দায়মুক্তি বন্ধ কর, মত প্রকাশ স্বাধীন কর!

২ নভেম্বর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তির আন্তর্জাতিক দিবসটি পালন করা হচ্ছে। আইএফইএক্সের ছবি।

এই উপসম্পাদকীয়টি মত ও তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষা ও প্রচারের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক আইএফইএক্সর নির্বাহী পরিচালক অ্যানি গেম লিখেছেন। এটি গ্লোবাল ভয়েসেস এবং আইএফইএক্সের মধ্যে একটি অংশীদারিত্বের ব্যবস্থার মাধ্যমে পুনরায় প্রকাশ করা হয়। নিবন্ধটি প্রথমে এখানে প্রকাশিত হয়েছিল।

দায়মুক্তিবিহীন এমন একটি পৃথিবী কল্পনা করুন, যেখানে প্রত্যেকে নিজের মত প্রকাশের এবং তথ্যের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগ করতে এবং নির্ভয়ে তারা পছন্দ মতো যে কোনও উপায়ে তাদের ধারণা ও তথ্যে প্রবেশ, সেগুলো উৎপাদন ও ভাগাভাগি করতে পারবে, যেমন আমরা পারি।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তির এই আন্তর্জাতিক দিবসে মত প্রকাশের অধিকার এবং তথ্যের অধিকারের মধ্যে অপরিহার্য যোগসূত্রটির স্বীকৃত দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন একটি অধিকার যখন আক্রান্ত হয় তখন সাংবাদিকরা প্রায়শই সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন এবং শেষ পর্যন্ত আমরা সকলেই এর শিকারে পরিণত হই।

দুই সপ্তাহ আগে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৮ সেপ্টেম্বর তারিখকে তথ্যে সর্বজনীন প্রবেশাধিকারের আন্তর্জাতিক দিবস ঘোষণা করার পক্ষে মত দিয়েছে। আইএফইএক্স নেটওয়ার্কের অনেক আফ্রিকীয় সদস্যসহ অসংখ্য নাগরিক সমাজ গোষ্ঠীর টানা এক দশকের ধারাবাহিক প্রচারণার পরে এটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য বিজয়।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রচার ও রক্ষার সংগ্রামে আদৌ জড়িত না থাকা কিছু লোকও সম্ভবত জাতিসংঘের নতুন একটি দিবসের এই সংবাদকে অগত্যা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তবে তাদের আবারো ভেবে দেখা উচিত, কারণ আমাদের তথ্যের অধিকার আমাদের মত প্রকাশের অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং উভয়টিই দিনকে দিন বেশি বেশি আক্রমণের শিকার হচ্ছে।

সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ থেকে শুরু করে ইচ্ছাকৃত অপসংবাদ, সংবাদপত্রসমূহের ওপর প্রতিবন্ধকতা পর্যন্ত নানাভাবে তথ্যের হুমকি আসছে এবং এগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাবগুলো হলো জনগণকে তাদের যত্ন নেওয়া বিষয়গুলির সাথে জড়িত হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রাপ্তি থেকে বিরত, রাজনৈতিক মেরুকরণে উৎসাহিত এবং গণতন্ত্রকে ক্ষুন্ন করা।

চলুন, মত প্রকাশের শক্তি এবং এর তথ্যে প্রবেশে নির্ভরশীলতার একটি সাম্প্রতিক উচ্চমাত্রার উদাহরণ দেখা যাক।

গত মাসে জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটের প্রতিক্রিয়ায় আনুমানিক ৬০ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। তাদের বিক্ষোভের  সৃজনশীলতা রাস্তায় নামা অনেককে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে; কর্মের অভিব্যক্তি বাস্তবতার মাধ্যমে জোরালো হয়েছে। সুইডেনের জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থার্নবার্গ আমাদেরকে “বিজ্ঞানীদের কথা শোনার” অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমাদের যেসব কণ্ঠস্বর শোনা দরকার তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কী হবে?

সেন্সর করা অথবা অপতথ্যের সাগরে ডুবিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কণ্ঠস্বর নিঃশব্দ করা যায়। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে চুপ করিয়ে দেওয়ার উদাহরণই বেড়ে চলছে। পরিণতিহীন খুন। দায়মুক্তি দিয়ে খুন।

২০১৯ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত একটি বিস্তৃত সমীক্ষায় জানা গেছে যে গত ১৫ বছরে পরিবেশবাদী কর্মীদের হত্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এই ৯০% ক্ষেত্রে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি – এটি দায়মুক্তির অত্যন্ত বেদনাদায়ক একটি মাত্রা।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে আরেকটি আন্তর্জাতিক দিবস পালন করতে গিয়ে সেন্সর করার এই মারাত্মক রূপটি কখনো আমাদের চিন্তা থেকে বেশি দূরে থাকে না।

