বাংলাদেশে যে ভাষায় কথা বলতে পারেন মাত্র ৬ জন মানুষ!

ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সিংরা ম্রো। তিনি বিলুপ্তির মুখে থাকা ভাষাটিকে বাঁচাতে রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছেন। ছবিটি ইয়াংঙান ম্রো’র সৌজন্যে প্রাপ্ত।

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করবে বাংলাদেশিরা, যাদের মধ্যে ৯৮% সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা বাংলায় কথা বলে। তবে, বাংলাদেশের নৃতত্ত্ব বিজ্ঞানী ও আদিবাসী নেতাদের দেওয়া তথ্যানুসারে বাংলাদেশে মোট ৪৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০ লাখ মানুষ রয়েছে যাদের মধ্যে ৪১টির ও বেশী ভাষা প্রচলিত। এর মধ্যে ১২-১৮টি ভাষা বিভিন্ন মাত্রায় বিপন্ন।

‘রেংমিটচ্য’ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি মৃতপ্রায় ভাষা। আমেরিকার ডর্টমুণ্ড কলেজের প্রফেসর ও ভাষাবিজ্ঞানী ডেভিড পিটারসন, যিনি ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠীর ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন, একে কুকি-চিন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত খোমিক ভাষা হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছেন ২০০৯ সালে। এই ভাষা স্বতন্ত্র, তবে খুমি আর ম্রো ভাষার কাছাকাছি এটি।

বর্তমানে ভাষাটি পুরোপুরি জানেন মাত্র ৬ জন মানুষ। যাদের সবার বয়স ৬০-এর উপরে। তাদের মৃত্যু হলে রেংমিটচ্য নামের ভাষাটিরও মৃত্যু ঘটবে। বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে একটি ভাষা ও সংস্কৃতি।

কেন এই ভাষা বিলুপ্তির মুখে?

সতেরো শতকের কথা। সে সময়ে আরাকান থেকে খুমিদের সাথে ছোট্ট একটি দল বান্দরবানে আসে। তারা ছিল রেংমিটচ্যভাষী। একসময় তারা আলাদা পাড়ায় স্বতন্ত্র ধারায় বসবাস, ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা করতেন। কিন্তু ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমলে কলেরা, গুটিবসন্তে রেংমিটচ্যভাষী জনগোষ্ঠীর বহু মানুষের মৃত্যু হয়। জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় তারা ম্রো পাড়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। এবং তাদের সাথে বৈবাহিক বন্ধনসহ সামাজিকভাবে মিশে যেতে বাধ্য হয়। আস্তে আস্তে রেংমিটচ্য ভাষা থেকে তারা ম্রোভাষীতে রূপান্তরিত হন।

ভাষাবিজ্ঞানী পিটারসন ২০১৫ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন যে তখন পর্যন্ত এই ভাষার যে ৩০ জনকে খুঁজে পাওয়া গেছে। এদের সবার বয়স ৫০-এর ওপর বলে আশঙ্কা করেছিলেন যে সন্তানেরা না শেখায় তাঁদের মৃত্যুর পর ভাষাটি বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী মাত্র ৬ জন রেংমিটচ্য ভাষাভাষী বেঁচে আছেন বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবানের বিভিন্ন উপজেলায় – যাদের মধ্যে পাঁচজন পুরুষ ও একজন নারী। তাদের পরে এ ভাষায় কথা বলবে কে?

সুড়ঙ্গের শেষে আলো

তবে আশার কথা হলো, ৬ জনের ভাষা বাঁচাতে এগিয়ে এসেছেন এক তরুণ। তার নাম সিংরা ম্রো। তিনি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর শ্রুতির আড়ালে থাকা ভাষাটিকে বাঁচাতে শুরু করেছেন রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম। ম্রো জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোর ও বয়স্কদের নিয়ে গত বছরের ১ ডিসেম্বর থেকে চলছে এই কার্যক্রম।

গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা’র পক্ষ থেকে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম সিংরা ম্রো এবং রেংমিটচ্য ভাষার অভিধান লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো’র সাথে। ইমেইলে যোগাযোগের মাধ্যমে তারা তাদের উদ্যোগ নিয়ে গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলাকে ইন্টারভিউ দিয়েছেন।

গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা: পূর্বপুরুষদের ভাষা বাঁচাতে এই রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে একটু বলবেন? এই উদ্যোগ নেয়ার পিছনের কারণ কী?

সিংরা ম্রো: ছোটকাল থেকে আমি শুনে আসছি আমাদের নিজস্ব মাতৃভাষা রয়েছে। নাম রেংমিটচ্য। কিন্তু আমরা বলি অন্য ভাষা। নিজেদের মাতৃভাষা থাকতে অন্য ভাষায় কথা বলতে অনেক খারাপ লাগতো। লজ্জাও হতো অনেক। সবসময় নিজেকে অপরাধীর মতো মনে হতো। অপর দিকে বাবা প্রায় সময় বলতেন, আমার মাতৃভাষা আমি মারা গেলে হারিয়ে যাবে। ধরে রাখার মতো কেউ থাকবে না। বাবার আফসোসের কথা আমাকে খুব পীড়া দিয়ে থাকে। দাদা ইয়াংঙানের সাথে পরামর্শ করে গত ডিসেম্বর থেকে আমি যা পারি তা নিয়ে রেংমিটচ্য ভাষা ক্লাশ শুরু করেছি।

কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। তাই সিংরা ম্রো’র বাড়িতেই চলছে রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম। ছবিটি ইয়াংঙান ম্রো’র সৌজন্যে প্রাপ্ত।

গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা: গত ডিসেম্বর থেকে আপনি রেংমিটচ্য ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছেন। কেমন সাড়া পাচ্ছেন? কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন?

সিংরা ম্রো: আমি যখন প্রথম ক্লাশ শুরু করি তখন মাত্র পনেরজন এসেছিল। পরে আরো বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী যোগ দেয়। দিনে জুম চাষের কাজ করতে হয়; তাই ক্লাশ নিয়েছি রাতে। কারণ রাতে কোন কাজ-কর্ম থাকে না। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা, মাঝে মাঝে ১০টাও বাজে। ছেলেমেয়েরা এখন খুবই আনন্দের সাথে ক্লাশ করতে আসে। শুধু রেংমিটচ্য ছেলেমেয়ে নয়, পাড়ায় অন্য ভাষার ছেলেমেয়েরাও ক্লাশ করতে আসে।

আমাদের কোন বই-পুস্তক নেই। তাই ইয়াংঙান দাদার লেখা অভিধান থেকে পড়া শেষ হলে আমরা আর কোন বই পাবো না। তখন কি হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।

গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা: সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পেয়েছেন? আমরা জানি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট দেশের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে কাজ করে। ভাষা রক্ষায় তাদের উদ্যোগও আছে। তাদের সাথে কি আপনার যোগাযোগ হয়েছে?

সিংরা ম্রো: সরকারের কাছ থেকে আমরা চাইবো যাতে আমাদের মাতৃভাষা হারিয়ে না যায় সেই ব্যবস্থা করার জন্য। বইপুস্তক প্রকাশ করে আমাদের পাঠদান ব্যবস্থা করা, আমরা রাতে ক্লাশ করি আমার ঘরে, সুতরাং ঘরে না হয়ে একটা স্কুলের মত করে দিয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করলে অনেক ভাল হবে। এতে করে ছেলেমেয়েরাও আরো উৎসাহ নিয়ে পড়তে আসবে। অপরদিকে আমার পারিবারিক অবস্থাও এতটা ভাল না, তাই আমার জন্য সম্মানী ব্যবস্থা করে দিলে আমি আরো উৎসাহ আর দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারতাম। কারণ এই পর্যন্ত আমরা কোনভাবে সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি।

বিলুপ্তির পেছনে কারণ

বাংলাদেশে ডেভিড পিটারসনের গবেষণা সহযোগী ছিলেন ইয়াংঙান ম্রো। ২০১৫ সালে ডেভিড চলে যাওয়ার পরও কাজটি চালিয়ে যান ইয়াংঙান ম্রো। করোনাকালীন সময়ে রেংমিটচ্য ভাষী লোকদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। ২০২১ সালে তাদের এলাকায় গিয়ে জানতে পারেন, মাত্র ৬ জন বেঁচে রয়েছেন!

রেংমিটচ্য ভাষা বিলুপ্তির কারণ জানতে চাইলে ইয়াংঙান ম্রো গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলাকে বলেন:

রেংমিটচ্য ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হল, তারা এক জায়গা বসবাস করেন না। তাদের কথা বলতে হয় অন্য ভাষা দিয়ে। গ্রামে পঁচিশ পরিবারের মধ্যে রেংমিটচ্য বাস করে সাতটি পরিবার, আর কোন কোন জায়গায় মাত্র একটি পরিবার বাস করে। যার ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের সাথে থাকতে থাকতে তারা নিজেদের মাতৃভাষা আর ধরে রাখতে পারে না। কারণ তাদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকদের ভাষা ব্যবহার করতে হয়।

এমনিতে তাদের মোট জনসংখ্যা দুই-তিন হাজারের বেশি হবে না। কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মাতৃভাষা রেংমিটচ্য বলতে লজ্জাবোধ করে। গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ অন্য ভাষী লোকেরা রেংমিটচ্য ভাষায় কথা বললে কি ভাববে, এসব ভাবতে ভাবতে তারা নিজেদের মাতৃভাষা বলতে পারছেন না। আর এভাবে যুগের পর যুগের চলে আসতে আসতে আজ তাদের এই করুণ অবস্থা।

মিটচ্য তখক নামে রেংমিটচ্য ভাষায় প্রথম অভিধান প্রকাশ করেছেন ইয়াংঙান ম্রো। এতে ভুক্তির সংখ্যা ৩ হাজার ৪০০। ছবিটি ইয়াংঙান ম্রো’র সৌজন্যে প্রাপ্ত।

একটি ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বিষয়টি ইয়াংঙান ম্রো-কে ভাবায়। তখন থেকেই তিনি তাদের সাথে আরো বেশি যোগাযোগ শুরু করেন। আরো বেশি কাজ করতে থাকেন। ২০২৩ সালে মিটচ্য তখক নামে রেংমিটচ্য ভাষায় প্রথম অভিধান প্রকাশ করেন। রেংমিটচ্য ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। তিনি ম্রো বর্ণমালা ও বাংলা বর্ণমালা দিয়ে অভিধান প্রকাশ করেছেন। এতে ৩৪০০ শব্দের ভুক্তি রয়েছে।

সিংরা ম্রো এই অভিধানের উপর ভিত্তি করেই রেংমিটচ্য ভাষার শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

রেংমিটচ্য ভাষার শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি এটা রক্ষা করতে করণীয় কী, জানতে চাইলে ইয়াংঙান গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলাকে বলেন:

এভাবে অভিধান লিখে বা বই প্রকাশ অথবা নিজেদের উদ্যেগে মাতৃভাষায় ক্লাশ করে একটা ভাষাকে ধরে রাখতে পারবো না। তার জন্য সরকারের সহযোগিতা অবশ্যই দরকার।

রেংমিটচ্য ভাষা জানা বর্তমানে যে ছয়জন আছেন, তাদের নিয়ে এখনই মাঠে নামতে হবে। তারা না থাকলে রেংমিটচ্য ভাষা আর কোনভাবে রক্ষা করতে পারবো না। তাদের জন্য অভিধান, ব্যাকরণ, মাতৃভাষা ক্লাশ, তারা যাতে একে অপরে নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে এমন করে এক জায়গা বসবাসের সুযোগ করে দিতে হবে।

তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে নিজেদের মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝাতে হবে। মাতৃভাষায় বই প্রকাশ করে শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে আমার মনে হয় কিছুটা হলে রেংমিটচ্য ভাষাটাকে ধরে রাখতে পারবো।

যেকোনো জনগোষ্ঠী ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে টিকে থাকে। এ জন্য ভাষার গুরুত্ব অনেক বেশি। সিংরা ম্রো ও ইয়াংঙান ম্রো’র রেংমিটচ্য ভাষা রক্ষার উদ্যোগ কার্যকরভাবে এগিয়ে নিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

আলোচনা শুরু করুন

লেখকেরা, অনুগ্রহ করে লগ ইন »

নীতিমালা

  • অনুগ্রহ করে অপরের মন্তব্যকে শ্রদ্ধা করুন. যেসব মন্তব্যে গালাগালি, ঘৃণা, অবিবেচনা প্রসূত ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকবে সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেয়া হবে না .