জাতিসংঘের বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেল বাংলাদেশের নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা

মঙ্গল শোভাযাত্রা।

মঙ্গল শোভাযাত্রা। নববর্ষ উদযাপনের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে সকালে বের হয় এই শোভাযাত্রা। ছবি তুলেছেন আপন, ফ্লিকার থেকে নেয়া। সিসি বাই – এস এ ৪.০

জাতিসংঘের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশে নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের দিনে (১৪ বা ১৫ এপ্রিল) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাংলা নতুন বছরকে বরণ করে নেয়।

তবে এটা শুধু চারুকলার শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে না। এতে সাধারণ মানুষরাও অংশ নেন। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শোভাযাত্রায় অংশ নেয়া মানুষজন বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করেন।

ইউনেস্কোর ভাষ্য অনুযায়ীঃ

The Mangal Shobhajatra festival symbolizes the pride the people of Bangladesh have in their folk heritage, as well as their strength and courage to fight against sinister forces, and their vindication of truth and justice. It also represents solidarity and a shared value for democracy, uniting people irrespective of caste, creed, religion, gender or age. Knowledge and skills are transmitted by students and teachers within the community.

মঙ্গল শোভাযাত্রা বাংলাদেশের মানুষের সাহস আর অশুভের বিরুদ্ধে গর্বিত লড়াই আর ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রতীকী রূপ। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ পরিচয় নির্বিশেষে সবার অংশ গ্রহণকেও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নিয়ে ইউনেস্কো কমিটি এই স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি উদযাপনের জন্যে যেসব কলা ও শিল্পের প্রদর্শন হয় – সেটার জ্ঞান এসব ছাত্র ও শিক্ষকদের দ্বারা সমাজে ছড়িয়ে যায়।

বাংলাদেশের ধর্মীয় কট্টরপন্থীরা বহুদিন ধরেই মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা করে আসছে। তাই এই অনুষ্ঠান মুসলমান-প্রধান এই দেশের সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একটি বলিষ্ঠ প্রদর্শন হিশেবে বিবেচিত।

গত ৩০ নভেম্বর, বুধবার ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় জাতিসংঘের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।

ইউনেস্কো টুইট করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়:

‘বিশ্বসভ্যতার স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’র তালিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা।

এই ঘোষণায় স্বভাবতই খুশি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। ফেইসবুক ব্যবহারকারী মিসির আলী লিখেছেন:

এটা আমাদের বিজয়, বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিজয়| সেই সাথে আমাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল বর্ষবরণের বর্ণিল আয়োজন করার, কারন এটি এখন শুধু আমাদের প্রোগ্রাম থাকল না, সারা বিশ্বের মানুষের অনুষ্ঠান হয়ে গেল|

আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন ইউনেস্কো স্বীকৃত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। #আনন্দিত #গর্বিত #ঐতিহ্য #বাংলাদেশ

পুরস্কার ঘোষণার কিছুক্ষণ পরেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম এমপি ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে দেশবাসীকে জানিয়ে দেন যে এই ঘোষণার পেছনে দেশের সরকার কাজ করেছে:

আমরা বেশ কিছুদিন যাবৎ এটা নিয়ে কাজ করছিলাম এবং আজকে সকালে দুই ঘণ্টাব্যপী বিতর্কের পর এটা নিশ্চিত করা গেছে । সবাইকে অভিনন্দন !!!

মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল। ছবি সৌরভ লস্করের। কপিরাইট ডেমোটিক্স (১৪/৪/২০১৫)

মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের ঢল। ছবি সৌরভ লস্করের। কপিরাইট ডেমোটিক্স (১৪/৪/২০১৫)

আনন্দই পারে স্বৈরাচারের জুজুর ভয় দূর করতে

বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাস অনেক পুরোনো হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস বেশিদিনের নয়। তবে এই অল্পদিনের মধ্যেই এটা বাংলাদেশের বর্ষবরণের একটি অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। এর শুরু ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীদের হাত ধরে। মূলত তৎকালীন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের অংশ হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রা’র শুরু হয়। এর পরবর্তী বছরেই সংগঠিত হয় ৯০এর গণঅভ্যুত্থান যার হাত ধরে সংসদীয় গণতন্ত্রে বাংলাদেশের যাত্রা।

শিল্পী নাজিব তারেক শুরু থেকেই যুক্ত ছিলেন মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের সাথে। তিনি ছিলেন সেই আয়োজনের কনিষ্ঠতম কর্মী। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবেই যে মঙ্গল শোভাযাত্রার শুরু, সেটা স্মরণ করে তিনি লিখেছেন:

১ লা বৈশাখে হবে শোভাযাত্রা এবং সেটা হবে আনন্দ শোভাযাত্রা। আনন্দই পারে স্বৈরাচারের জুজুর ভয় দূর করতে। স্বৈরাচার তো আনন্দকেই প্রথমে হত্যা করতে চায়, তো আনন্দই হোক স্বৈরাচার প্রতিরোধের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার।

এই শোভাযাত্রা করতে গিয়ে স্বৈরাচার এবং মৌলবাদীদের হুমকির শিকার হতে হয়েছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক, চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন:

মঙ্গল শোভাযাত্রাকে একটি সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করতে গিয়ে স্বৈরাচারীদের নানা রকম হুমকি শুনতে হয়েছে, মৌলবাদীদের রক্তচক্ষু দেখতে হয়েছে।

বাংলাদেশের রয়েছে প্রায় ২০০০ সালেরও বেশী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা বিভিন্ন ধর্ম, জাতী ও বর্ণের লোকদের কৃষ্টি ও কলা নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। বর্তমানে দেশটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশ – ৯০ শতাংশ মানুষই মুসলমান। এদের অনেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রা, পহেলা বৈশাখ পালনকে ইসলামবিরোধী বলে মনে করে থাকেন। তাদের বক্তব্য এটা ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক।

কট্টরপন্থী ইসলামিক পণ্ডিত হিসেবে পরিচিত মাওলানা আহমদ শফী একে বর্জনের আহ্বান জানিয়ে বলেন:

মুসলমানদের বিশ্বাস মতে ভাল-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল সব কিছুই আল্লাহর হুকুমেই সংঘটিত হয়ে থাকে। মুসলমানকে কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করতে হবে একমাত্র আল্লাহর কাছেই। সুতরাং মুসলমানদের জন্যে মঙ্গল শোভাযাত্রার সংস্কৃতি চর্চা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

অনেকে আবার বলেন যে মঙ্গল শোভাযাত্রা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান। কোন মুসলমান এতে অংশগ্রহণ করলে তাদের ঈমান নষ্ট হয়ে যাবে।

এদিকে পহেলা বৈশাখ আর মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপনকে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে দাবি করে নিয়ে গাজী জয়িতা মাহীদ লিখেছেন:

যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাঙালি থাকবে- ততদিন এই নববর্ষের আয়োজন থাকবে। আনন্দ উৎসব থাকবে, বৈশাখী মেলা থাকবে, মঙ্গল শোভাযাত্রা থাকবে। এইটাই অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।

নববর্ষ উদযাপনকারীদের বর্ণিল মিছিল

মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন টিভি সাংবাদিক শিমুল বাশার। ঘোষণা শোনার পরেই তিনি সবার সাথে সেই ডকুমেন্টারি ভাগ করেছেন:

মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের কিছু ছবি রইলো এখানে:

চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রার অন্যতম অনুষঙ্গ মুখোশ তৈরির কাজ। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরাই এই কাজটি করে থাকেন। তবে সাধারণ মানুষজনও এতে অংশ নেনঃ

উদযাপনের অংশ হিসেবে শুধু মুখোশ নয় – নানা ধরণের আলপনা হাতে আঁকা হয়ঃ

ঢাকার রাস্তায় চলছে মঙ্গল শোভাযাত্রাঃ

দেশের বাইরেও নববর্ষের অংশ হিসেবে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়াতেও শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ঃ

উৎসবের আনন্দে মেতে উঠে সবাইঃ

3 টি মন্তব্য

আলোচনায় যোগ দিন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .