এই মুহূর্তে বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষা চলছে। সরকার পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধ করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর (জে এস সি, এস এস সি, এইচ এস সি ইত্যাদি), এমনকি মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের চাকুরীর পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি নিয়মিত ঘটনা হয়ে গেছে। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এসব প্রশ্ন দেশব্যাপী পরীক্ষা অনুষ্ঠানের আগে বিক্রি করা হয়। এমনকি পরীক্ষা শুরুর অব্যবহিত আগে এইসব প্রশ্নপত্রগুলো বিনে পয়সায় ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রেই আসল অপরাধী ধরা পরে না এবং পর্দার আড়ালে থেকে যায়। এইসব প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা পুরো পরীক্ষা প্রক্রিয়া এবং ছাত্রদের মূল্যায়নের পদ্ধতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে।
এদিকে জানুয়ারী মাসে বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে পরীক্ষার সময়ে ফেসবুক বন্ধ রাখার চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে।
গত ১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন সকল ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী সংস্থাকে এক চিঠির মাধ্যমে জানিয়ে দেয় যে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার দিনগুলিতে পরীক্ষার সময়ে অর্থাৎ ৮:০০ – ১০:৩০ ঘটিকা পর্যন্ত সকল প্রকারের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ থাকবে এবং ব্রডব্যান্ডের ইন্টারনেটের গতি ২৫ কেবিপিএস এ কমিয়ে রাখা হবে।
গত ১২ই ফেব্রুয়ারি তারিখ সকালে ইন্টারনেট বন্ধ হবার প্রথম ঘণ্টায় সরকার আর এক চিঠির মাধ্যমে সকল আইএসপিকে পূর্বের সিদ্ধান্ত বাতিল করে ইন্টারনেটের সেবা স্বাভাবিক ও অবিচ্ছিন্ন রাখার নির্দেশ দেয়। কর্তৃপক্ষ এর বদলে পরীক্ষা কেন্দ্রের আশেপাশে মোবাইল ফোন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
সরকারের এই ‘খেয়ালি ও বিবেচনাহীন’ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেট নাগরিকরা ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া যেমন জানিয়েছেন, তেমনি এ নিয়ে ঠাট্টা মশকরা করতে ছাড়েননি।
প্রবাসী ব্লগার দিয়া টুইট বার্তায় বলেছেনঃ
No surprises that #Bangladesh govt. has “shut down” Internet access to prevent leakage during exam season. Then again, questions got leaked an hour before Internet was scheduled to go dark.
— Sabhanaz Rashid Diya (@diya880) February 12, 2018
বাংলাদেশের সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেছেন প্রশ্নফাঁস রোধের জন্যে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ হবার ঘন্টাখানেক আগেই প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যায়।
ইমরান এইচ সরকার সরকারি সিদ্ধান্তকে মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলার সমতুল্য বলে মনে করেন:
ইন্টারনেটের হাত-পা আছে, মাথা আছে। ইন্টারনেট দুর্নীতি করে। ইন্টারনেট প্রশ্নও ফাঁস করতে পারে! তাই বাংলাদেশে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে ইন্টারনেট (প্রায়) বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যারা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তারা মাথা ব্যাথা হলে নিজেদের মাথাও কি কেটে ফেলবেন?
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সারাদেশে অসংখ্য নদী জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। প্রতিবছরই বন্যা হয়ে থাকে। আর বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি’র পরিমাণও অনেক। সেদিকে ইঙ্গিত করে কমেডিয়ান নাভিদ মাহবুব লিখেছেন:
বর্ষাকালে বন্যা প্রতিরোধে ইন্টারনেট বন্ধ রাখা যেতে পারে…
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেদিকে ইঙ্গিত করে ইসলাম রাজ লিখেছেন:
ঋণখেলাপী বন্ধের জন্য টাকামন্ত্রীর কাছ থেকে ব্যাংক বন্ধের নির্দেশনা আশা করছি।
হাসনাত জামিল ইন্টারনেট বন্ধ না করে বরং পরীক্ষা পদ্ধতিই বন্ধ রাখতে বলেছেন:
প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে ইন্টারনেট বন্ধ না করে,পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করে দেয়া উচিৎ।
তাহলে আর প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবেনা।
অর্থনীতির জন্যে খারাপঃ
বাংলাদেশে ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত এবারই প্রথম নয়। ২০১৫ সালে জঙ্গিদের যোগাযোগের পথ বন্ধ করার কারণ দেখিয়ে একবার ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে ইন্টারনেট চালু হলেও সে সময় ২২ দিন বাংলাদেশে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের বেশ কয়েকটি অ্যাপ ব্যবহার বন্ধ রেখেছিল সরকার। এইসব সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ মানুষের যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল।
বর্তমান ইন্টারনেট বন্ধের ঘটনা – যদিও তা কয়েক ঘণ্টার জন্যে নির্ধারিত ছিল – দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ী ফাহিম মাসরুর তার ফেইসবুক পোস্টে সেসবের উল্লেখ করেছেন:
ব্যবসা-বাণিজ্য আর অর্থনীতির উপর এটির বিরাট প্রতিক্রিয়া পড়তে বাধ্য।
কিভাবে?
১/ দেশে কয়েকশত আইটি আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান কাজ করছে যাদের বিদেশে তাদেরক্লায়েন্টদের সাথে ২৪ ঘন্টা যোগাযোগ রাখতে হয়I এক ঘন্টা সময় বিচ্ছিন্ন থাকলেই ব্যবসা চলে যাবার সম্ভবনা! হাজার হাজার ফ্রিল্যান্সার দেশে কাজ করছে যাদের দরকার ২৪ ঘন্টা ইন্টারনেট কানেকশান। প্রতিদিন ২-৩ ঘন্টা ইন্টারনেট না থাকা মানে নিশ্চিত ভাবে ক্লায়েন্ট হারানো!
২/ দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত গার্মেন্ট শিল্প এখন ব্যাপকভাবে ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল । প্রতি মুহূর্ত বায়ারদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয় । অনলাইনে বিডিং করতে হয় সাপ্লায়ারদের কাছে প্রতিনিয়ত ইমেইল পাঠাতে হয়। সকাল বেলা এই যোগাযোগের ‘পিক টাইম'। ইন্টারনেট কিছু সময়ের জন্য না থাকা মানে ব্যবসার বিশাল ক্ষতি হওয়া।
৩/ বর্তমানে প্রতিদিন সকাল বেলা হাজার হাজার তরুণ Uber , pathao, Muv রাইড শেয়ারিং এপ ব্যবহার করে – কেউ রাইড নিতে, কেউ দিতে। সকাল বেলা (৮ টা থেকে ১০ টা) রাইড শেয়ারিং-এর পিক টাইম (দিনের অর্ধেক ইনকাম আসে এই সময় থেকে)। বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে এর সবাই।
এদিকে ইন্টারনেট বন্ধের মহড়া হিসেবে আধঘণ্টা বন্ধ থাকার কারণে কী ক্ষতি হয়েছে, সেটা নিয়ে ফাহিম মাসরুর’র পোস্টে মন্তব্যের ঘরে আমিনুর রহমান লিখেছেন:
আজ রাত ১০ টার সময় নেট চলে যাওয়াতে আমার ২৬৫ ডলার লস। এক ক্লায়েন্টের সাথে ২৬৫ ডলারের একটা কাজ নিয়ে কথা বলছিলাম। হুট করে নেট চলে গেছে। পরে নেট আসার পর দেখি ক্লায়েন্ট অন্য একজনকে হায়ার করে ফেলেছে
সমাধান কোথায়?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৬৩টি প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে দেশে। এই ঘটনাগুলো ঘটেছে প্রশ্ন ছাপাখানা থেকে স্টোরে রাখা এবং অবশেষে পরীক্ষা কেন্দ্রে আনা – এর মধ্যে যে কোন সময় – মূলত মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে। এর পরে সেই প্রশ্নগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, স্ন্যাপচ্যাট ইত্যাদি পদ্ধতি ব্যবহার করে সহজে চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এক বৈঠকে মন্তব্য করেছেন যে উন্মুক্ত বই ও নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রশ্নফাঁস এর সমস্যাকে মোকাবেলা করে পরীক্ষার গুণগত মান রক্ষা করা যেতে পারে।
এছাড়াও এসব ঘটনার পেছনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, ছাপানো, সুরক্ষিত রাখা এবং বিতরণের সাথে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশ আছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে। অনেকে ব্যর্থতার দায় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগও চেয়েছেন।
যদিও পুলিশি অভিযানের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তবুও প্রশ্নফাঁস রোধ করা যায়নি। ইতিমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ৫ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে অপরাধীদের ধরিয়ে দেবার জন্যে।
এছাড়াও অবিরত প্রশ্নফাঁসের অন্যতম কারণ বর্ধিত চাহিদা। এসবের মাঝে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ না করে কিভাবে এই প্রশ্ন ফাঁস রোধ করতে পারেন তা দেখার বিষয়।