প্রেন্দনাদ্রাজি নামক অস্ত্রাভা শহরের একটি ছোট্ট পাড়া এই গ্রীষ্মে ছিন্নমূলদের বেআইনি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রধান ক্ষেত্রে পরিণত হয়। চেক প্রজাতন্ত্রের জন্য এটি একটি ব্যতিক্রমী, গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ঘটনা।
যাযাবর সম্প্রদায়কে সামাজিকভাবে বর্জন ও বঞ্চিত করার ধারাবাহিক প্রবণতার আরো একটি দুঃখজনক উদাহরণ প্রন্দনাদ্রাজির এই উচ্ছেদ প্রচেষ্টা। যাযাবরদের “ভবঘুরের মতো জীবনধারা”, “শিকড়হীনতা”, “মূলধারার সংস্কৃতিতে একীভূত হবার অপারগতা” প্রভৃতি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। প্রেন্দনাদ্রাজির অধিবাসীরা যাযাবরদের বেআইনি ভাবে উচ্ছেদ ও তাদের বিরুদ্ধে করা ঢালাও অভিযোগের প্রবণতা- উভয়েরই বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনা বিহীন গ্রীষ্মকালে গণমাধ্যমের নজরে আসার পূর্ব পর্যন্ত জুলুম ও সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বৃহৎ পরিসরে অনুদ্ঘাটিত ও উপেক্ষিত ছিল। রোমেয়া.চেজ নামক একটি স্বাধীন সংবাদ পোর্টালে যাযাবর রোমা সম্প্রদায়ের জীবন এবং নাগরিক অধিকারের জন্য তাদের সংগ্রাম নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন [চেক ভাষায়] প্রকাশিত হয়। এই বিশদ ও ধারাবাহিক প্রতিবেদনে রোমা সম্প্রদায়ের বিষয়গুলোকে দেখা হয় সামাজিক ন্যায় বিচারের প্রেক্ষপটে।
ইতিহাস
‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র পত্তন হয় ১৯০২ সালে। ইহুদি সম্প্রদায়ের আবাসস্থলের অনতিদূরে অবস্থিত ‘প্রেন্দনাদ্রাজি’ তখন এগারোটি ইটের তৈরি ভবনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি ছোট্ট লোকালয়। একটি আসমর্থিত সূত্র মতে, ১৯৩৯ সালে এই বাড়িগুলোর বাসিন্দাদের পোলান্ডের নিস্কো নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং তারাই ছিল নিস্কোর প্রথম বন্দি। চেক গণমাধ্যম ‘প্রেন্দনাদ্রাজি’ শব্দটির অর্থ ও ইতিহাসের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা উপেক্ষা করে একে শুধুই একটি মহল্লা হিসেবে প্রচার করে। ‘প্রেন্দনাদ্রাজি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ “রেল স্টেশনের সামনে” কিন্তু স্থানটি অস্ত্রাভা শহরের প্রধান রেল স্টেশনের পিছনে অবস্থিত। এই রেল স্টেশনের সামনে রয়েছে গণহত্যার শিকার ইহুদিদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ। উল্লেখ্য, একই গণ হত্যার শিকার হয় হাজার হাজার রোমা, কিন্তু স্মৃতি ফলকে তাদের স্থান হয় নি।
‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র ভবনগুলো একটি ত্রিভুজাকৃতির দ্বীপে অবস্থিত, যার একদিকে মহাসড়ক, অন্যদিকে রেলওয়ে ডিপো এবং তৃতীয় দিকে শিল্পাঞ্চালের জন্য নির্ধারিত বেড়া দিয়ে ঘেরা জমি। ‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র এই অবস্থান তাদেরকে এক কোণে ঠেলে দেবার অনুভূতি প্রদান করে।'প্রেন্দনাদ্রাজি'তে ভ্রমণও বেশ কষ্টসাধ্য: দীর্ঘ বিরতি দিয়ে মাত্র একটি বাস যাতায়াত করে, এবং ট্যাক্সি চালকদের মধ্যে সেখানকার সরু রাস্তায় যাবার ব্যাপারে অনীহা দেখা যায়।
সেখানে সামাজিক অবকাঠামোর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। স্থানটি হতে চার মাইল দূরে অবস্থিত শহরে ছয় মাস পূর্বে চৌদ্দ একর জমির উপর নির্মিত একটি নতুন শপিং মল চালু হয়েছে। পক্ষান্তরে ‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রয়েছে মাত্র দুটি ছোট্ট দোকান, যেগুলোতে দৈনন্দিন খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করে, উল্লেখ্য এই খাদ্যদ্রব্যগুলো সব সময় টাটকা হয় না। এছাড়াও এখানে রয়েছে একটি শুঁড়িখানা, যার ব্যবস্থাপকের মতে, এটিতে ধারন ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুন মানুষের সমাগম ঘটে, কারণ এখানকার মানুষের অন্য কোথাও যাবার জায়গা নাই। ‘প্রেন্দনাদ্রাজি'তে অনেক শিশু বসবাস করেলেও তাদের জন্য কোন খেলার মাঠ বা অন্য কোন ব্যবস্থা নেই।
কত দিনের জন্য গৃহ?
বিচ্ছিন্ন অবস্থা সত্ত্বেও ‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র বাসিন্দারা একে নিজেদের আবাসস্থল হিসেবে গণ্য করে। কিন্তু বিপত্তি হলো খুব বেশি দিন হয়তো তাদের এই ঘর তাদের থাকবে না।
আগস্ট মাসের প্রথম দিকে অস্ত্রাভার গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র বাড়িগুলোকে বসবাসের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করে। অযোগ্য ঘোষণার কারণ হিসেবে কর্তৃপক্ষ এর ভঙ্গুর নর্দমা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে এবং বাড়ির মালিক ওলদ্রিছ রযতচিলকে ২৪ ঘনটার ভিতর বাড়ি থেকে ভাড়াটিয়াদের উচ্ছেদ করতে বলেছে। অস্ত্রাভা স্বল্পমূল্যের আবাসনের অভাবের জন্য কুখ্যাত এবং এই মানুষগুলোর জন্য সিটি হল অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে জনাকীর্ণ হোটেলে স্থানান্তর হবার পরামর্শ ছাড়া বিকল্প কোন ব্যবস্থা করতে পারে নি।
মিঃ রযতচিল তাঁর ভাড়াটিয়াদের সাহায্য করার জন্য সিটি হলের দেয়া উচ্ছেদের নির্দেশকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।এই বাড়িগুলোতে ৩০-৪০ বছর ধরে বসবাস করছে এমন আনুমানিক ১৪০ জন মানুষ গৃহ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তারা রোমাদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি অরোমা সমাজকর্মীদের দলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। যা রোমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত চেকের এর সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই।
অগস্টের শুরু থেকে কর্তৃপক্ষের চাপ ধীরে ধীরে বাড়ছিল- কৌতুকের বিষয় হলো এই উচ্ছেদের অন্তর্নিহিত কারণ বলা হচ্ছে ভেঙ্গে যাওয়া নিকাশী ব্যবস্থা। যা প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৯৯৭ সালের বন্যার সময়, এবং বিগত দুই বছর ধরে তাদের শোচনীয় অবস্থা অস্বীকার করা হয়েছে।
‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র ভাঙা নিকাশী ব্যবস্থার জন্য এর বাসিন্দা রোমাদের দোষারোপ করা মূলধারার মানুষের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত হলেও প্রকৃত অর্থে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে। যার প্রমাণ পাওয়া যাবে শহরের বিভিন্ন নগরহলে চলমান মামলা থেকে। মামলাগুলো মূলত ‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র মালিকানা ও নিকাশী ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত।
এখানে একটি প্রশ্নের উদয় হয়ঃ নিকাশী ব্যবস্থার সংস্কার না করে কেন বাসিন্দাদের উচ্ছেদের জন্য এত তাড়াহুড়ো? এই প্রশ্নের একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে পাশের রাস্তায় সেপ্টেম্বরে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন মহাবিদ্যালয় যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে এবং এলাকাটি বিকাশকারীদের লোভের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এটাই প্রথমবার নয় যখন রোমাদের সম্ভ্রান্তায়নের জন্য তাদের ঘর থেকে বিতাড়িত করা হচ্ছে । বিগত দশ বছরে রোমাদের শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে বিতাড়িত করে সেই স্থানটিকে আমোদ-প্রমোদের কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে। উল্লেখ্য,স্থানটিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে শতাধিক পানশালা নির্মাণ করা হয়েছে।
‘রোমা সমস্যা'র সমাধানের জন্য ‘রোমাদের উচ্ছেদ'এর প্রস্তাবটি প্রায় চেক প্রজাতন্তের সাধারণ নাগরিকরা উত্থাপন করে থাকে। ২০০৬ সালে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভের দুই বছর পর যখন কানাডা চেক নাগরিকদের জন্য সে দেশে ভিসামুক্ত প্রবাশাধিকার প্রদান করে,তখন অস্ত্রাভা জেলার মারিয়ান্সকে হরয় একটি অবিশ্বাস্য প্রকল্প সামনে নিয়ে আসে। এই প্রকল্পের আওতায় রোমাদের কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য উৎসাহিত করা হয়, শুধু তাই নয়, আর্থিক অনুদান স্বরূপ তাদের জন্য বিনা মূল্যে বিমান টিকিটের ঘোষণা করা হয়।
‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন- কর্তৃপক্ষ এখানে কোন সয়াহতা নিয়ে এগিয়ে আসে নি। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অস্ত্রাভা জল কোম্পানি (OVAK) বাড়িগুলোতে জল বিতরণ বন্ধ করে দেয়, এখানে তারা কারণ হিসেবে দেখায় বকেয়া বিল। তিন সপ্তাহ সেই জল কোম্পানির সরবরাহকৃত বিকল্প ব্যবস্থা থেকে এলাকার মানুষ জল সংগ্রহ করে, যা ছিল খুব ব্যয়বহুল। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হতে তিন সপ্তাহ লেগে যায়। একটি ট্যাপকল থেকে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন করা হয় যা এখানকার সমস্ত অধিবাসী যৌথভাবে ব্যবহার করত।
পরবর্তীকালে পরিবারগুলো সামাজিকসুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে লাগল। সামাজিক নিরাপত্তাকর্মীরা অভিযোগ করতে শুরু করল- জল সরবরাহ না থাকায় তারা রান্না ও কাপড় ধুতে পারছে না, তাছাড়া স্থায়ী আবাস না থাকায় এস্থানের বাসিন্দারা কোন আবাসিক সুবিধা পাবে না। একটি চালের নিচে জল সরবরাহ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়।
অগস্টের শেষ দিক থেকে নগরের সামাজিক কর্মীরা ‘প্রেন্দনাদ্রাজি’ গিয়ে পরিবারগুলোকে হুমকি দিচ্ছে তাদের সন্তানদের নিয়ে যাবার যদি তারা দ্রুত হোস্টেলে না পাঠায়। এই বিষয়গুলো পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষগুলোর উপর অপরিমেয় চাপ সৃষ্টি করেছে। স্বল্প সংখ্যক ব্যয়বহুল হোস্টেল ছাড়া এদের বিকল্প কোন আবাসস্থল না থাকায় বাসিন্দারা গৃহহীন ও সন্তান হারানোর আশঙ্কায় রয়েছে।
জোট গঠন
নানামুখী চাপের মধ্যেই জোট গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।
আন্দোলনকে ভারতীয় বংশোদ্ভূত চেক নাগরিক রোমা অধিকারকর্মী কুমার বিশ্বনাথন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, তাঁর সংগঠন , ভযাজেম্নে সুজিটি (“একত্রে বসবাস”; @ ভযাজেম্নেসউযিতি [cs, en] টুইটারে),রোমা সম্প্রদায়ের কথা তুলে ধরতে বিভিন সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কুমার বিশ্বনাথনের সাক্ষাতকার [cs] যাঅলাভজনক প্রকাশনা সংস্থা নভয় প্রস্তর সম্প্রতি প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি গঠিত একটি গণস্বাধীনতা সংস্থার অস্ত্রাভা শাখার স্বল্প সংখ্যক কর্মী পরালটার (ফেসবুকেএখানে),প্রাগের কিছু বর্ণবাদ বিরোধীকর্মী তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। পরালটার মুখপাত্র মার্টিন শকাবরাহা পরিস্থিতি নিয়ে বিপুল পরিমাণ লেখালেখি করেছেন। তাঁর বর্তমান বিশ্লেষণ হলো [cs] এই পরিস্থিতি একটি পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট বিপর্যয়,এই সঙ্কট সৃষ্টিতে কর্তৃপক্ষের অবহেলা, সেইসাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার উদাসীনতাকে তিনি দায়ী করেছেন।
সরকারী সামাজিক অন্তর্ভুক্তি সংস্থার পরিচালক মিলান শিমাচেক রোমাদের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছেন। এছাড়াও ইউরোপীয় কমিশন অস্ত্রাভা'র নগরপাল পেতর কাজনারের নিকট সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানিয়ে পত্র লিখেছেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চেক শাখা এই পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিবৃতি [cs] দিয়েছেন।
যদিও এই সমবেত কণ্ঠস্বর আস্ত্রাভা জেলা ও নগর পর্ষদের দ্বারা ‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র জন্য ভাল কিছু করানোর জন্য যথেষ্ট নয়। এই মুহূর্তে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে, কারণ অস্ত্রাভা সামাজিক নিরাপত্তা কার্যালয় বাসিন্দাদের চূড়ান্ত সয়মসীমা বেঁধে দিয়েছে – হয় তারা হোস্টেলে স্থানাতরিত হোক নতুবা তাদের সন্তানদের দূরে নিয়ে যাওয়া হবে।
‘প্রেন্দনাদ্রাজি'র সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা প্রয়োজন। যদি এই উদ্যোগ সফল হয় তবে তা উত্তরসূরিদের জন্যও সহায়ক হবে, সরকারী প্রতিষ্ঠান- যাদের নাগরিকগণকে সেবা প্রদান করার কথা, যারা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ- তাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের উদাহরণ হিসেবে এটি বিবেচিত হবে।