ইউনেস্কোর ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে এক হাজারেরও বেশি নিহত সাংবাদিকদের তালিকা একটি দুঃখজনক স্মৃতি। নারী সাংবাদিকদের প্রতি লিঙ্গ-নির্দিষ্ট আক্রমণ বৃদ্ধির সাথে সাথে নিহতদের মধ্যে নারীদের অনুপাতও বৃদ্ধি পেয়েছে

২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের জুন মাসের মধ্যে নিহত ২০৭ জন সাংবাদিকদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি সাংবাদিক সুসংগঠিত অপরাধ, স্থানীয় রাজনীতি এবং দুর্নীতি বিষয়ে প্রতিবেদন করছিলেন।

তাদের তথ্য ভাগাভাগি বন্ধ করার জন্যে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকার শেষ করে দেওয়ার হয়েছিল, চিরকালের জন্যে।

যতবারই এই ধরনের অপরাধ শাস্তি পায় না ততোবারই তা অন্যদের উৎসাহিত করে। যারা যথাযথভাবে জনস্বার্থে তথ্য ভাগ করে নেবেন তারা নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করবেন: এটার মূল্য কি আমার জীবন? এটার জন্যে কি আমার পরিবারকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারি? এবং তারা যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে এটা তা নয়, তাহলে কে তাদের দোষ দিতে পারে? দায়মুক্তির ধারাবাহিক প্রভাবগুলি অন্তহীন।

এ কারণেই আট বছরেরও বেশি সময় ধরে আইএফইএক্স নেটওয়ার্ক সাংবাদিক এবং তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার প্রয়োগকারী সকলের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে প্রচারণা চালিয়েছে।

দ্রুত সফলতা পাওয়া যায়, এমন কাজ এটি নয়। মত প্রকাশ একটি ম্যারাথনের মতো, এটা কোন দ্রুতগামী দৌড় নয়। অপরাধীদের খুঁজে বের করাতেই এই কাজ শেষ হয়ে যায় না; এই ধরনের অপরাধের বিকাশের পরিবেশের অনুমোদন বা উৎসাহ দেওয়ার জন্যে রাষ্ট্রসমূহকে দায়বদ্ধ করতে হবে।

আমরা প্রতিটি বড় এবং ছোট  জয়কে আলিঙ্গন করি। সুসংবাদটি হলো আইএফইএক্সে আমরা সৃজনশীল, সহযোগী এবং শক্তিশালী নতুন কৌশল এবং বাস্তব অগ্রগতি দেখছি।

গত ১২ মাসে আমরা গাম্বিয়ায় ২০০৪ সালে সাংবাদিক দেদা হায়দারা হত্যার ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে; আন্তঃ-আমেরিকান মানবাধিকার আদালতের একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ে ১৯৯৯ সালে নেলসন কারভজাল কার্ভাজল হত্যার ঘটনায় কলম্বিয়া সরকারকে দোষী সাব্যস্ত হতে;  এবং আন্তঃ-আমেরিকান কমিশনকে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে  ২০০০ সালের মে মাসে নির্মম হামলার মাধ্যমে প্রায় অনুসন্ধানী সাংবাদিক জিনেথ বেদোয়া লিমার জীবন নিয়ে নিতে যাওয়া ঘটনাটি আদালতে নিয়ে যেতে দেখেছি।

মাত্র দুই সপ্তাহ আগে আইএফইএক্স এবং এর স্থানীয় সদস্য গণমাধ্যম নীতি প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিক জনসমিতির ধারাবাহিক চাপের মুখে কিরগিজস্তান সরকারের সাংবাদিক আলিশার সাইপভ হত্যার ১২ বছরের পুরানো মামলার পুণরায় খোলার সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি।

ভেবে দেখুন, এই মামলাগুলি সম্মিলিতভাবে ৬৬ বছরের দায়মুক্তির প্রতিনিধিত্ব করছে।

সুতরাং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্যে দায়ী বা ভাবনা-চিন্তাকারীদের কান খুলে স্পষ্টভাবে শুনতে দিন: অনেকদিন পর বিশ্ববাসীর মনোযোগ সরে যাওয়ায় আপনারা হয়তো খুন করে যে পার পেয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন। না! আমরা যারা দায়মুক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তারা অবিচল। আমরা হাল ছাড়ি না। সুতরাং আপনি কখনোই সহজ বিশ্রাম নিতে পারবেন না।

আমাদের মতে, সাংবাদিকদের উপর হামলাকে ঘিরে দায়মুক্তির সংস্কৃতিটি বিশ্বব্যাপী মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যে একক বৃহত্তম হুমকির প্রতিনিধিত্ব করে। দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে আমরা যে অগ্রগতি অর্জন করেছি তা এর জন্যে লড়াকুদের সহনশীলতা, অধ্যবসায় এবং আত্মপ্রত্যয় ছাড়া কখনও সম্ভব হত না।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্যে আমাদের অবশ্যই এটিকে ব্যবহার করতে হবে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ এবং দায়মুক্তির অবসান ঘটাতে ডাক দেওয়ার জন্যেও আমাদের অবশ্যই এটিকে ব্যবহার করতে হবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .