আপনি যদি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স দেখে থাকেন, দেখবেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। ২০১৮ সালের ইনডেক্সে দেশটির অবস্থান ৪৮তম। যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে।
ক্ষমতায়নে এগিয়ে গেলেও নারীর সার্বিক অবস্থা ভালো নয়। ঘরে-বাইরে নারীরা প্রায়ই নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। দেশটির রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থা এখনো নারীকে একা একা বাইরে যেতে, সেটা কাজ হোক কিংবা নিছক ঘোরাঘুরি, তাতে অনুৎসাহিত করে। তবে এসবের মাঝেও একদল নারী মোটরসাইকেল চালিয়ে ইতোমধ্যে দেশের সবগুলো জেলা ঘুরে ফেলেছেন! আর এই উদ্যোগের পেছনে আছেন সাকিয়া হক ও মানসী সাহা। তারা দু’জনই পেশায় ডাক্তার। তারা দু’জনেই বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান মেডিক্যাল কলেজ হিসেবে পরিচিত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত আছেন।
সাকিয়া হক ও তার টিম ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে শুধু সারাদেশ ঘুরে বেড়াননি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, কৃষ্টি, কালচার, খাবার সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা নিতে নিতে গিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোর মেয়েদের স্কুলগুলোতেও। সেখানে গিয়ে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। কথা বলেছেন নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এখনো পিরিয়ড, প্রজনন স্বাস্থ্য’র বিষয়গুলো ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। স্কুলগুলোতে এ বিষয় নিয়ে তেমন একটা শিক্ষা দেয়া হয় না। তাছাড়া মেয়েরাও এ নিয়ে কথা বলতে চায় না। ফলে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভোগেন।
সারাদেশ ঘুরে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা আর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করার মূল ভাবনা সাকিয়া হকের হলেও, তার সাথে যোগ দিয়েছেন আরো বেশ কয়েকজন নারী। তাদের কার্যক্রমের একটা নামও দিয়েছেন- নারীর চোখে বাংলাদেশ। সাকিয়া হক নিজে ৬৪টি জেলা ঘুরলেও নারীর চোখে বাংলাদেশ টিম ৫৭টির মতো জেলা মোটরসাইকেল করে ভ্রমণ করেছেন। আগামী মাসের মধ্যে ৬৪টি জেলা ভ্রমণ করা হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন। আলাপচারিতায় ভ্রমণের পাশাপাশি রক্ষণশীল সমাজের তৈরি প্রতিবন্ধকতার বৃত্ত ভেঙে নারীদের জাগিয়ে তোলার গল্পের কথাও জানিয়েছেন।
নিজেদের ঘোরাঘুরির পাশাপাশি সাকিয়া হক ও তার বন্ধু মানসী সাহা মিলে নারীদের ভ্রমণে উৎসাহিত করার জন্য খুলেছেন ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ নামে একটি ফেইসবুক গ্রুপও। সেখানকার সদস্য সংখ্যা ২৮ হাজার পেরিয়ে গেছে। সদস্যদের নিয়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘুরে এসেছেন।
গ্লোবাল ভয়েসস বাংলা’র পক্ষ থেকে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম সাকিয়া হকের সাথে। ঘুরতে ঘুরতে নারীর ক্ষমতায়নের অভিজ্ঞতা ফেইসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে শেয়ার করেছেন তিনি।
গ্লোবাল ভয়েসস বাংলা: আপনি ইতোমধ্যে দেশের সবগুলো জেলা ভ্রমণ করেছেন। সারাদেশ ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে কীভাবে জন্ম নিলো। বাংলাদেশের মতো ধর্মীয় রক্ষণশীল দেশে, তাও আবার মোটরসাইকেল চালিয়ে!
সাকিয়া হক: ঘোরার ইচ্ছেটা ছোটবেলা থেকেই ছিল। কিন্তু তখন ঘোরার সুযোগ ছিল না। রক্ষণশীল পরিবারে একটা মেয়ে একা ঘুরতে যাবে, এটা মেনে নিতো না। তবে মেডিক্যাল কলেজে পড়তে এসে সেই সুযোগ হয়। আমি আসলে বাংলাদেশটাই আগে ঘুরে দেখতে চেয়েছি। বন্ধুরা গল্প করতো, অমুক দেশ অতো সুন্দর! কিন্তু আমি সেই সুন্দর দেশটা ঘোরার চেয়ে নিজের দেশ ঘুরে বেড়ানোর আগ্রহ বেশি পেতাম। বলতে গেলে মোটরসাইকেলে করে ৬৪টি জেলা ঘুরিনি। ৫৭টি জেলা ঘুরেছি। তিন পার্বত্য জেলাসহ বাকি জেলাগুলো বাসে করে ঘুরতে হয়েছে।
দেশের বাইরে গিয়ে দেখেছি, মেয়েরা স্কুটিতে করে স্কুলে যাচ্ছে, অফিস করছে। অথচ আমাদের দেশে মেয়েদের সাইকেল চালানোটাকেও অন্যভাবে দেখা যায়। তাই, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মোটরসাইকেলে করেই সারাদেশ ঘুরবো।
গ্লোবাল ভয়েসস বাংলা: দেশে পর্যটন বাড়ছে। নারীরাও ঘুরে দেখছেন বাংলাদেশ। সারাদেশ ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে একটু বলবেন, নারী ভ্রমণকারীদের জন্য বাংলাদেশ কতোটা নিরাপদ?
সাকিয়া হক: আমি বলবো না, নারী ভ্রমণকারীর জন্য বাংলাদেশ পুরোপুরি নিরাপদ। যেকোনো নারী হুট করে যেকোনো জায়গায় যেতে পারবে। দেশের এমন অনেক এলাকা আছে, যেটা রক্ষণশীল। একটা মেয়ে ভ্রমণ করতে গেছে, সেটা তারা মেনে নিতে চায় না। কিন্তু সে যদি একটু সতর্ক থাকে, সেখানকার কারো সাথে যোগাযোগ করে যায়, তাহলে তার জন্য নিরাপদ এবং ভ্রমণ করাটা সহজ হয়ে যায়। আমার নিজের কথা বলি। আমি মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় থেকে ভ্রমণ করি। তখন কোথাও গেলে মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলগুলোতে থাকতাম। আর এখন সরকারি সার্কিট হাউজ বেছে নিই। একজন নারী ভ্রমণকারীর জন্য সরকারি জায়গায় থাকাটা অনেক সেইফ।
গ্লোবাল ভয়েসস বাংলা: ঘুরতে গিয়ে নারী হিসেবে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছিলেন?
সাকিয়া হক: দেশে এখন পর্যটন বেড়েছে। ছেলেদের সাথে মেয়েরাও ঘুরতে যাচ্ছে। কিন্তু আগে এই অবস্থা ছিল না। অনেক সময়ই বিশেষ করে ট্রেকিং ট্যুরগুলোতে ছেলেরা মেয়েদের নিতে চাইতো না। তারা ভাবতো, মেয়েরা পারবে না। পুরো গ্রুপটা স্লো হয়ে যাবে। এটা অবশ্য মাঝে মধ্যে হয়ও। তার মানে এই না যে, মেয়েরা পারে না। আর প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছি। মোটর সাইকেল নিয়ে ট্যুর করার সময় ‘কিয়ামত চলে আইছে’ এমন কথা শুনতে হয়েছে। এগুলো আমি পাত্তা দেইনি। পাত্তা দিলে তো লক্ষ্যপূরণ হতো না।
গ্লোবাল ভয়েসস বাংলা: আমরা দেখেছি, আপনি বা আপনাদের দল শুধু সারাদেশ ঘোরার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। যেসব এলাকা ভ্রমণ করেছেন, সেখানকার স্কুলগুলোতে গিয়ে কিশোরী মেয়েদেরকে বয়:সন্ধিকালীন সমস্যা, প্রজনন স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে সচেতন করেছেন। কেন?
সাকিয়া হক: আপনি জানেন, ফেইসবুক ভিত্তিক আমাদের একটি সংগঠন আছে। সেটার নাম হলো ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’(বাংলাদেশের ভ্রমণ কন্যা)। এই গ্রুপের একটা প্রজেক্ট আছে। ‘নারীর চোখে বাংলাদেশ’ নাম। ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল গ্রুপ থেকে আমরা প্ল্যান করি, মোটরসাইকেলে করে দেশের ৬৪টি জেলায় যাবো। যদিও আমরা এর আগে আরো অনেক জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু মোটরসাইকেল নিয়ে কোথাও ভ্রমণ করিনি। আমরা চাচ্ছিলাম, এটা শুধু ভ্রমণ না হয়ে একটা সচেতনতামূলক প্রজেক্ট হোক। আমি নিজে একজন ডাক্তার। আমাদের দেশের অনেক নারীই মেনস্ট্রুয়াল, হেলথ অ্যান্ড হাইজিন নিয়ে জানেন না। তারা মেনস্ট্রুয়ালকে ট্যাবু টপিক মনে করেন। তাছাড়া আমরা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করি। আমাদের ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ গ্রুপের মূল বিষয়ই হচ্ছে, ভ্রমণের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন। আর নারীর ক্ষমতায়ন শুধু তো ভ্রমণ দিয়ে হবে না। তাই আমরা বয়:সন্ধিকালীন সমস্যা, প্রজনন স্বাস্থ্য’র মতো বিষয় বেছে নিয়েছিলাম।
গ্লোবাল ভয়েসস বাংলা: ফেইসবুকে আপনাদের একটি গ্রুপ আছে। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ নাম। এই গ্রুপের মাধ্যমে আপনারা চান ভ্রমণে উৎসাহিত করার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটাতে। কেমন সাড়া পাচ্ছেন।
সাকিয়া হক: ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর আমি আর আমার বন্ধু মানসী সাহা মিলে ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ (বাংলাদেশের ভ্রমণ কন্যা) গঠন করি। বাংলাদেশের নারীদের ভ্রমণে উৎসাহিত করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। আমরা নারীদের কাজ থেকে প্রচুর সাড়া পাচ্ছি। এখন ২৮ হাজার মেয়ে এটার সাথে যুক্ত। বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা আমাদের সাথে ভ্রমণে যেতে চান। তাদের আগ্রহের কথা আমাদের জানান। আমরা ইতোমধ্যে আগ্রহী মেয়েদের নিয়ে বেশ কয়েকটি সফল ট্যুর সম্পন্ন করেছি।
শুধু ঘোরাঘুরিই নয়, ‘ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ’ ২০১৭ সালে বাংলাদেশের প্রথম ট্রাভেল ফটোগ্রাফি এক্সিবিশনের আয়োজন করে। তাছাড়া কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ আমরা জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮ পেয়েছি। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের মেয়ে মেরিনা মোহাম্মদের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছি। আমাদের আরেকজন প্রতিষ্ঠাতা মানসী সাহা ভারতে যাচ্ছেন, গ্লোবাল প্লাটফর্ম ফর উইমেন লিডারশিপে অংশ নিয়ে ভ্রমণ কন্যাদের তুলে ধরতে। তাই বলতে পারেন, দেশ ও দেশের বাইরে থেকেও আমরা বেশ সাড়া পাচ্ছি।
সাকিয়া হক যেতে চান আরো অনেক দূর। আর সেই দূরযাত্রায় শুধু নারীর ক্ষমতায়নে নিজেকে আটকে রাখতে চান না। চান, মানবকল্যাণে নিজেকে উজাড় করে দিতে।
সাকিয়া হকের বাংলাদেশের সবগুলো জেলা ঘোরার ছবি অ্যালবাম: