে কবি মিন ইউ ওয়াই-কে  সামরিক বাহিনী পরিচালিত মায়াওয়াদি ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক পদ থেকে বরখাস্ত হয়।

নে উইন ও তার স্ত্রী খিন মে থানকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কবিতা প্রকাশের জন্যে কবি উইন ল্যাট এবং জার্নাল পার্সপেক্টিভের সম্পাদক উইন খেতকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিটি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে অনেক কবিকে বার্মা সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি দলের (বিএসপিপি) শাসনামলে কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল।

১৯৭০ এর দশকে কোকো দ্বীপপুঞ্জে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় মান্দালয়ের কবি লে ময়ং অন্যান্য বন্দিদের সাথে অনশন করেছিলেন। তারা দ্বীপটির কারাগার বিলুপ্ত করার আহ্বান জানিয়ে একে বর্মী “শয়তানের দ্বীপ” হিসেবে অভিহিত করেছিল। ৫০ দিনেরও বেশি অনশন কর্মসূচি পালন শেষে তিনি কারাগারে মারা যান। কবিসহ অন্য আরো সাতজনের আত্মত্যাগের কারণে বিএসপিপি সমস্ত বন্দীদের ইয়াঙ্গুনের ইনসেইন কারাগারে স্থানান্তরিত করার ফলে এটি মিয়ানমারের সংশোধন ব্যবস্থার ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

কবিরা ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রপন্থী উত্থানে জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নে উইনের একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়েছিল। ১৯৮৮ সালের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ছাত্র নেতা ইউ মিন কো নাইংও একজন কবি ছিলেন।

পরবর্তীতে তারিয়ার মিন ওয়াই নামে একজন সর্বাধিক বিক্রেতা লেখক-কবিথয়ে ওঠা ছাত্রনেতা শোয়ে ফোন লু একটি কবিতায় বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর পুনরায় খুলে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা বর্জন করার কথা লিখেছিলেন। সেই কবিতার জন্যে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল সাও ময়ং এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সমালোচনা করা “কি হয়েছে?” ব্যঙ্গাত্মক কবিতার জন্যে ১৯৮৯ সালে বিখ্যাত লেখক মিন লু গ্রেপ্তার হয়েছিল। কবিতাটি একটি লক্ষ্যণীয় ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। তাকে এবং প্রকাশক উভয়কেই পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

১৯৯০ এর সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি জয়ের পরে দলের প্রচারে সক্রিয় অংশ নেওয়ার কারণে সামরিক শাসকগোষ্ঠী মিয়ানমারের নবম রাষ্ট্রপতির পিতা কবি মিন থু উন এবং গণতন্ত্রের জাতীয় লীগ (এনএলডি) সরকারের প্রথম রাষ্ট্রপতি ইউ হতিন কিউ এর কবিতা নিষিদ্ধ করে।

কবিতা লেখা এবং গণতন্ত্র নিয়ে সারাদেশে আলোচনা করার জন্যে এনএলডির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কবি টিন মোওকেও পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। মুক্তি পাওয়ার পরে তাকে নির্বাসনে বাধ্য করা হয়। ২০০৭ সালে তিনি বিদেশে মৃত্যুবরণ করেন।

২০০৮ সালে তৎকালীন একনায়ক সিনিয়র জেনারেল থান শোয়েকে উপহাস করার জন্যে কবি সাও ওয়াইকে তার ভ্যালেন্টাইনস ডে কবিতায় একটি সাংকেতিক বার্তাসহ গ্রেপ্তার হন। কবিতাটির প্রতিটি লাইনের প্রথম শব্দগুলি পড়েলে পাওয়া যায়, “পাওয়ার-ক্রেজড সিনর-জেন থান শোয়ে” (ক্ষমতা-উন্মত্ত জ্যেষ্ঠ্য-সেনাপতি থান শোয়ে)।

১৩৬ বছর আগে ১৮৮৫ সালে রাজা থিব্ব সিংহাসনচ্যুত হওয়ার পর থেকে ১ ফেব্রুয়ারি সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের ক্ষমতা দখলের এই বছরগুলোতে কবিরা সাধারণ মানুষের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে এবং মিয়ানমারের প্রতিটি বিপ্লবে প্রথম সারিতে থেকেছে। খেতে থির কবিতাটি তার সাক্ষ্য:

তারা মাথায় গুলি করে,

তারা কখনোই জানে না

বিপ্লব থাকে হৃদয়ের গভীরে।

 

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .